× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পাহাড়ে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকুক

ড. ফরিদুল আলম

প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৫৫ পিএম

আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৫৭ পিএম

ড. ফরিদুল আলম। অলঙ্করণ প্রবা

ড. ফরিদুল আলম। অলঙ্করণ প্রবা

কেএনএফ বা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের নাম দুই বছর আগে সবার সামনে নতুন আতঙ্ক হিসেবে এলেও তাদের সাম্প্রতিক তৎপরতা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য নতুন হুমকি সৃষ্টি করেছে। তাদের উত্থান ও ক্রমবিকাশের নেপথ্যে প্রাথমিকভাবে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে সব পাহাড়ি জনগণের স্বার্থ সংরক্ষিত না হওয়া এবং এর পরে প্রতিবেশী দেশ বিশেষ করে মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দুটি রাজ্যের সমমনা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয় জানা গেলেও পুরো বিষয়টি এখন পর্যন্ত সবার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয় বলেই মনে হয়।

মিয়ানমারের কোচিন, চিন এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যের বিস্তৃত এলাকা নিয়ে একটি পৃথক কুকিভূমি প্রতিষ্ঠা মূল উদ্দেশ্য হলেও তাদের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসকাণ্ডের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মূলত অর্থ উপার্জনের জন্য তারা কিছু ভয়ংকর কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ধরনের কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে এসেছে তা হচ্ছে পার্বত্য এলাকার গভীর জঙ্গলের ভেতর তারা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার মতো কিছু সংগঠনের জঙ্গিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যারা প্রশিক্ষিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিস্তৃত অঞ্চলে। এদের সঠিক সংখ্যাটি জানা না গেলেও প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা যে বাইরে গিয়ে তাদের নেওয়া প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও জঙ্গিদের এ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না এ কথা বলার কোনো উপায় নেই। এদের মধ্যে কিছু সদস্য ইতঃপূর্বে ধরা পড়লেও আমরা নিকট অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখব যে অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় অনেকেই। এ বিবেচনায় কেএনএফের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি কেবল পার্বত্য অঞ্চলে নয়, বরং সর্বব্যাপী।

যা হোক, কেএনএফের অর্থ উপার্জনের সদ্যসাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে তিনটি ব্যাংকে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র এবং অর্থ লুট ও সোনালী ব্যাংকের একজন ম্যানেজারকে অপহরণ করে দুই দিন আটকে রাখার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় তাকে উদ্ধার। এসব ঘটনার সঙ্গেই তাদের অর্থের সাজশ রয়েছে। ব্যাংকে হামলা করে ১৩টি অস্ত্র লুট করা হলেও এখন পর্যন্ত সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এর বাইরেও তারা আরও ভয়ংকর কিছু অপরাধে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চাঁদাবাজি, অপহরণ, লুটপাট ও হত্যার মতো কিছু ঘটনা। কেএনএফের উত্থানের পেছনের কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তাদের ভাষায় পার্বত্য শান্তি চুক্তির অসমতা, যেখানে একপক্ষীয়ভাবে সেখানে বসবাসরত নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নৃগোষ্ঠী চাকমাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান সন্তু লারমা। এ চুক্তি স্বাক্ষর করতে গিয়ে তাদের নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থসহ গোষ্ঠীস্বার্থের দিকেই তারা অধিক মনোযোগী ছিলেন বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ কেএনএফের। আর এসব নিয়েই তাদের উত্থানের ইতিহাস শুরু। অবশ্য বর্তমানে কেএনএফের সশস্ত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাথান বম নামে বম সম্প্রদায়ের এক নেতা, যিনি নিজে একসময় এ শান্তিচুক্তির পক্ষে ছিলেন এবং ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ বিবেচনায় ঢাবিতে পড়াশোনার সুযোগ পান। এ নাথান বমই একসময় তার সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হতে শুরু করেন এবং নিজ সম্প্রদায়ের কিছু লোককে টেনে কেএনএফের সশস্ত্র সংগঠন কুকি ন্যাশনাল আর্মি বা কেএনএ সৃষ্টি করেন।

বর্তমানে সব অস্থিরতার পেছনে রয়েছে কেএনএ। কিছুদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে এ অঞ্চলকে মানুষের জন্য বসবাসের উপযোগী করতে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কাজ করে আসছিল। ২০২৩ সালের ২৩ মে এ কমিটি গঠনের পর থেকে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের কয়েক দফা অনলাইন এবং দুই দফা সশরীর সভা হয়েছে। গত বছরের ৫ নভেম্বর ও এ বছরের ৫ মার্চ অনুষ্ঠিত দুটি সশরীর সভায় কমিটির সঙ্গে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এ সমঝোতা স্মারকে তারা অপহরণ, লুটপাট, চাঁদাবাজিসহ সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা এর পরই সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে হামলা চালায় এবং ব্যাংক কর্মকর্তাকে অপহরণের মতো ঘটনা ঘটায়। এর বাইরেও তারা এলাকার নিরীহ মানুষের ওপর ব্যাপক নির্যাতন অব্যাহত রাখে। ব্যাংক কর্মকর্তাকে উদ্ধারের পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের ব্যাপক গোলাগুলি হয়, যদিও সে সময় তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ভূত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কেএনএফের সঙ্গে সব আলোচনা বন্ধ ঘোষণা করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের মনে বর্তমান সময়ে এক চরম নিরাপত্তাহীন অবস্থা বিরাজ করছে। যে বম সম্প্রদায় মূলত কেএনএফকে বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের অবস্থা আরও বেগতিক। একদিকে তারা স্থানীয়দের সন্দেহের শিকার, অন্যদিকে তারা যে এ ধরনের অস্থির অবস্থা প্রত্যাশা করছে না সে কথাও মুখ ফুটে বলতে পারছে না। অতীতে এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে দেখা গেছে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে নিজ সম্প্রদায়ের অনেককে ধরে হত্যা করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমা নৃগোষ্ঠীর বাইরে যে অন্য নৃগোষ্ঠীগুলো সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করে তারা হচ্ছে কুকি, চাক, খিয়াং, লুসাই, মুরং, পাখোয়া ইত্যাদি। এরা সবাই মূলত বম জাতিগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বর্তমানে তাদের সশস্ত্র সংগঠন কেএনএকে ব্যবহার করে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চায়। আর এজন্য প্রয়োজন তাদের মধ্যে লোকবল বাড়ানো এবং বাড়তি অর্থের সংস্থান। তারা মূলত ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগঠন, এবং আগেই বলা হয়েছে, এদের নেতৃত্বে রয়েছে বমরা। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে এ বম জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৩ হাজারের কিছু বেশি, এর মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধ বাদ দিয়ে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা হিসাব করলে ৪ হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়। ধারণা করা যায়, তাদের ৩ হাজার সশস্ত্র কর্মী রয়েছ, যারা এ সংগঠনটি পরিচালনা করছে। এর বাইরে মিয়ানমারের কোচিন, চিন এবং ভারতের মিজোরাম ও মণিপুরে কিছু কুকি জনসংখ্যা রয়েছে, যারা সম্মিলিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম, মিয়ানমারের কোচিন, চিন ও মিজোরামের একাংশ নিয়ে একটি কুকিভূমি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর এ কথা বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত যে কেএনএ’র এ সশস্ত্র যোদ্ধারা ভারত ও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। বর্তমানে তারা মনে করছে, তাদের যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটানো এবং এরপর নিজেদের আত্মগোপনে রাখার সক্ষমতা বেড়েছে, আর তাই আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

সাম্প্রতিক ঘটনায় সরকার বেশ উদ্বিগ্ন। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এ নিয়ে আমাদের দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বিরোধী দলগুলো একে নিয়ে তামাশা করছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি আমলে নিয়ে এ ক্ষেত্রে তাদের দিক থেকে আরও গঠনমূলক আলোচনা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের প্রতি ইতিবাচক পরামর্শ থাকতে পারত, সেসব আমরা দেখছি না। যা হোক, ৫ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সশরীরে বান্দরবান সফর করে বিভিন্ন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। যেকোনো মূল্যে এ ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সরকারের দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরদিনই সেনাপ্রধান বান্দরবানে আসেন। শুরু হয় সমন্বিত অভিযান। এরই মধ্যে আমরা কিছু দৃশ্যমান উন্নতি লক্ষ করেছি। ৬ এপ্রিল এ ধরনের সমন্বিত অভিযানের মাধ্যমে চেওসিম বম নামে কেএনএফের একজন সমন্বয়কারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যে নাথান বমের ঘনিষ্ঠদের একজন বলে জানা গেছে। অবশ্য এর আগেও এ ধরনের সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল এবং এসব অভিযানের মাধ্যমে কেএনএফকে তাদের সব ঘাঁটি থেকে বিতাড়ন করা সম্ভব হয়েছিল বলে দাবি করেছিল সেনাবাহিনী। পরে কেএনএফ শান্তি আলোচনার নামে আবার ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে শুরু করে এবং চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও লুটপাটের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে। এহেন অবস্থায় এ শান্তি আলোচনার মধ্য দিয়ে কেএনএফের তৎপরতায় লাগাম টানা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য অনেকের। প্রশ্ন থাকেÑতাহলে সমাধান কোথায়?

আমরা মনে করি চেওসিম বমের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা এবং তাদের নেতা নাথান বমের অবস্থান সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তবে যদ্দুর ধারণা করা যায়, নাথান বম বর্তমানে ভারতের মিজোরামে আত্মগোপনে রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তার বিষয়ে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করা যেতে পারে। বিষয়টি ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্যও যথেষ্ট উদ্বেগের। অতীতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ ও ভারত একে অন্যের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে এবারও যদি এ ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে তাহলে কেএনএফকে আর ছাড় না দিয়ে বরং দুই দেশের সীমান্তে ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের উত্তেজনার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করে যাওয়া জরুরি।

লেখক : অধ্যাপক

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা