× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সাক্ষাৎকার

আমার সাফল্য তারা নিতে পারত না, হিংসা করত

আপন তারিক

প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৩ ১২:১২ পিএম

আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৩ ১৭:২০ পিএম

বাংলাদেশের প্রথম নারী রেফারি হিসেবে এএফসির এলিট প্যানেল ও সহকারী রেফারি প্যানেলে যুক্ত হয়েছেন সালমা আক্তার মনি। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রথম নারী রেফারি হিসেবে এএফসির এলিট প্যানেল ও সহকারী রেফারি প্যানেলে যুক্ত হয়েছেন সালমা আক্তার মনি। ছবি : সংগৃহীত

দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী সবাই নারী। বাংলাদেশের নারীর অগ্রযাত্রা এখন বিশ্ব উদাহরণ। সর্বক্ষেত্রেই এগিয়ে চলেছেন নারীরা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এদেশে বিভিন্ন খাতে নেতৃত্বদানকারী প্রথম নারীদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রতিদিনের বাংলাদেশ। সাক্ষাৎকারে তুলে আনার চেষ্টা করেছে তাদের সংগ্রামী জীবনকাহিনি। আজ তৃতীয় পর্ব

ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম নারী রেফারি হিসেবে এএফসির এলিট প্যানেল ও সহকারী রেফারি প্যানেলে যুক্ত হয়েছেন সালমা আক্তার মনি। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করে গড়েন নতুন ইতিহাস। ২০১৩ সালে রেফারিং ক্যারিয়ার শুরু করেন। ২০২১ সালে হয়েছেন ফিফার সহকারী রেফারি। এবার আন্তর্জাতিক রেফারির স্বীকৃতিও পেলেন নেত্রকোণার এই নারী। দেশের মুখ উজ্জ্বল করা এই নারী রেফারির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আপন তারিক

প্রবা: শুরুতেই আপনাকে অভিনন্দন। ক্রীড়াঙ্গনে আপনার পা রাখার শুরুর দিকের গল্পটা শুনতে চাইছি...

সালমা আক্তার মনি: ২০০৮ সালে আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন হাইজাম্পে জাতীয় পুরস্কার পাই। তারপর থেকেই শুরু। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন নেত্রকোণাতে এক কোচের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেসময় আমাদের ওখানে মেয়েরা খুব একটা অনুশীলন করত না। ওই কোচ আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি কিছু গাইডলাইন দিয়েছিলেন-বাসায় কীভাবে প্র্যাকটিস করব। আমি তখন সেটা মেনে বাসায় অনুশীলন করতাম। কিন্তু মন ভরত না, মাঠে অনুশীলন করতে চাচ্ছিলাম। বাসায় ঠিকঠাক হচ্ছিল না। তাই রাতে অনুশীলন করতাম—রাত ৩টা বা সাড়ে ৩টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত অনুশীলন করতাম। তিন বছর এমনভাবে অনুশীলন চালিয়েছি।

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি—সেসময় প্রথমবার স্টেডিয়ামে অনুশীলন করি। আমার আগে কেউ মাঠে অনুশীলন করতে যায়নি। ফুটবলও আমার পছন্দের ছিল, খেলার শখও জাগত। যেহেতু অ্যাথলেটিকস নিয়ে কাজ করতাম, তাই ওদিকে এগোতাম না। খেলাটি সম্পর্কে ধারণা ছিল না। তখন আমি হ্যান্ডবল অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলছি। কাবাডির ন্যাশনাল ক্যাম্পও করেছি। তিনটি খেলা খেলতাম—হ্যান্ডবল, কাবাডি ও অ্যাথলেটিকস। 

দেশে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করে নতুন ইতিহাস গড়েন সালমা 


প্রবা: তাহলে শুরুতে ফুটবল ছিল না...

