× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মানবিক কাজের কাণ্ডারি একদল তরুণ

গোলাম কিবরিয়া

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:২০ পিএম

আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:০২ পিএম

সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে সামাজিক সংগঠন কাণ্ডারি                                                                 ছবি: কাণ্ডারি

সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে সামাজিক সংগঠন কাণ্ডারি ছবি: কাণ্ডারি

'ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে কেউ সাহায্য চাইতে এসে, আমি কখনওই খালি হাতে যেতে দেখি নাই। তাই ছোট থেকে এই ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করব। মা কে সব সময় বলতাম একটা শেল্টার থাকবে, রাস্তার সব পশুদের রাখব, ট্রিটমেন্ট করব। আরেকটা শেল্টার থাকবে যেখানে এতিম বাচ্চারা থাকবে পড়াশোনা করবে, আর থাকবে অসহায় বৃদ্ধরা।' কথাগুলো বলছিলেন কাণ্ডারি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও আফসারা তাসনীম আলভী। 

সামাজিক সংগঠন 'কাণ্ডারি' বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা আলভী বলেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার উপলব্ধি হয় চর এবং পাহাড়ি অঞ্চলের শিশুদের নিয়ে। আমি নিজে পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরতে যেয়ে দেখেছি সেখানকার শিক্ষার অবস্থা উন্নত নয়। আমাদের বাড়িতে দেখেছি অনেক মেয়েরা কাজের জন্য আসত দক্ষিণ অঞ্চল থেকে যাদের খুব কম বয়সেই বিয়ে হয়ে গেছে।'

করোনা মহামারিতে পৃথিবী যখন থমকে গেছে তখন কাণ্ডারি অসহায় মানুষের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছে। সে সময়ের কথা স্মরণ করে আলভী বলেন, কোভিডে পুরো পৃথিবী যখন থেমে গেছে তখন আমার পুরো পরিবার কোভিড-১৯ আক্রান্ত। দেশের বাইরে ভিন্ন স্টেটে থাকার কারণে আমি তাদের কাছ থেকে দেখতে পারিনি। সব কিছু মিলিয়ে অনেক খারাপ একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন চিন্তা হলো এত উন্নত একটা দেশে মানুষ মারা যাচ্ছে এভাবে, তাহলে আমাদের দেশে কী হবে? চিন্তা করলাম কিছু একটা করা দরকার। আমার খুব কাছের একটা বন্ধুকে আর আমার কাজিনকে জানাই, ওরা অনেক উৎসাহ দেয়। সাথে আমার মেজ খালা আর খালুকে জানাই, তারা আমাদের উৎসাহিত করেন, এবং নানাভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন, করে যাচ্ছেন। আমরা ঠিক করি ফুড বক্স দিব মধ্যবিত্ত পরিবারদের। আর এভাবে আমাদের যাত্রা শুরু। পুরোটা ওভার নাইট ডিসিশন, আমাদের তখন নাম, লোগো কিছুই ঠিক হয়নি। শুধু একটা চিন্তা ছিল মানুষের জন্য কিছু করার। একটু বলে রাখি, কাণ্ডারি নামটা আমার আম্মুর দেওয়া। আমরা যখন কাজ শুরু করি, আম্মু অনেক অসুস্থ করোনাতে, আম্মুর কথা বলার কোনো ক্ষমতা ছিল না। কাজ শুরু করার কিছুদিন পরে যখন আম্মুকে জানাই আমার কাজের কথা তখন উনি আমাদের নাম দেন কাণ্ডারি। 

করোনার সময় কীভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত কাণ্ডারি? এমন প্রশ্নের উত্তরে আলভী বলেন, করোনার সময় অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ চাকরি হারিয়েছে, অনেকে সোশ্যাল স্ট্যাটাসের জন্য মানুষের কাছে লজ্জাই চাইতে পারে নাই। আমি যেহেতু মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসছি, আমি একটু হলেও কষ্টটা বুঝি। তাই আমরা ঢাকার মধ্যে কিছু পরিবারের খোঁজ নিলাম এবং তাদের বাসার সামনে যেয়ে বক্স রেখে আসত আমাদের টিম। আমরা তাদের কথা দিয়েছিলাম তাদের ছবি কখনও যাবে না সোশ্যাল মিডিয়াতে। আমাদের প্রজেক্টের নাম ছিল- 'A Thought for food'. যতদিন কাণ্ডারি আছে আমাদের এই প্রজেক্ট চলমান থাকবে।' 

