× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত

মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার চাপে-তাপে নতুন বৈশ্বিক সংকট

ড. ফরিদুল আলম

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৪২ পিএম

ড. ফরিদুল আলম

ড. ফরিদুল আলম

বর্তমান বিশ্ব বহুমুখী সংকটে নিপতিত। রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের বহুমাত্রিক বৈরী প্রভাব বিশ্বরাজনীতি-অর্থনীতিতে স্পষ্ট দৃশ্যমান। এরই মধ্যে সৃষ্টি হলো মধ্যপ্রাচ্যে সংকট, যে সংকটে বদলে যাচ্ছে বিশ্বরাজনীতির সমীকরণ। মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনা ক্রমেই গভীর হচ্ছে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ ওই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে এবং তাতে এ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর নীরব-সরব সমীকরণও চলছে। ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয় এবং ইরানি দূতাবাসের অ্যানেক্স ভবন ধ্বংস হয়। হামলায় আইআরজিসির (ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড) সাত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নিহত হন। এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে তেহরান। বদলা হিসেবে ১৩ এপ্রিল রাতভর ইসরায়েলে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান।

তেহরানের তথ্য অনুসারে, তিন শতাধিক ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। বহুদিনের বৈরিতা থাকলেও এই প্রথমবার সরাসরি ইসরায়েলে হামলা চালাল ইরান। এ হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি পশ্চিমা দেশ সহায়তা করলেও পালটা জবাব না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। বিশেষত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করলেও দেশটিকে আপাতত নিশ্চুপ থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ও বিশ্বের অন্যত্রও বহু দেশই কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছে। উল্লেখ্য, এর মধ্যে এমন অনেক দেশও আছে যারা ইরানের সরকারকে ঘোর অপছন্দ করে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনীতি নতুন মোড় নিচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকেই পঞ্চম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের শঙ্কাও প্রকাশ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন হামাস-ইসরায়েল সংঘাত এবার নতুন মোড় নিয়েছে, যার পরিণতি বিশ্বরাজনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু নয়।


গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালায় ইসরায়েল এবং এর মধ্য দিয়ে নতুন মোড় নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সিরিয়ার বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে শতাধিক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী, যা তারা নিজেরা সদম্ভে স্বীকারও করেছে। ইসরায়েলের এই খবরদারির বিরুদ্ধে ইরান মাঝেমধ্যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেও সরাসরি ইসরায়েলে হামলা করেনি। কিন্তু কনস্যুলেট আক্রান্ত হওয়ার পর ৭২ ঘণ্টা আগে ঘোষণা দিয়ে ১৩ এপ্রিল প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের ভূখণ্ডে সরাসরি তিন শতাধিক ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে তারা। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের দূত হামলার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জানিয়েছেন, তাদের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং তারা সেটিই করেছে। গত বছরের অক্টোবরে হামাস ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে পাঁচ হাজারের বেশি মিসাইল নিক্ষেপ করে। হামাস ইসরায়েলের নাগরিকদেরও জিম্মি করে। এই ঘটনায় জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে ইসরায়েল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে তাণ্ডব চালায়। বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি গাজা উপত্যকায় যেন উন্মুক্ত এক কারাগারে বন্দি রয়েছে। ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায় ইসরায়েল। শুধু পশ্চিমাদের কূটনীতি ও সামরিক শক্তির জালই নয়, ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর বিভক্তিও ফিলিস্তিন ইস্যুকে জটিল করে তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে, দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার পর ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির এই তাৎক্ষণিক পাল্টা প্রকাশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বাধ্য করছে বিশ্বরাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে।

মধ্যপ্রাচ্যের গোটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর তাৎক্ষণিক পালটা আক্রমণকে পশ্চিমা সম্প্রদায়ের অনেকেই সমর্থন করেছিল। ইরানের ক্ষেত্রেও একইভাবে তা সমর্থনযোগ্য। কারণ, ১ এপ্রিল ইরানের কনস্যুলেটে হামলা দেশটির সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়। এমন প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের হামলা তাদের দম্ভের এক প্রকার বহিঃপ্রকাশ। ইরান প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের দম্ভের পালটা জবাব দিয়েছে, যা এক দিক থেকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে ইসরায়েলকে সতর্ক করে হোয়াইট হাউস তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ইসরায়েল এই মুহূর্তে কোনো পালটা হামলা চালালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই অংশ নেবে না। যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই এই সংঘাতে জড়াতে চায় না, এও তারা স্পষ্ট জানিয়েছে।

পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের অশান্তি বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের অনুমান করছেন। এক্ষেত্রে ইসরায়েলের অবস্থান পরিণতির রেখা টেনে দিতে পারে। ইসরায়েল যদি পালটা জবাব দেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিপর্যয়ের দিকে চলে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এই মুহূর্তে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর নির্ভর করছে। তবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রবণতা অনেকটাই স্পষ্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এর হার্ডলে পোস্টে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমরা প্রতিহত করেছি, হটিয়ে দিয়েছি, আমরা জয়ী হব’। ওই পোস্টে তিনি প্রতিশোধ্মূলক কোনো বার্তাই দেননি। তবে তিনি যে প্রতিশোধ নেবেন তা অনেকটা স্পষ্ট। উগ্র জাতীয়তাবাদী ধর্মপন্থি নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর নানা ধরনের চাপ ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে নেতানিয়াহুর অবস্থান কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের যে নাগরিকদের জিম্মি করা হয়েছিল তাদের অনেকেই মারা গেছেন, এমন খবর পাওয়া গেছে। হামাসের জিম্মি থেকে ইসরায়েলের নাগরিকদের উদ্ধার করতে না পারা কিংবা সংকটের সমঝোতা করতে না পারার জন্য দেশটির নাগরিকরাও ক্ষুব্ধ।

ইসরায়েলকে এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক প্রতিক্রিয়ার আহ্বান জানানোর প্রেক্ষাপটও বিচার-বিশ্লেষণ করা জরুরি। আমরা জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। জো বাইডেনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে। এই নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কী হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, তিনি অফিসে থাকলে ইরান ইসরায়েলে হামলার সাহস পেত না। অর্থাৎ তিনি কট্টরভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করেন। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে অংশ নেয়, তাহলে গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ওপর নেমে আসবে বড় বিপর্যয়। একই সঙ্গে ইরানের সঙ্গে তাদের সংঘাত ঘটলে ইরান একাই এখানে সক্রিয় থাকবে এমনটি নয়। আমরা জানি, চীন ও রাশিয়া পরোক্ষভাবে ইরানকে সমর্থন দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সহযোগী পশ্চিমা দেশগুলো এ বিষয় সম্পর্কে অবগত। চীন ও রাশিয়া এই মুহূর্তে নিশ্চুপ রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া সরাসরি মধ্যপ্রাচ্য সংকটে কোনো ভূমিকা রাখছে না।

চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নানা সংকটের কারণেও তারা নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে যদি ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সরাসরি সংঘাত শুরু হয় তাহলে চীন ও রাশিয়ার যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। আর যখন মাল্টিপোলার বিশ্বের এই শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে, তখন তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে এবং তা বিশ্বরাজনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবেÑ এমন শঙ্কাও রয়েছে অনেকের, যা অমূলক বলা যাবে না। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশ যেমন সৌদি আরব, আরব আমিরাত, লেবানন, জর্ডান নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। আর এই সংঘাতের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়েনি বিধায় তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে তেল ও খনিজ সরবরাহের অন্যতম মাধ্যম। এই মুহূর্তে বিশ্ববাণিজ্য ও তেলের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তবে অনেকে আশঙ্কা করছেন, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে আমাদের বিরাট শ্রমবাজার সংকটের মুখে পড়বে। তবে এখনও এমন শঙ্কার কোনো কারণ আছে বলে মনে করছিনা।

আমাদের শ্রমবাজারের বড় একটি অংশ বাহরাইন, সৌদি আরব, দুবাই, ওমান, জর্ডানসহ কয়েকটি দেশে রয়েছে। এই দেশগুলোতে এখনও ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের তাপ-চাপ ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু ইরান-ইসরায়েলের সরাসরি সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার নতুন সমীকরণের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি পশ্চিমা সম্প্রদায়ের অবস্থান থেকে নতুন প্রেক্ষাপটের অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে। কারণ পশ্চিমা সম্প্রদায় ইসরায়েলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিলেও এই মুহূর্তে ইরানে পালটা আক্রমণ না করার পরামর্শই দিচ্ছে। তবে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির স্পষ্ট সমীকরণ এ মুহূর্তে করা কিছুটা কঠিন। এখন দেখার বিষয়, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কীভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি রূপদান করেন।

  • রাজনীতি ও কূটনীতি বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা