ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৩ ১১:৩১ এএম
আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২৩ ১২:১৩ পিএম
ফাইল ছবি
সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, চুক্তিতে নিয়োগ কিংবা পদায়নে রাজনৈতিক তদবির থেমে নেইে। এক্ষেত্রে আইনে বিধিনিষেধ থাকলেও মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। আইনের তোয়াক্কাই করছেন না তারা। তদবিরে তারা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
আর কয়েক মাস পর বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। এ কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের ডিও লেটার জমা হচ্ছে। কোনো কোনো মন্ত্রী স্বপ্রণোদিত হয়ে তার পছন্দের কর্মকর্তাকে অবসর শেষে চুক্তি কিংবা কর্মরত কোনো কর্মকর্তাকে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের জন্য অনুরোধ জানিয়েও ডিও লেটার দিচ্ছেন।
ডিও লেটারগুলো সংরক্ষণ করতে অনেকটা ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। আবার ডিও লেটারকে কার্যকর করার জন্য মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যকে দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কেউ কেউ জোর তদবির করাচ্ছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এসব ঘটনা সম্পূর্ণ চাকরিবিধির লঙ্ঘন। সরকারি আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে প্রভাব খাটাতে পারেন না। তারপরও কেউ কোনো তোয়াক্কা করছেন না। কারণ অতীতেও সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে পদোন্নতি, চুক্তি ও পদায়ন নিয়েছেন। এই রেওয়াজের ধারাবাহিকতা রয়েছে। এ কারণে প্রশাসনের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এ ছাড়া ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে প্রভাব খাটাতে পারেন না। বিধিমালার ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত কোনো দাবির সমর্থনে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সরকার বা কোনো সরকারি কর্মচারীর ওপর রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বহিঃপ্রভাব খাটাইতে বা খাটাইবার চেষ্টা করিতে পারিবেন না।’
একই আইনে তদবির করার জন্য সংসদ সদস্যদের কাছে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আইনটির ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী কোনো ব্যাপারে তাহার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুরোধ জানাইতে পারিবেন না।’
১৯৫৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জারি করা এক স্মারকেও কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের কাছে তদবির করতে পারবেন না বলে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
পদোন্নতিবঞ্চিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও মর্যাদাপূর্ণ পদগুলোতে পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্য কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিগত কয়েক বছর ধরে অব্যাহত এ ঘটনায় জনসেবাকে মুখ্য না মেনে তদবিরেই ভরসা রাখছেন। যে কারণে তারা নিজেদের পদোন্নতি এবং পদায়নে প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। অনেকটা নিরুপায় হয়ে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরাও বিধি লঙ্ঘন করে তাদের পক্ষে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের কাছে ডিও লেটার দিচ্ছেন। তদবিরের মাধ্যমে পদোন্নতি ও পদায়ন পাওয়ায় জনসেবায় প্রাধান্য না দিয়ে তদবিরকারীদের খুশি করতেই ব্যস্ত থাকছেন। তাই কর্মচারীদের পক্ষে তদবির আইনত নিষিদ্ধ হলেও মানছেন না তদবিরকারীরা।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এজন্য নির্বাচনের আগেই তাদের সুপারিশ তথা পছন্দের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবদের পদোন্নতি ও পদায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিবকে ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনে পদোন্নতি দিতে যখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ শুরু করা হয়, তখনই জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর কাছে ডিও লেটার আসা শুরু হয়। এটা অতীতে যেমন হয়েছে, এবারও তার ব্যতিক্রম নেই বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, পদোন্নতি, ও পদায়ন রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয় না। যারা যোগ্য তাদের পদোন্নতিতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। এ ছাড়া কারিগরিসহ বিশেষ পারদর্শী এমন কর্মকর্তাদের ক্ষেত্র বিশেষে চুক্তিও দেওয়া হয়। তবে ঢালাও নয়। তিনি আরও বলেন, যদি কোনো কর্মকর্তার পক্ষে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীরা ডিও লেটার দেন, তাহলে সেটা সংরক্ষণ করা হয়। তাই বলে সেটি কার্যকর হবেÑ এমন বাধ্যবাধকতা নেই।
সূত্র জানায়, জনপ্রশাসনে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি কার্যক্রম শুরু হলেই ডিও লেটারের ছড়াছড়ি দেখা যায়। পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে জনপ্রশাসনমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কাছে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কাছ থেকে ডিও লেটার আসতে থাকেÑ সচিব থেকে শুরু করে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের পদোন্নতি নিয়ে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন পেতেও কর্মকর্তারা ডিও লেটারের পেছনে ছুটছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর-অধিদপ্তরে পদায়ন পেতে ডিও লেটার যেন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। ডিওর চাপে জনপ্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা অনেকটাই বিরক্ত।
সম্প্রতি বেশ কজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ডিও লেটারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও বদলির জন্য তদবির করেছেন।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (উপসচিব) মো. নুরুল আমিনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিতে সুপারিশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
সুপারিশের তালিকায় আছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সাইফুল ইসলামকে যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিতে সুপারিশ করেছেন।
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন তার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত উপসচিব পদে কর্মরত মো. মোমিনুর রশীদকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছেন।
অতিরিক্ত সচিব এস এ মাহাবুবুর রহমানকে সচিব পদে পদোন্নতি দিতে তদবির করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মাদারীপুর-২ আসনের এমপি শাজাহান খান।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিমের পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করেছেন। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের কাছে লেখা ডিও লেটারে বলা হয়েছে, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড-১ ভুক্ত পদ। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিসিএস ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি এখানে আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। যেহেতু ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি গ্রেড-১ ভুক্ত, সে কারণে তাকে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দেওয়া হলে তার কর্মস্পৃহা বাড়বে এবং কাজে গতিশীলতা আসবে।
চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (ছেলুন) শিল্প মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে কর্মরত মো. মনিরুজ্জামানকে যুগ্ম সচিব করার জন্য জোর সুপারিশ করেছেন।
তদবিরের তালিকায় বদলি আদেশ বাতিলের সুপারিশও আছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোশাররফ হোসেনকে সম্প্রতি অন্য জায়গায় বদলি করা হয়। এই আদেশ বাতিলের জন্য সুপারিশ করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগে এমপি-মন্ত্রী কিংবা সচিবের কাছে ডিও লেটারের জন্য ধরনা দিলে সেটি স্পষ্টতই বিধিমালার লঙ্ঘন। কারণ তারা নিজেদের পদোন্নতি, পদায়ন কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কাউকে দিয়ে সুপারিশ করাতে পারেন না। যদি কেউ নিজের স্বার্থে ডিও লেটার নেন, তাহলে সেটি যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এ ধরনের ডিও লেটার দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। চাকরিবিধি অনুযায়ী অনৈতিক। কর্মকর্তার মনে রাখা উচিতÑ ডিও লেটারের কারণে ভবিষ্যতে তার কর্মজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই দায়িত্ব কিন্তু কেউ নেবে না।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘ডিও লেটাররীতি প্রশাসনের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এটি বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে। তবে ওই নির্দেশনায় উল্লেখ থাকতে হবে, কেউ ডিও লেটার আনলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ এভাবে ডিও লেটারের রীতি যদি অব্যাহত থাকে, সেক্ষেত্রে যারা ডিও লেটার সংগ্রহ করতে পারবেন না, তাদের কি পদোন্নতি হবে না?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর ড. মুসলেহ উদ্দীন আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের পক্ষে যেসব মন্ত্রী বা এমপি তদবির করছেন, তারা আইন লঙ্ঘন করছেন।’