সংগঠনের শুরু হয়েছিল ৪ জন দিয়ে, বর্তমানে ২০ জন সদস্য। এছাড়া কাজের ক্ষেত্র বিশেষে ভলেন্টিয়ার থাকে কাণ্ডারির। বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি সংগঠনটির দেলুটি স্কুলের কাজ চলেছে। এছাড়া শীতের সময় উত্তরাঞ্চলে গিয়ে তারা কম্বল দিয়ে থাকে। এর সঙ্গে যোগ করে আলভী বলেন, ২০২১ সালে আমাদের দেলুটি স্কুলের পাশাপাশি দৈ খাওয়া চরের স্কুলের কাজ চলেছে। পাশাপাশি আমরা ঈদে ২টা প্রজেক্ট করি, ইফতারি করাই ঢাকাতে ও  ঈদের বাজার করে দেওয়া হয় কুষ্টিয়া এবং যশোরের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে। ২০২১ সালে আমরা ১ টাকার সেমাইয়ের কাজ করেছি যশোরে। ১ টাকায় সেমাই দিয়েছি আর  যে অনুদান সংগ্রহ  হয়েছিল তা দিয়ে এতিম বাচ্চাকে ঈদের পাঞ্জাবি কিনে দেওয়া হয়। 

গত বছর সিলেটে হওয়া বন্যায় আমরা ত্রাণ দিয়েছি ৬০ ‘র বেশি পরিবারকে। পাশাপাশি মেডিকেল ক্যাম্প ও কাপড় বিতরণ করা হয় কাণ্ডারির পক্ষ থেকে। আমাদের পিরিয়ড স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে প্রজেক্ট 'কিশোরী জানালা'র অধীন বন্যাকবলিত এলাকাতে আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিন দিয়েছি। আমাদের এই সময় ভলেন্টিয়ার সার্ভিস দিয়েছে হেল্পিং হ্যান্ডসহ আরও একটি ভলেন্টিয়ার গ্রুপ। আলভী জানালেন নতুন বছর কাণ্ডারি শুরু করতে চায় তাদের স্কুলের বাচ্চাদের জন্য নতুন পোশাক উপহার দেওয়ার মাধ্যমে। 

প্রজেক্ট পাঠশালা 

প্রজেক্ট পাঠশালার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে চর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে শিক্ষার মান উন্নত করা। প্রজেক্ট পাঠশালার আওতায় কাণ্ডারির ২টি স্কুল রয়েছে। একটি অবস্থিত কুড়িগ্রামের একটি ছোট চরে অন্যটি অবস্থিত পাইকগাছার দেলুটি গ্রামে, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে। 

দৈ খাওয়া চর স্কুলটি আশপাশের ৫-৬টি চরের মধ্যে ১টি মাত্র স্কুল। তাই সব ছেলে মেয়েকে এখানে আসতে হয় ট্রলারে করে। স্কুলটিতে ১৮০ জন ছাত্রছাত্রী আছে, তার মধ্যে ১৩০ জন মেয়ে। বন্যাকবলিত এলাকা তাই প্রতি বছর স্কুলে পানি ওঠে। যার ফলে বেঞ্চ, আসবাবপত্রের ক্ষতিসাধন হয়। প্রজেক্ট পাঠশালার আওতায় স্কুলটির জন্য সংগঠনটি একটি ট্রলার বানিয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেন বিনামূল্যে স্কুলে আসতে পারে। ট্রলারের খরচ উঠানোর জন্যে বাকিটা সময় যাত্রী আনা নেওয়া করে। 

দেলুটি স্কুলটি অবস্থিত সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে, যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে অঞ্চলটির ক্ষতি হয়। প্রতিষ্ঠাতা আলভী বলেন, আম্ফানে স্কুলটি ভেঙে যাওয়ার পর যখন আমরা খোঁজ পায় তখন বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে আমাদের যেতে সময় লেগেছিল ১ সপ্তাহ। নদীপথ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই স্কুলটিতে যাওয়ার। ফান্ড তুলে কাজ শুরু করতে সময় লেগেছিল ৮ মাস, অনেকের কাছে হাস্যকর লেগেছিল যে আমরা চর অঞ্চলে স্কুল করব। আজকে আমাদের স্কুলে ৩টি ক্লাসরুম, একটি লাইব্রেরি, সাথে ৩০০'র বেশি বই, ২টি কম্পিউটার দিয়েছি আমরা। স্কুলটি আমাদের পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছে। এখানে বাচ্চারা প্রত্যেকবার জিপিএ ৫ পায়। শতভাগ পাস থাকে প্রত্যেক বছরও বৃত্তি পায়।

নতুন কার্যক্রম নিয়ে আলভী বলেন, আমরা এই বছর শিশুদের স্কুল পোশাক দেওয়ার চেষ্টা করছি।  ক্যাম্পেইন চলছে অনুদান সংগ্রহের। একটা নতুন বছরে নতুন ইউনিফর্ম অনেক বড় একটা পরিবর্তন আনে একটা শিশুর জীবনে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনেকেরই পোশাক ও স্কুল ব্যাগ নেই। কারণ কেনার মতো অর্থ তাদের পরিবারের নেই। অনেকে খালি পায়ে, না খেয়ে স্কুলে আসে। তাদের জন্য আমাদের ছোট্ট একটি প্রচেষ্টা। 

কাণ্ডারি নিয়ে নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে আলভী বলেন, অনুভূতিটা আসলে এক কথায়  বলে বুঝানোর মতো না। আমি কখনও কল্পনা করিনি আমার একটা সামান্য উদ্যোগে এত বড় ভালো কিছু হবে। যখন কাণ্ডারি শুরু করি, আমার কোনো ফান্ড ছিল না, আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি ৮ মাস হয়েছে। কাণ্ডারি আমাকে আশা দিয়েছে কিছু করার। 

অনেক কটু কথা শোনা লেগেছে, এখনও অনেকে বলে থাকে, আমি বাইরে থাকি, দেশে থাকি না তাই দেশের পরিস্থিতি আমি বুঝি না, আকাশ কুসুম চিন্তা করি। আর শুনতে হয়েছে, এভাবে কত দিন চালাব আমরা, আমাদের কোনো ডোনার নেই। দেলুটি স্কুল নিয়ে কেন পড়ে আছি, সম্ভব না কিছু করার। আমি মনে করি রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আসে না, পরিবর্তনের শুরুতে কখনও কেউ পাশে থাকবে না। দেলুটি স্কুল করার সময় কাণ্ডারির বয়স ছিল মাত্র ৩ মাস। আমাদের টিম মেম্বাররা প্রথমে এই বিষয়টা সাপোর্ট করেনি। কিন্তু আজকে আমরা স্কুলটা তৈরি করে ফেলেছি, বাচ্চারা স্কুলে আসছে, গ্রামের মানুষের বিশ্বাসটা আমরা ধীরে ধীরে অর্জন করেছি। 

এর সঙ্গে তিনি আরও যোগ করে বলেন, সব কিছু সম্ভব হয়েছে কাণ্ডারির হার না মানা টিমের কারণে। আমরা একটা পরিবারের মতো সবাই, সবার কষ্টে সুখে আমরা একসঙ্গে থাকি। স্কুলের একজন শিক্ষক নীলাঞ্জনা বলেন, আমাদের স্কুল ছিল না, আমরা খুব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু কাণ্ডারি ভাইয়ারা আর আলভী আপুর কারণে আমাদের স্কুল হয়েছে, আমাদের বাচ্চাদের আবার পড়াতে পারছি, লাইব্রেরি হয়েছে, বাচ্চারা পড়ছে, আমরা খুবই আনন্দিত।

আরেক শিক্ষক পবিত্র মণ্ডল বলেন, আমরা আশাহত হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের প্রধান শিক্ষক, আর কাণ্ডারির কারণে আমাদের স্কুলটা ফিরে পেয়েছি। স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক মনোজ কুমার বলেন, কাণ্ডারি বলতে বোঝায় যারা হাল ধরে। ঠিক এ কাজটিই যেন করেছে সংগঠনটি। অকূলে কূল দেখিয়েছে। আজকে ছেলে মেয়েরা আবার পড়াশোনা করতে পারছে শুধু তাদের জন্য।

বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী সুস্মিতা সরকার বলেন, আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাই। আমি যা জানি তা শেখাতে চাই। আমাদের জাতি যদি শিক্ষিত হয় তবেই উন্নতি সাধন করতে পারবে। কিন্তু সাইক্লোন আম্ফান আমাদের কাছ থেকে স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিল, আমরা আশা হারিয়েছিলাম। কাণ্ডারির ভাই বোনেরা আমাদের স্বপ্ন ফিরিয়ে দিয়েছেন।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা