আন্তর্জাতিক নারী দিবস
ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩ ১২:৪৩ পিএম
সংগৃহীত ছবি
আগামীকাল বুধবার (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ডিজিটাল বিশ্বকে নিরাপদ, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত করার প্রত্যয়ে এবার নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। ফাইভজি প্রযুক্তি ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যাত্রায় নারীকে সমান অংশীদার করতেই এমন প্রতিপাদ্য বেছে নিয়েছে জাতিসংঘের নারীর ক্ষমতায়নবিষয়ক সংস্থা ইউএন ওমেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আনুষ্ঠানিকতায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এবারের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী প্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং পাকাপোক্ত করতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; সামনে চলে এসেছে সেই প্রশ্নটি। উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যাচ্ছে, বহু প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিজেদের চেষ্টায় আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যুক্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের নজিরও স্থাপন করে চলেছেন তারা। কিন্তু সরকারি সুবিধা ও সহযোগিতার অপ্রতুলতা এবং সমাজের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও নারীর পদে পদে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেমের সঙ্গে। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, নারীদের জন্য প্রযুক্তিতে বহুদিক উন্মোচিত হলেও তা কাজে লাগানোর জন্যও সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, পরিবার থেকেও প্রতিবন্ধকতা আসে। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনতার সংকটের কারণে প্রযুক্তি নিয়েও পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নারীরা অনেক পিছিয়ে আছেন।
এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্যটিকে তাই সময়োপযোগী বলে মনে করছেন মহিলা পরিষদের সভাপতি। তবে প্রযুক্তিগত কর্মকাণ্ডে নারীর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বৈষম্যহীন-মানবিক প্রযুক্তি নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি নারীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
একই সঙ্গে নারীর জন্য প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করার কথাও বলেছেন তিনি। অন্যথায় বিষয়টি হিতে বিপরীত হবে বলে সতর্ক করে ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীদের প্রযুক্তিতে দক্ষ না করে নতুন নতুন আবিষ্কারকে গ্রহণ করলেই হবে না। গার্মেন্টসে অটোমেশন পদ্ধতি আসার কারণে অনেক নারী কর্মহীন হয়েছে। আবার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যার কোনো বিচার হচ্ছে না। আইনের শাসন না থাকলে প্রযুক্তি উল্টো বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যে অবস্থান বাংলাদেশের নারীদের
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গত এক দশকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ রীতিমতো হতাশাজনক। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস-বেসিসের সমীক্ষা বলছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এখন নারীর অংশগ্রহণ ১৬ শতাংশের মতো, কয়েক বছর আগেও তা ছিল ১২-১৩ শতাংশের মধ্যে। বেসিসের বাইরে এ খাতে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২ শতাংশে পৌঁছেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দেশে এখনও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর ভূমিকা কল সেন্টারেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করা হয়। আর সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ বা গেমস ডেভেলপমেন্ট ও রোবোটিক্সের মতো কাজগুলোকে ভাবা হয় ছেলেদের উপযোগী। অথচ প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণে সমতা আনতে হলে এসব ক্ষেত্রেও তাদের যুক্ত করতেই হবে।
এ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল জানান, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পেশাদার (আইটি প্রফেশনাল) কিংবা একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের কাজটি তিনি বেশ ভালোভাবে করার পরও তাকে তুলনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, একজন নারী হিসেবে তিনি ভালো করছেন। অনেক পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে ভালো কাজ করার পরও এ ধরনের তুলনা শুনতে হয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক লাফিফা। তার মতে, নারীরা কোনো কাজ যত উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে থাকেন; তাকে তত বেশি প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়।
ঢাবির এই শিক্ষক বলেন, মাধ্যমিকে অনেক মেয়েকে বিজ্ঞান পড়তে দেখা গেলেও পরবর্তীকালে সেই ধারাবাহিকতা পাওয়া যায় না। উচ্চপর্য়ায়ে পৌঁছানোর আগেই তারা ঝরে পড়ে। তবে আশার বিষয়, এখন সেই প্রবণতা কমছে। মেয়েরা নেতৃত্ব দিচ্ছে, বড় বড় স্বীকৃতিও পাচ্ছে।
বৈষম্যের আরও নজির তুলে ধরলেন ওমেন ইন ডিজিটাল সফটওয়্যার লিমিটেডের প্রধান আছিয়া নীলা। তিনি বললেন, আগে তিনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন; একটা সময় দেখা গেল সেখানকার সব প্রজেক্টের টিম লিডার তিনি। সফটওয়্যার ডেভেলপ থেকে শুরু মার্কেটিং পর্যন্ত সব কাজই করেছেন। কিন্তু কোথাও তার নাম ব্যবহার হচ্ছিল না। এমনকি বছরের পর বছর পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধিও হয়নি তার। স্বীকৃতি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সেই চাকরি ছেড়ে নিজেই প্রতিষ্ঠান খুলেছেন নীলা। মোহাম্মদপুরে তার প্রতিষ্ঠানে শুধু মেয়েরাই চাকরি করেন। নীলার দাবি, মেধা ও যোগ্যতায় মেয়েরা কোনো অংশ ছেলেদের চেয়ে কম নন।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম ‘ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্সের’ (উই) প্রতিষ্ঠাতা নাছিমা নিশা জানান, র্ব্তমানে এ খাতে প্রায় ৬ লাখ নারী কাজ করছেন। এ কাজে নারীদের বেশ আগ্রহ রয়েছে। তারা নানা স্বপ্ন নিয়ে এ কাজে যুক্ত হচ্ছেন। পড়াশোনা অন্য বিষয়ে হওয়ার পরও সেই আগ্রহের জায়গা থেকেই প্রযুক্তি খাতে যুক্ত হয়েছেন নিশা।
এত প্রতিবন্ধকতার পরও আশাবাদী হওয়ার মতো তথ্য জানালেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের সভাপতি ওয়াহিদ শরীফ। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, শুরুতে নারীদের যুক্ত করা কঠিন হলেও আউটসোর্সিংয়ের কাজে (বিপিও ইন্ডাস্ট্রি) ৪০ শতাংশের মতো নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। পুরুষের চেয়ে এ কাজে কর্মী হিসেবে নারীদের ভূমিকাও সন্তোষজনক। তাদের কাজে লেগে থাকার স্পৃহা বেশি এবং ঘন ঘন চাকরি পাল্টানোর প্রবণতা কম। কিন্তু সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা তাদের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটা মেয়ে রাতে অফিসে কাজ করবে, সে বিষয়টি এখনও অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিতেই পারেন না। তাই রাত্রিকালীন সময়ে কাজের জন্য নারীকর্মী পাওয়া ভীষণ কঠিন।
ই-কমার্স খাতের সংগঠন ‘ই-ক্যাব’-এর সভাপতি শমী কায়সার বলেন, তাদের সংগঠনের ১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি উদ্যোক্তা রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশেই নারী। তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীদের আগ্রহ বেশি। কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে পদে পদে তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। নারীদের দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ দিলে তাদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।
নারী দিবসের ইতিহাস
১৯১০ সালে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন এটিকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। ডেনমার্কে ১৭টি দেশ থেকে আসা ১০০ নারীকর্মীর সম্মেলনে এই প্রস্তাব পাস হয়।
১৯১১ সালের ১৯ মার্চ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘের হিসাবমতে, সেদিন ১০ লাখ নারী-পুরুষ এই র্যালিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের দাবি ছিল, নারীদের জন্য ভোটাধিকার, কর্মাধিকার, পেশাগত প্রশিক্ষণ ও কর্মস্থলে লিঙ্গবৈষম্যের ইতি টানা।
১৯১১ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে মার্চের বিভিন্ন দিনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার নারীরা ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ (জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটি ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি) প্রবল খাদ্য সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে ‘রুটি ও শান্তি’ নামে আন্দোলনে নামেন।
এর কয়েক দিন পরই জারের রাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয় এবং পরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর নারীদের ভোটাধিকার দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই বিশ্বজুড়ে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়।