সালমা আক্তার মনি: না, তেমনটা নয়। আমার বাবা ও ভাই ফুটবল খুব পছন্দ করতেন। আমার বড় ভাই ফুটবল খেলতেন। ভাই ও আমি রাত তিনটায় উঠে রাস্তায় অনুশীলন করতাম। আমি ফুটবলও খেলতে চাইছিলাম। কিন্তু তেমন সুবিধা পাচ্ছিলাম না। কিছু মেয়ে ছিল ইন্টার স্কুল খেলত, তারপর শেষ! আমি ময়মনসিংহের হয়ে ডিভিশন খেলেছি। এরপর আর সুযোগ হয়নি। ঢাকায় আসারও সুযোগ ছিল না। আমার একজন কোচ ছিলেন-ওনার বাসা আমার বাসার কাছেই ছিল, নেত্রকোণাতে। ওই কোচ আমাকে বললেন, যেহেতু এখানে তেমন মেয়েরা ফুটবল খেলে না। তুমি যদি চাও তাহলে ফুটবল রেফারিং কোর্স করতে পার। আমাদের ওখান থেকে অনেকে  শেখে। কিছুদিন পর আমাকে খবর দেওয়া হয়, ঢাকাতে ম্যাচ করার জন্য। ঢাকায় এসে ম্যাচ করি। প্রথমে আমি শ্রীলঙ্কাতে যাই ২০১৩ সালে। পরে ঢাকাতেই ম্যাচ করতাম। মাঝে একটা ঝামেলা হলো, বলতে পারেন, প্রতিবন্ধকতার কারণে রেফারিং করা ছেড়ে দিই। দেড় বছর রেফারিং করিনি।

প্রবা: একজন নারী হিসেবে ফুটবলে রেফারিং করা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ ছিল। এই সাহস বা আগ্রহ কীভাবে এলো?

সালমা আক্তার মনি: যেহেতু ফুটবল পছন্দ করতাম এবং খেলতাম, তাই মনে সব সময় সাহস ছিল। কিন্তু মাঠে সিদ্ধান্ত দেওয়া শুনে অনেকে তেড়ে আসেন। প্রথম প্রথম নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু পরে কাটিয়ে উঠেছি। প্রথম দেড় বছর কিছুটা ভয় হতো। পরে আলহামদুলিল্লাহ আমি পেরেছি।

প্রবা: বলেছিলেন প্রতিবন্ধকতার কথা, আসলে লড়াইটা কীসের বা কাদের বিরুদ্ধে ছিল?

সালমা আক্তার মনি: আমি যখন রেফারিংয়ে আসি, তখন অনেকেই সাহায্য করেছিলেন। পড়াশোনাও ঢাকাতে ছিল। তবে কিছু মানুষ আমাকে নিতে পারছিল না। তাদের আচরণ স্পষ্ট ছিল। সাফল্য তারা নিতে পারত না, হিংসা করত। বলত, সালমা এমন কাজ কেন করে? বেশিরভাগ নেতিবাচক কথা। যেগুলো ঢাকাতে এসে শুরু হয় ২০১৬ সালে। আমি তখন প্রায় তিন বছর রেফারিং করি। এমন নেতিবাচক কথাগুলো শুনে ভেঙে পড়ি। সিদ্ধান্ত নিই আর রেফারিং করব না। তখন টোটালি রেফারিং ছেড়ে দিই। 

প্রবা: মানুষের কথা শুনে রেফারিং ছেড়ে দেন। সমালোচনা নিতে পারছিলেন না। তখন পরিবারকে পাশে পেয়েছিলেন?

সালমা আক্তার মনি: শুরু থেকেই তারা সমর্থন করত। আমার একাডেমিক রেজাল্টও ভালো ছিল। এ কারণেই হয়তো কোথাও হেরে গেলেও সাহস জোগাত। কখনও দ্বিতীয় বা তৃতীয় হলে তারা পাশে থাকত। ওনারা আমাকে মানিয়ে নেওয়া শিখিয়েছিলেন, সাপোর্ট করেছিলেন। 

প্রবা: আপনার ভাইয়ের কথা বলছিলেন...

সালমা আক্তার মনি: ভাই আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছে। রাতে একটা মেয়ে অনুশীলন করবে- এটা তো সমস্যা। তো আমার যেহেতু বড় ভাই ছিল না। তখন সে আমার সঙ্গে যেত। সেও পড়াশোনা করত, ফুটবলও খেলত। তিন বছর আমরা রাতে অনুশীলন করেছি। 

বাংলাদেশের প্রথম নারী রেফারি হিসেবে এএফসির এলিট প্যানেলে যুক্ত হয়েছেন সালমা


প্রবা: পরিবারের সমর্থন যেমন পেয়েছেন, নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েও আপনি টিকে আছেন। রেফারিংয়ের মতো পেশায় আপনি আছেন। এটা আপনার জন্য আর্থিক দিক থেকে কতটা স্বস্তির?

সালমা আক্তার মনি: সত্যি বলতে রেফারিংকে আপনি পেশা হিসেবে নিতে পারবেন না। আমি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি করি। তার পাশাপাশি রেফারিং করি। সত্যি বলতে, এটাকে ফুলটাইম নিয়ে চলা যাবে না। রেফারিং করে আপনার লাইফ সেটেল হবে যাবে- এটা ভাবা বোকামি। 

প্রবা: আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের সাম্য তেমনভাবে তৈরি হয়নি, পারিশ্রমিকের দিক থেকেও। ক্রীড়াঙ্গনে আরও বেশি লক্ষ্য করা যায় এটা। নারী-পুরুষের সাম্য কতটা জরুরি বলে মনে করেন।

সালমা আক্তার মনি: দেখুন, আমাদের দেশে নারী আর পুরুষের পারিশ্রমিকের পার্থক্যটা অনেক। সাম্য অবশ্যই জরুরি। কেননা, মাঠে পরিশ্রমটা তো দুজনেই সমান করে। সেক্ষেত্রে আমি পারিশ্রমিক কম পাব কেন?

প্রবা: এই ব্যবধানটা কেন তৈরি হলো, আপনার কাছে কী মনে হয়?

সালমা আক্তার মনি: আগে তো আরও কম ছিল। শুরু থেকে ক্রীড়াক্ষেত্রে মেয়েদের তো খুব একটা সাফল্য ছিল না। এখন অনেকটা পাল্টেছে সে চিত্র। সাফল্যও পাচ্ছে মেয়েরা। তবে মেয়েরা ক্রীড়াক্ষেত্রে দেরিতে আসাতেই ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সামাজিক অবস্থা।

প্রবা: আপনি তো একজন সফল নারী। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা করছেন। আপনার কী মনে হয়- একজন নারীকে সফল হতে হলে কী গুণ থাকা চাই...

সালমা আক্তার মনি: যোগ্যতা বলতে আগে নিজেকে তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি পারিবারিক সমর্থন তো অবশ্যই লাগবে। আপনাকে সৎ হতে হবে। নিয়ম মেনে চলতে হবে। সাধনা করতে হবে। কষ্ট করতে হবে। চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। প্রতিবন্ধকতাকে এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কে কী বলল না বলল সেসব এড়িয়ে চলতে হবে। আর পড়াশোনা করতে হবে।

প্রবা: পড়াশোনার কথা বলছিলেন। আপনাদের তো রেফারিংয়ের জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়..

সালমা আক্তার মনি: জবের পাশাপাশি, অনুশীলনের পাশাপাশি সময় বের করে, ১০ মিনিট হোক ২০ মিনিট হোক সময় দিই আমি। যদি আমি কিছু বুঝতে না পারি সেগুলো সিনিয়রদের কাছ থেকে জেনে নিই। আমার পরিশ্রমটা অন্যরকম। ৮ ঘণ্টা অফিস করে বাসায় এসে নিজের কাজ নিজে করি। তারপর আবার নিয়মমাফিক অনুশীলন করি। নিয়ম করে খাওয়াদাওয়া করি, ঘুমাই। আমার সবকিছুই নিয়মের মধ্যে চলে। শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাতে হবে। যখন এই কষ্টের মধ্য দিয়ে সাফল্য আসবে, তখন এই কষ্টকে কষ্ট মনে হবে না।

প্রবা: যেসব নারী রেফারিংয়ে আসতে চায় বা খেলায় আসতে চায় বা অন্য খেলায় নাম লেখাতে চায়, তাদের উদ্দেশে কী বলবেন?

সালমা আক্তার মনি: যে-ই আসতে চায়- ছেলে হোক, মেয়ে হোক- চাপ নিতে হবে। রেফারিংয়ে এলে বড় একটা চাপ নিতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। কী পাব- সেটা না ভেবে লড়ে যেতে হবে। তাহলে একসময় সাফল্য ধরা দেবেই।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা