স্বাধীনতার মাস
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৮ পিএম
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৮ পিএম
পঞ্চগড়ের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম। ছবি: সংগৃহীত
পঞ্চগড় জেলার একমাত্র নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাবার অনুপ্রেরণা ও বড় ভাইয়ের দেওয়া সাহসে অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ তাকে সবচেয়ে বেশি উজ্জীবিত করেছিল। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন তিনি।
এই নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে ৭১-এর সেই বীরত্বগাথা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন।
রোকেয়া বেগম বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু হলে মেজোভাই নাসিদুল ইসলামসহ গ্রামের অনেকেই যুদ্ধে চলে যান। এরপর থেকে ভাইয়ের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সবাই ভেবেছিল, ভাই হয়তো শহীদ হয়েছেন। ছেলে হারানোর শোকে আমার মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তবে তখনও বাবার মনোবল দৃঢ় ছিল। তিনিই আমাকে যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন।’
একাত্তরের ৭ এপ্রিল বড় ভাই আব্বাস আলীর সহযোগিতায় যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন রোকেয়া বেগম। তিনি জানান, পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের অনেকেই বাঁকা বলেছেন। বাধা দিয়েছেন। নারী হওয়ায় গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি। কিন্তু তাতেও তিনি পিছপা হননি।
প্রথমেই যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভুষপিটা ক্যাম্পের শরণার্থী শিবিরে। সেখানে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া ছোট ছোট শিশুদের তিনি পাঠদান করাতেন। হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে ডায়রিয়া, খোসপাঁচড়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ সময় রোকেয়া চিকিৎসকদের কাছে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতেন। পরে তিনি ভুষপিটা থেকে কান্তাই ভিটা ক্যাম্পে যান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় অস্থায়ী ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে সেবিকা নিয়োগের খবর পেয়ে দেশে ছুটে আসেন রোকেয়া বেগম। বয়স কম হওয়ার কারণে প্রথমে তিনি বাদ পড়েন। পরে অনেক অনুরোধে তিনি সেবিকা হিসেবে নিয়োগ পান।
রোকেয়া বেগম বলেন, ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের সেবিকা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তেঁতুলিয়ার পর পঞ্চগড়ে যাই। এরপর ঠাকুরগাঁও টিবি হাসপাতাল ও ইপিআই হেডকোয়ার্টার হাসপাতালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী বাঙালিদের সেবা দিয়েছি। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কখনও ক্যাম্পে, কখনও হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদানের সুযোগ পেয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৬ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এমকে বাশার, ৬ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও ডা. আতিয়ার রহমানের অধীনে থেকে তেঁতুলিয়ায় সেবিকা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন রোকেয়া বেগম। যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ, আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতেন তিনি। ফেলে আসা সেই সব দিনের স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেননি রোকেয়া। কত কষ্ট, কত বেদনা, কত নির্মমতা দেখেছেন তিনি। স্বাধীনতাপাগল মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে কোনো কুণ্ঠাবোধ ছিল না তার।
রোকেয়া বলেন, ‘শুধু চিকিৎসাসেবা দিইনি। কোনো কোনো দিন মুক্তি বাহিনীকে রান্না করে খাইয়েছি। অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে যেতে পারিনি। কিন্তু জীবন বাজি রেখে সব সময় মুক্তি বাহিনীর পাশে ছিলাম। ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় হানাদারমুক্ত হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে আসি।’
যে ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর কাঁদিয়েছিল রোকেয়ার পরিবারকে, সেই মেজোভাই নাসিদুল ইসলাম দেশ স্বাধীনের পর বাড়িতে ফিরে আসেন। সেদিন পরিবারের সবাই অবাক হয়েছিল নাসিদুলের ফিরে আসায়। পরে পঞ্চগড় সুগার মিলে কিছুদিন চাকরির পর ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান নাসিদুল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমি এখন কোনো কাজ করতে পারি না। আমি বয়সের ভারে নানা সমস্যায় ভুগছি। আমি যে ভাতা পাচ্ছি, তা দিয়ে আমার চিকিৎসা, সংসারের খরচসহ যাবতীয় কাজ চলছে। সরকার যদি আমাকে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে শেষ বয়সে আমি একটু শান্তিতে থাকতে পারতাম।’
রোকেয়া বেগম দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন সুগার মিলে। বর্তমানে চাকরি থেকে অবসরে গেলেও এখনও অবসর ভাতার টাকা পাননি। তবে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়েই চলছে ৬৭ বছর বয়সি রোকেয়ার জীবন। একমাত্র মেয়ে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে থাকেন জয়পুরহাটে।
রোকেয়া বেগম জানান, সময় পেলেই বিভিন্ন জাতীয় দিবসে আশপাশের বিদ্যালয়গুলোতে যান। সেখানে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে ভালো লাগে। সবার মাঝে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে ভালো লাগে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্তরে সবাই লালন করুক, এটাই তার একমাত্র চাওয়া।
মেয়ে রুবিনা খাতুন বলেন, ‘আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি, আমার মা একজন মুক্তিযোদ্ধা।’
পঞ্চগড় জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন প্রধান বলেন, ‘পঞ্চগড় মুক্ত হয় ২৯ নভেম্বর। সেই দিনটি আমাদের কাছে যেমন আনন্দের আবার কষ্টের। অনেক সহযোদ্ধা হারিয়েছি আমরা। আমাদের জেলার একমাত্র নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে একজন সেবিকা হয়ে যুদ্ধাহত, আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। চিকিৎসাসেবা দিয়ে কষ্টের দিনে তিনি পাশে ছিলেন।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগমের বাড়ি তেঁতুলিয়া উপজেলার তিরনইহাট ইউনিয়নের মুনিগছ গ্রামে। তিনি ওই এলাকার আব্দুর রহিম (প্রয়াত) ও ছমিরন নেছার মেয়ে। বর্তমানে তিনি জেলা শহরের মিলগেট এলাকায় থাকেন।