বাছির জামাল
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৪২ এএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:০১ এএম
ফাইল ফটো
সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের এক দফা দাবিতে বিএনপির চলমান আন্দোলন অনেকটাই হোঁচট খেয়েছে। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো যেসব কর্মসূচি পালন করেছে তা সরকারকে চাপে ফেলতে পারেনি। বরং বিএনপির কর্মসূচির সময় ধারাবাহিকভাবে পাল্টা কর্মসূচি চালিয়ে দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রেখেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
চলতি বছরের ১২ জুলাই এক দফার যৌথ ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে নামে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো। ২৮ জুলাই রাজধানীতে এ দলের মহাসমাবেশ আশান্বিত করে তোলে নেতাকর্মীদের। কিন্তু পরদিন ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোয় ‘সংঘর্ষপূর্ণ’ অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আর বাড়াতে পারেনি বিএনপি। এ ঘটনার পর আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও হতাশা দেখা দিয়েছে।
হতাশার নেপথ্যে
এরই মধ্যে গত ১ সেপ্টেম্বর দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর পূর্ণ করেছে। এমন এক সময়ে বিএনপি তার এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করল, যখন তারা প্রায় ১৭ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে। বিএনপির নেতারা মনে করেন, আবার ক্ষমতায় ফিরতে আগামী সংসদ নির্বাচন তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকলে তাদের পক্ষে ভোটে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য তারা চাইছেন, সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার।
এমন প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন বিস্তারের ব্যর্থতায় বিএনপির তৃণমূলে একধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছেÑ প্রথমত অবস্থান কর্মসূচি শেষে প্রায় ১২ দিনের বিরতির পর পদযাত্রা, গণমিছিল নিয়ে এক দফার কর্মসূচিতে ফিরলেও সরকারকে চাপে ফেলতে পারে, এমন কোনো কার্যকর কর্মসূচি এখনও বিএনপি নিতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে বিএনপি ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে ঘিরে আগ্রহী কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রকে দিয়ে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে। কিন্তু বিদেশি কোনো রাষ্ট্রই এখনও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মন্তব্য করেনি। বিশেষত এ দুটি কারণে বিএনপি সরকারের ওপর কোনো কার্যকর চাপ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। ফলে আন্দোলনের মাধ্যমে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ ঘটানোর মতো অবস্থাও সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না।
যা বলছেন বিএনপি নেতারা
এ প্রসঙ্গে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলা বিএনপির সদস্য ও ১০ নং ছাতিয়াইন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিনহাজ উদ্দিন চৌধুরী কাসেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারকে গদিচ্যুত করতে গেলে ‘বিপ্লব’ প্রয়োজন। কঠোর কর্মসূচির প্রয়োজন। এটা করতে গেলে নতুন করে মামলা-মোকদ্দমা দেওয়া শুরু হবেÑ যা এখনও অনেক নেতাকর্মীর নামে আছে।’ তিনি বলেন, ‘যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ অবস্থানে না থাকে, তাহলে মাঠের আন্দোলন দিয়ে কতটুকু সাফল্য পাওয়া যাবে?’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও অনেকটা হতাশার সুরেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এখনও কেন গণ-অভ্যুত্থান হচ্ছে না?’ সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগের দিন রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া কারও মানবাধিকার নেই। সাম্প্রতিক সব ঘটনাই দেশের মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কেন এখনও গণ-অভ্যুত্থান হচ্ছে না? পরিবর্তন আনতে হলে বড় রকমের ঝাঁকুনি-সংগ্রাম দরকার। সে সংগ্রামে আমরা আছি। কিন্তু তা যথেষ্ট কি না, তা এখনই চিন্তা করতে হবে। সুনামির মতো অভ্যুত্থান ছাড়া এই দানবকে সরানো সম্ভব না।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির খুলনার নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘২৮ জুলাই মহাসমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যের পর নেতাকর্মীরা নতুন কর্মসূচির জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এখনও তেমন কর্মসূচি আসছে না। এজন্য তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘এখনই তো শক্ত কর্মসূচির সময়। অক্টোবরের আগেই আমাদের দাবির ফয়সালা করতে হবে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই এ নিয়ে ভাবছেন।’
নির্বাচনের প্রস্তুতিতে কমিশন
এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান জানিয়েছেন, আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি গত ২ সেপ্টেম্বর আগারগাঁওয়ে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বলেন, ‘আমরা এখনও ভোটগ্রহণের কোনো তারিখ ঠিক করিনি। তবে আজকের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল।’
এর আগে গত ৩০ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের জানান, আগামী অক্টোবর মাসে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। বিএনপি চায়, এর আগেই তাদের এক দফা দাবি নিয়ে ফয়সালা করতে। দলটি তাই চলতি সেপ্টেম্বরেই ব্যাপক আন্দোলনে যাওয়ার চিন্তা করছে। এমন প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তারা পদত্যাগ করে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবেন না। এ কারণে দাবি মানানোর জন্য আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প রাস্তা নেই বিএনপির কাছে।
‘তৃণমূলকে হতাশামুক্ত করবে নতুন কর্মসূচি’
এমন প্রেক্ষাপটে নেতাকর্মীদের হতাশামুক্ত করতে নতুন কর্মসূচি প্রণয়নে গত শনিবার রাতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ বৈঠকে বেশিরভাগ নেতাই সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকার পতনের আন্দোলনকে সফল করার পক্ষে মত দেন। চলমান আন্দোলনকে সফল করতে আদালত, সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দেওয়া নিয়েও আলোচনা হয় এ বৈঠকে। তবে কোনো অবস্থাতেই হঠকারী কোনো কর্মসূচি দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন তারা।
গতকাল সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এক দফার যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা শেষে আগামী শুক্রবারের দিকে নতুন কর্মসূচি আসতে পারে।
বিএনপির মিত্র জোট গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাাদক সাইফুল হক বলেন, ৬ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের বৈঠক রয়েছে। এর পরই বিএনপির সঙ্গে বৈঠক হবে। সেই বৈঠকে নতুন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হবে। যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি সামনের সপ্তাহে আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিপক্ষ কোনো রাজনৈতিক দল হলে রাজনীতির ধরন একরকম হয়। আর প্রতিপক্ষ যদি রেজিম হয়, যারা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করছে, দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেÑ সেটা খুব কঠিন অবস্থা। আমরা এখন এই অবস্থার মুখোমুখি। একে প্রতিরোধ করার অধিকার সব নাগরিকেরই আছে।’
দলটির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘আজকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপির আন্দোলনে শুধু দেশের ১৮ কোটি মানুষই নয়, সারা পৃথিবীর সমর্থন আছে। জনগণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দাবি আদায় করব।’
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, নতুন কর্মসূচি দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হতাশা ও সংশয় দূর করে তাদের উজ্জীব্তি করে তুলবে।