× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাষ্ট্র ও সমাজ

মুক্তির দিগন্ত ক্রমসম্প্রসারমাণ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৪২ পিএম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের একদিকে রয়েছে জনমতের জয়, অন্যদিকে স্বৈরশাসনের পরাজয়। শাসক যদি অত্যাচারী হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার হাত থেকে অব্যাহতির পথটি হচ্ছে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার অপসারণ। কিন্তু যেখানে নির্বাচন হয় না, জোর করে ক্ষমতা দখল করে একদল শাসক নির্বাচনের নামে প্রহসন সৃষ্টি করে এবং নিজেদের জবরদখলকে বৈধ করে নেয়, সেখানে পরিবর্তনের আর কোনো উপায় থাকে না; পাল্টা অভ্যুত্থান ভিন্ন। জবরদখল একটি অভ্যুত্থান, গোপনে; জনগণের অভ্যুত্থানও একটি অভ্যুত্থান, প্রকাশ্যে। একটির চরিত্র ষড়যন্ত্রের, অপরটির আন্দোলনের। জবরদখল ঘটে রাজপ্রাসাদে, গণ-অভ্যুত্থান রাজপথে। এমন নজির বিশ্ব ইতিহাসে অনেক আছে।

ঊনসত্তরে একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল এই বাংলাদেশে। দেশ তখন অংশ ছিল পাকিস্তানের। শাসকরা ছিল অবাঙালি। আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেছিলেন সামরিক অভ্যুত্থানে, তিনি চলে গেলেন গণ-অভ্যুত্থানে। আরেক সামরিক শাসক এলেন, তার জায়গায়। লোক বদল হলো, শাসন বদল হলো না। লোক বদল সহজ, শাসন বদল কঠিন, কেননা শাসন বদলের সঙ্গে গোটা ব্যবস্থাটির বদল জড়িত, যেটা অত সহজে হয় না, কেবল অভ্যুত্থানে ঘটে না, তার জন্য সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন হয়। সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশ রায় দিয়েছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে। গণতন্ত্রের পক্ষে রায় আসলে স্বাধীনতার পক্ষে রায়, কেননা স্বাধীনতা ভিন্ন বাংলাদেশের জন্য স্বৈরশাসনের অবসান ঘটবে, এটা সম্ভব ছিল না।


যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আশা ছিল, স্বাধীন দেশ গণতন্ত্রের জন্য অবাধ এক ভূমিতে পরিণত হবে এবং গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে মানুষ, সব মানুষ, প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। স্বাধীনতার পর নানাভাবে একনায়কত্ব চলে এসেছে দেশে, স্বৈরশাসন জেঁকে বসেছে নানান বেশে ও ছদ্মবেশে। এরশাদ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন আওয়াজ তুলেছিল একাধিক, সব আওয়াজই জনগণের পক্ষে। যেমনÑ জনগণের সেবা করব; দুর্নীতি উৎপাটিত করা হবে; সামরিক সরকারের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। কার্যক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ বিপরীত ফল পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল বলেই ক্ষমতা দখল করা হয়েছিল; দুর্নীতি দূর করা কি, দুর্নীতি সর্বক্ষেত্রে ও অতি গভীরে ব্যাপ্ত করে দেওয়া হয়েছিল। আর জনগণের সেবা করার বিন্দুমাত্র চিহ্ন পাওয়া যায়নি কোথাও, উল্টোটা পাওয়া গেছে পুরোপুরি। মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের জন্য, জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে।

স্বাধীনতার পরে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা লুপ্ত হয়ে গেছে; গণতন্ত্র কার্যক্ষেত্রে কোথাও দেখা যায়নি এবং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য কেবল সাংবিধানিকভাবে যে পরিবর্তন করা হয়েছে তা নয়, সেই সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজকে চালিত করা হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে। বাহাত্তরের সরকার সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে বাইরে যাই বলুক, ভেতরে দ্বিধান্বিত ছিল। প্রবণতা ছিল মিশ্রণের দিকে। এই পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক নিপীড়নটা অতি কুৎসিত ও ভয়ংকর। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পুষ্ট মূল্যবোধগুলোকে যত ভাবে পারা যায় অপমান করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ধর্ম প্রবর্তন ধর্মকে আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার, বিশ্বাসহীন আধ্যাত্মিকতার চর্চা এসব শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভালো লাগেনি। ভণ্ডামি, দালালি প্রভৃতিকে যেভাবে আদর্শায়িত করা হয়েছে, তাতেও মধ্যবিত্ত আহত হয়েছে, যদিও স্বাভাবিকভাবেই এসব প্রবণতার শিকারও হয়েছে। মধ্যবিত্ত একটি পরিচ্ছন্ন জীবন চায়। সেই জীবন না পেলে ক্ষুব্ধ হয়।

