রাশেদুল হাসান
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৩ ১২:৩৮ পিএম
আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৭ পিএম
ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও ধুঁকছে নারী বাস সার্ভিস। ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) কয়েকটি বাস নারীদের পরিবহনসেবায় নিয়োজিত রয়েছে। সকালে অফিস সময় ও বিকালে ফেরার পথে শুধু নারীরা এই সেবা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এই বাস কোন রুটে, কখন চলে তার সঠিক তথ্য জানেন না রাজধানীতে বসবাসকারী বেশিরভাগ নারী। এ তথ্যের ঘাটতি ও সেবার প্রতি করপোরেশন যত্নশীল না হওয়ায় জনবহুল ঢাকায় ডুবতে বসেছে নারীবান্ধব এ পরিবহনসেবা।
জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে বিআরটিসির উদ্যোগে দেশে প্রথম পরীক্ষামূলক মহিলা বাস সার্ভিস চালু হয়। ২০০১ সালে তা ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়। ২০০৯ সালে আবার এই সেবাকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ২০১৫ সালেও এ সেবায় ১২টি বাস ছিল। বর্তমানে ৭টি রুটে ৭টি বাস চলছে। কয়েকটি বাস থাকলেও যাত্রী কম। কোনো কোনো রুটে ব্যাপকসংখ্যক যাত্রী থাকলেও বাসের পরিমাণ কম। সব কয়টি রুটেই বাস থেকে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরে যে নারী বাস সার্ভিস আছে, তা বেশিরভাগ নারীই জানেন না। কারণ এর কোনো প্রচার নেই। বাস চালু রেখে তথ্য প্রচার না করা কোনো দায়িত্বশীল আচরণ নয়। ঢাকা শহরের শুধু নারীদের বাসসেবায় কোনো ধাক্কাধাক্কি নেই। সেখানে যাত্রী না থাকাটা বাস্তবতার পরিপন্থি। যে বাসে শৃঙ্খলা নেই, সময়সূচি নেই, আপনি যাত্রী পাবেন কই। প্রতিটা রুটে ২০ মিনিট অন্তর বাস ছাড়লে দেখবেন লাভও হবে, যাত্রীও আসবে। সারাদিনই নারীদের বিশেষ বাস সার্ভিস চালু রাখা উচিত।
বিআরটিসির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বাস সার্ভিসে মোট পাঁচটি রুটে পাঁচটি বাস চলে। কিন্তু কখন আসে, কখন যায়-- তার কোনো সময়সীমা দেওয়া নেই। নেই কোনো চালক কিংবা তার সহকারীর যোগাযোগ নম্বর। বিআরটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) শুকদেব ঢালীর সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী মোট সাতটি বাস চলে ঢাকা শহরে।
রূপনগর-আগারগাঁও-ফার্মগেট থেকে মতিঝিল রুটের বাস সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে রূপনগর আবাসিক এলাকা মোড় থেকে ছাড়ে। আর খিলগাঁও-তালতলা-মুগদা-সচিবালয়-রুটের গাড়ি তালতলা থেকে ছেড়ে আসে সকাল ৮টায়। তবে এ তালিকা অনুসরণ করে কোনো নারী যদি বাসে যাত্রী হতে চান, তাহলে তাকে পড়তে হবে ভোগান্তিতে। সরেজমিন পরিদর্শন করে চালক ও ডিপো ম্যানেজারের কাছ থেকে জানা যায়, রূপনগর-মতিঝিল রুটের গাড়িটি রূপনগর থেকে ছাড়ে ৭টা ৪০ মিনিটে। আর খিলগাঁও-তালতলা-মতিঝিল রুটের বাসের চালক ও ইয়ার্ড ইনচার্জ জানান, নারীদের বিশেষ বাসটি ছাড়ে ৮টা ৪০ মিনিটে। এ গাড়ির ফিরতি যাত্রার কথা লেখা আছে সচিবালয় থেকে বেলা ৩টা ১০ মিনিটে, কিন্তু বাস্তবে গাড়ি ছাড়ে বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটে। খোদ প্রধান কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যেই আছে হাজারো গরমিল অর্থাৎ কর্মকর্তারাই জানেন না কখন ছাড়ে কখন যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিসির মতিঝিল ডিপোর এক কর্মচারী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আসলে বাসের চালক ও হেলপাররাই ঠিক করেন বাস কখন কীভাবে চলবে। সকালবেলা বের হওয়ার সময় এ বাস আর নারীদের বাস থাকে না, হয়ে যায় সবার বাস। নারীদের পৌঁছে দিয়ে চালকরা আবার ট্রিপ মারেন। চালকদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ডিপোতে জমা দিতে হয়। বাকিটা চালক-হেলপাররা পকেটে ভরেন। বিআরটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) শুকদেব ঢালী বলেন, মনে হয় এ সময়সূচি আগের। এটা আপডেট হতে পারে। এটা ডিপো ম্যানেজাররা করে থাকেন। তাদের ফোন করে জেনে নিন।
ভোগান্তি রূপনগর-মতিঝিল রুটে, বাস বাড়ানোর দাবি
বিআরটিসির সাতটি বাসের একটি চলে রূপনগর-মিরপুর ১০-আগারগাঁও-মতিঝিল রুটে। গত সোমবার সকালে এ বাসের পরিস্থিতি দেখতে প্রতিবেদক সকাল ৭টা ৫৫ মিনিটে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে ওঠেন এ বাসে। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে শ্যাওড়াপাড়া পর্যন্ত যেতেই পুরো বাস ভর্তি হয়ে যায় যাত্রীতে। তালতলা যেতে তিলধারণের ঠাঁই থাকে না। বাসে বসেই কথা হয় যাত্রীদের সঙ্গে। নাজমা আক্তার নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, তিনি এ বাসে যাতায়াত করেন ১০ বছর ধরে। ওঠেন মিরপুর ১০ থেকে আর নামেন সংসদ ভবনের কাছে। যাত্রীরা বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়েই যান। অসুবিধা হলো শনিবার বাসটা বন্ধ থাকে, আমাদের অফিস কিন্তু বন্ধ থাকে না। আবার বিকালে আসার সময় বাস পান না। সকাল ৬টার দিকে বের হন, আর বিকালের বাস ৫টা ৩০ মিনিটের দিকেই চলে যায়। জুলহাস নামে এক বাসচালক জানান, প্রতিদিন ১ হাজার ৭৫০ টাকা জমা দিতে হয় ডিপোতে। মাঝেমধ্যে যাত্রীই থাকে না।
বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমি যখন চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিই, এসে দেখি বাস একটাও ভালোভাবে চলে না। আমি উদ্যোগ নিয়ে আবার চালু করি।
পস মেশিন থাকতেও যাত্রীর হিসাব নেই, লসেই চলছে এ সেবা
বিআরটিসির প্রতি বাসে ভাড়া আদায়ের টিকিট দেওয়ার জন্য আছে পয়েন্টস অব সেলস মেশিন (পস), কিন্তু প্রতিদিন কী পরিমাণ যাত্রী ও ভাড়া আদায় হয়, তা জানার সুযোগ থাকলেও এ বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল বাস ডিপোর কোনো কর্মকর্তা তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ তথ্য সংরক্ষণ নেই বলে জানান কর্মকর্তারা। এ ডিপোর দেওয়া তথ্যমতে, মহিলা বাস সার্ভিসে নিয়োজিত তিন বাস লসেই চলছে।
বিআরটিসির মতিঝিল ডিপোর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, গত জানুয়ারি মাসে নতুন বাজার-কোকাকোলা-মতিঝিল রুটে নারীসেবায় নিয়োজিত ঢাকা ব-১১-৬১০৫ বাসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আয়, আর ব্যয় ১ লাখ ৬১ হাজার। এতে আর্থিক ক্ষতি হয় ৪১ হাজার টাকা। বনশ্রী-রামপুরা-রাজউক অ্যাভিনিউ রুটে ঢাকা ব-১১-৬০৪০ বাসে রাজস্ব আয় ৬৯ হাজার ৮৫০, আর ব্যয় ১ লাখ ২ হাজার ২২৮ টাকা। এতে ক্ষতি হয় অন্তত ৩২ হাজার টাকা। আর তালতলা-মুগদা-সচিবালয় রুটে ঢাকা ব-১১-৬১২০ বাসে রাজস্ব সংগ্রহ ৮৪ হাজার ৭৫০, ব্যয় ৯৫ হাজার ১৪৯ টাকা। এতে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি ১০ হাজারেরও বেশি। যাত্রী উপচেপড়া রূপনগর-মতিঝিল রুটেও দিতে হয় ভর্তুকি।