জয়পুরহাট প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৪ ২০:৪৩ পিএম
আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৪ ২০:৫৭ পিএম
রুবেলকে নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে মুক্তিপণের জন্য ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে।
পরনে সাদা শার্ট ও নীল প্যান্ট। দুই পা কাপড় দিয়ে বাঁধার পর পায়ের নিচ দিয়ে বাঁধা হয়েছে দুই হাতও। একইভাবে বাঁধা হয়েছে মুখও। এ অবস্থাতেই চলছে চড়-থাপ্পড়। নির্যাতনে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন যুবক। তখনও চলে লাঠি দিয়ে মারধর। এমনভাবে নির্যাতন করায় ওই যুবক যেন আকুতি-মিনতি করতে চাইলেও পারলেন না। শুধুই গোঙানির শব্দ।
ভিডিওটিতে মুক্তিপণের জন্য এমন নির্যাতনের শিকার ওই যুবক বগুড়ার গাবতলী উপজেলার রামেশ্বপুর ইউনিয়নের নিশুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রুবেল হোসেন। থাকেন লিবিয়ায়।
সেখানে তাকে নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে মুক্তিপণের জন্য ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। চার দিন আগে পাঠানো ভিডিওতে নির্যাতনের শিকার রুবেলের চেহারা স্পষ্ট দেখা গেলেও নির্যাতনকারীর চেহারা দেখা যাচ্ছিল না। মুক্তিপণের টাকা না পাঠানোর কারণে এখনও রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি তার পরিবার।
রুবেলের স্ত্রীর বড় বোন আক্তারুনের বাড়ি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তেমারিয়া গ্রামে। রুবেলকে লিবিয়ায় পাঠানো দালাল মিজানুর রহমান ওরফে ধলুর বাড়িও তেমারিয়া গ্রামে।
জানা যায়, আক্তারুন তার ভগ্নিপতি রুবেলকে গ্রামের দালাল মিজানুর ও তার বাবা আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিয়েছিলেন। এরপর রুবেল নিজেই মিজানুরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন লিবিয়ায় যেতে। এজন্য রুবেল তার জমি বিক্রি করে প্রায় ৪ লাখ টাকা মিজানুরের স্বজনদের হাতে দেন। এরপর গত জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে রুবেল লিবিয়ায় পাড়ি জমান। এখন সেখানকার একটি শহরের অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করা হচ্ছে। মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে দশ লাখ টাকা।
আক্তারুন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘দালাল মিজানুর রুবেলকে লিবিয়ায় নিয়ে বসিয়ে রেখেছিলেন। রুবেলকে ভালো কাজ দেওয়ার কথা বলে ১০ দিন আগে লিবিয়ার আরেকটি জায়গায় নিয়ে যায়। তারা সেখানে রুবেলকে আটকে রেখে মারধর করছে। অচেনা কণ্ঠের একজন বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে আমাকে কল করে রুবেলের মুক্তিপণের জন্য ১০ লাখ টাকা চেয়েছেন। এ ছাড়া রুবেলকে মেরে ফেলবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। ভিডিও পাঠানোর পর লিবিয়ায় থাকা দালাল মিজানুরের কাছে ফোন করে তাকে পাইনি। মিজানুরের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বাবাকে বলেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভিডিও পাঠানোর পর মুক্তিপণ চাওয়ার সময় সাইড থেকে রুবেল বলছিল, টাকা পাঠাও, টাকা পাঠাও, নইলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। জমিজমা বিক্রি করে রুবেল লিবিয়া গেছে। আমার বোন তাহেরা ঢাকায় থাকে। এখন ১০ লাখ টাকা কোথায় পাব? এখন পর্যন্ত রুবেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। কোথায় গেলে রুবেলকে মুক্ত করতে পারব, তা ভেবে পাচ্ছি না।’
এদিকে দালাল মিজানুরের প্রতিবেশীরা জানায়, মিজানুর সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে কয়েক বছর থাকার পর দেশে ফিরে গ্রামে মাছ চাষ ও মুরগির খামার করেন। দেড় বছর আগে লিবিয়ায় চলে যান। এরপর লিবিয়ায় লোক নেওয়া শুরু করেন মিজানুর। তার বাবা আব্দুর রহমান ও ছোট ভাই শাহিন ঘুরে-ঘুরে লিবিয়ায় পাঠানোর জন্য লোক খুঁজতেন। লিবিয়ায় চট্টগ্রামের চার তরুণকে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন স্থানের লোক মিজানুরদের বাড়িতে আসতে শুরু করে। এরপর শুক্রবার (২৯ মার্চ) সকালে বাড়ির মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে অন্যত্র চলে যান মিজানুরের মা-বাবা ও ভাই।
গোপীনাথপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী সদস্য মোছা. ফজিলাতুন নেছা তেমারিয়া গ্রামের বাসিন্দা। মিজানুর রহমান তার প্রতিবেশী হন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে ফজিলাতুন নেছা বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে মিজানুরের খোঁজে লোকজন বাড়িতে আসছে। এই ভয়ে মিজানুরের পরিবারের মা-বাব, স্ত্রী-ছেলে ও ছোট ভাই কেউ বাড়িতে নেই। মিজানুর আগে বিদেশে ছিল। বাড়িতে আসার পর মাছ ও মুরগির খামার করত। এসব করতে গিয়ে তার ঋণ হয়। পরে মিজানুর লিবিয়ায় যায়। সেখানে অনেক মানুষকে নিয়ে গেছে। এখন শুনছি মিজানুর লিবিয়ায় লোকজনদের আটকে মুক্তিপণ চাচ্ছে।’
সম্প্রতি লিবিয়ায় চট্টগ্রামের আনোয়ারার চার তরুণকে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে একইভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার ওই তরুণদের মুখেও জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তেমারিয়া গ্রামের এই লিবিয়াপ্রবাসী মিজানুর রহমানের নাম এসেছে।