মধ্যবিত্ত দেখেছে একদিকে তার জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে পড়েছে, দ্রব্যমূল্য তাকে অস্থির করেছে, ধনতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না, অন্যদিকে সে বুঝেছে কীভাবে নৈতিকভাবে (অর্থাৎ চূড়ান্ত বিচারে সাংস্কৃতিক) তাকে তার কাঙ্ক্ষিত জীবন থেকে বিচ্যুত করে অধঃপতিত করার চেষ্টা চলছে। সে দেখেছে দেশের শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত, দেখেছে যুবকদের মস্তানি ও মাদকাসক্তির নোংরা গলিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে হীনস্বার্থবাদীদের স্বার্থের ছক কঁষে, তার বিপরীতে ধনীর সন্তানরা বিদেশে চলে যাচ্ছে, তাদের জন্য ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার সুবন্দোবস্ত করা হচ্ছে। পেশাগতভাবে মধ্যবিত্ত চরিতার্থ খুঁজে পাচ্ছিল না। চাকরি করছে, কিন্তু সেখানে উন্নতি ঘটছে চাটুকারদের। বাইরের লোক এসে যাচ্ছে ওপরে, সর্বোপরি চাকরি বা চাকরির বাইরে উপার্জন তা সে যতই হোক পেশাগত সন্তোষ আনছিল না। মানুষের জন্য, যেন উপার্জনের জন্যই কাজ করা, সৃষ্টি, উদ্ভাবন বা মানুষের ভালো করার জন্য নয়। অতিবিকৃত পুঁজিবাদ আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে মানুষকে।

সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। অর্থ কিংবা সম্পদ পাচারকারীরাই সমাজে বীর হয়ে থাকছে। মধ্যবিত্তের এই প্রত্যাখ্যান যে কত গভীর ও ব্যাপক ছিল, স্বৈরশাসকেরা তা জানতেন না। তারা জানতে চাইতেন না, স্তাবকেরা জানতে দিতও না। এই প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে যোগ হয়েছিল জনগণের বিক্ষোভ। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে এই অভ্যুত্থানের পার্থক্যের দিকগুলো স্পষ্ট। ঊনসত্তরের শাসক ছিল বিদেশি। সেই অভ্যুত্থানে একটি ছদ্মবেশী সামরিক সরকারের পতন ঘটেছিল বটে, কিন্তু আবির্ভাব ঘটেছিল একটি সরাসরি সামরিক সরকারের। তবে দুইয়ের ভেতর সাদৃশ্যও তো রয়ে গেছে। সেটি এই যেÑ উভয় অভ্যুত্থানই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে। ও দুটি একসঙ্গে যায় আসলে; শহীদ নূর হোসেন ভুল বোঝেননি, সেজন্য পিঠে লিখেছেনÑ গণতন্ত্র মুক্তি পাক; বুকে লিখেছেনÑ স্বৈরাচার নিপাত যাক। ওই দুইয়ের ভেতর বুক ও পিঠের দূরত্ব এবং আসলে একই তারা।

স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঘৃণাটাই বরং প্রথমে আসে, কেননা তাকে পর্যুদস্ত না করলে গণতন্ত্র আসে না। গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত স্বৈরাচারের পতন ঘটানো। ঊনসত্তর ও নব্বই এক নয়, আবার একও; কেননা উভয়েই চেয়েছে স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের নয় শুধু, স্বৈরতন্ত্রেরই পতন ঘটেছে একাত্তরে, এ আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা দেখা গেল না। শাসক বদল হলো, কিন্তু শাসন বদল হলো না। পুরোনো রাষ্ট্র ভেঙে নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলো। কিন্তু সমাজে কোনো মৌলিক পরিবর্তন এলো না। আগে ছিল বাইশ পরিবারের শোষণ, বাংলাদেশে জন্ম হলো বাইশ নয়, শত শত ধনী পরিবারের। গরিবের নিঃস্ব হওয়া অব্যাহত থাকল, যেমন তা ছিল পাকিস্তানের কালে। এর কারণ কী? কারণ এই যেÑ আর্থসামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা সম্ভব হলো না। পুঁজিবাদের বিকাশ পাকিস্তানেও সম্ভব ছিল, বাংলাদেশে তা বিকাশের পথ বরং আরও প্রশস্ত হলো; পুঁজির অবাঙালি মালিকদের জায়গায় এলো বাঙালি মালিক।

এরশাদ সরকার ছিল ওই বিকৃত পুঁজিবাদের নিকৃষ্টতম প্রতিনিধি ও সংগঠক। শ্রেণিগতভাবে এই সরকার আগের সরকারগুলো থেকে স্বতন্ত্র নয়। যেজন্য আমরা দেখি যেÑ এর মন্ত্রীরা অনেকেই এসেছেন আগের সরকারি দলগুলো থেকে; কিন্তু এ ছিল আগের সব সরকারের তুলনায় সর্বাধিক নির্লজ্জ, বিবেকহীন ও দেশপ্রেমবর্জিত। সেজন্য দেখি নব্বইয়ের আন্দোলনে মধ্যবিত্তই প্রধান, অভ্যুত্থান মূলত তাদেরই; জয় যেটা তা তাদেরই। আগের কোনো আন্দোলনে পেশাজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীরা এত প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একযোগে পদত্যাগ করেছেন। চিকিৎসক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক প্রকাশ্য রাজপথে প্রাণ দিয়েছেন। সাংবাদিকরা সত্য সংবাদ গোপন করে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করবেন নাÑ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে দিনের পর দিন সংবাদপত্র বন্ধ রেখেছেন। শিক্ষকরা মিছিল করেছেন। আইনজীবীরা আগাগোড়া অনমনীয় ছিলেন, শেষদিকে তারা বিক্ষোভ করেছেন রাজপথে। সংস্কৃতিকর্মীরা পুলিশের হুমকি উপেক্ষা করে চলে গেছেন সামনে। মহিলারা দ্বিধা করেননি মিছিল করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে। সরকারি কর্মচারীরা বের হয়ে এসেছেন প্রশাসন ভবন ছেড়ে। সর্বোপরি ছিল ছাত্ররা। রাজনৈতিক নেতারা যা পারেননি, তারা তা পেরেছে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেছে দলীয় ভেদাভেদ ভুলে। তাদের সে ঐক্য চাপ সৃষ্টি করেছে অন্য সবার ওপর, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চাপ এবং সেই সঙ্গে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে ঐক্যের। বলাবাহুল্য, এরা সকলেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ। জনগণ ছিল। জনগণের বিক্ষোভ ছিল। তারা এসে যোগ দিচ্ছিল আন্দোলনে। এরশাদ সরকারের আসল ভয় ছিল সেখানেই।

একাত্তরেও তাই ঘটেছিল। মুক্তিযুদ্ধ অত দ্রুত শেষ হতো না যদি ইয়াহিয়া খানের বিদেশি মুরব্বিরা দেখতে পেত যে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে নেতৃত্ব চলে যাবে চরমপন্থিদের হাতে এবং সেই অবস্থায় তারা আর নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে না। শিক্ষা এটাও যে, জনমতের কাছে স্বৈরাচারী শাসকের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এই শিক্ষাও দিচ্ছে নব্বই যে, আন্দোলনের জন্য ঐক্য প্রয়োজন; প্রকৃত আন্দোলনকারীদের ঐক্য ছাড়া বিক্ষোভ ও জনমত যতই থাক, তার কার্যকর প্রকাশ অসম্ভব। আর ছিল আশা। অগণতান্ত্রিক শাসন মানুষের আশা কেড়ে নেয়, আশাহীন মানুষ দৃশ্য-অদৃশ্য নানা শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের কারণেই আবার স্বৈরশাসন দীর্ঘজীবী হয়। হতাশায় মানুষ বিদেশে পলায়ন থেকে শুরু করে পীর-ফকিরের কাছে হাজিরা দেওয়ার কোনোটাই বাকি রাখেনি। আত্মসম্মানবোধ যাচ্ছিল কমে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ছিল মানুষের সঙ্গে মানুষের। মুক্তির আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক। কেননা মুক্তির দিগন্ত ক্রমসম্প্রসারমাণ।

  • ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা