প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৩ ০৯:৩৫ এএম
দেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক সালমা খাতুন।
যারা ট্রেন চালান তাদেরকে বলা হয় লোকো মাস্টার। চাকরির ধরন অনুযায়ী লোকো মাস্টারের কাজটি কঠিন কাজ। কারণ তার জিম্মায় থাকে একটি ট্রেনের হাজারো যাত্রীর নিরাপত্তা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাসে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কোনো নারী এ পদে ছিলেন না। এ পদে প্রথম নারী হলেন টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরের মেয়ে সালমা খাতুন। ব্যক্তিজীবনে অদম্য সাহসী এ নারীর জীবনের পথচলার গল্প শুনেছেন রাশেদুল হাসান
প্রবা : শুরুতেই আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আপনার ছোটবেলা সম্পর্কে বলুন?
সালমা খাতুন : আমার জন্ম ১৯৮৩ সালে টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরের অর্জুনা গ্রামে। আমার বাবা কৃষক, পাশাপাশি ছোট ব্যবসা করতেন, আবার গ্রামের একজন মাওলানাও ছিলেন। আমার তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আমি চতুর্থ। আমার ছোটবেলা গ্রামে কেটেছে। সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষ করেছি। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছি টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ থেকে।
২০০২ সালের উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আমাদের সংসারে শুরু হয় আর্থিক অনটন। বাবা বললেন আর পড়াশোনার দরকার নাই। কিন্তু আমার মেজভাই আমাকে উচ্চ শিক্ষার বিষয়ে উৎসাহ দিলেন। তিনি আমাকে কিছু টাকা দিলেন তৎকালীন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভর্তি ফরম নেওয়ার জন্য। ২০০২ সালে জগন্নাথে ভর্তি হয়ে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে প্রায় এক বছর ক্লাস করি।
প্রবা : চাকরিতে কীভাবে এলেন?
সালমা খাতুন : ভর্তি হওয়ার পরে ভাইয়া বললেন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটা টিউশনি বা চাকরির খোঁজ করতে। খুঁজতে শুরু করেও কিছুই পাচ্ছিলাম না। পরে আমি গ্রামে চলে যাই। ২০০৩ সালের কোনো একদিন ভাইয়া খবরের কাগজ পড়ছিলেন।
তিনি আমাকে জানালেন, বাংলাদেশ রেলওয়েতে একটা চাকরির বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে। তুমি কি একটা ব্যতিক্রমধর্মী পেশায় কাজ করতে চাও? আমার আবার ব্যতিক্রমধর্মী কাজের প্রতি উৎসাহ ছিল। সে রকম একটি পেশা সহকারী ট্রেন চালক। আমি আবেদন করলাম। পরীক্ষা দিলাম রাজশাহী গিয়ে। রিটেন কার্ড এলো। পরীক্ষা দিতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম ১০-১২ জন মেয়েও আছে।
পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। তিন মাস পর ভাইভা কার্ড এলো। ভাইভাতে গিয়ে দেখলাম সবাই ছেলে। পরে হলে ঢোকার পর পরীক্ষকরা জিজ্ঞেস করলেন, সারাদিন যাদের ভাইভা নিলাম সবাই ছেলে আপনি একাই মেয়ে। এ চাকরি সম্বন্ধে আপনার কোনো ধারণা আছে? আমি বললাম, আছে। তখন তারা বললেন, কেন আসবেন এ চাকরিতে। এমন কাজ আপনি করতে পারবেন? আমি বললাম, পারব। এর কয়েক মাস পর ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একজন ডাকপিয়ন আমার চাকরির জয়েন লেটার নিয়ে আসে।
প্রবা : মাওলানার মেয়ে আপনি, চাকরিতে প্রবেশ নিয়ে পরিবারে বা কোথাও কোন বাধা ছিল?
সালমা খাতুন : চাকরির খবরে আমার পরিবারের সবাই খুশি হয়েছে। বাবা-মা থেকে সবাই। খবর শুনে গ্রামের সবাই আসে আমাদের বাড়িতে। আমার বাবা তখন প্যারালাইজড ছিল। পরিবারে তখন খুব অর্থকষ্ট ছিল। তাই চাকরিতে যোগদানে কেউ বাধা না হয়ে বরং খুশি হয়েছে।
চাকরিতে আমার যোগদানের স্থান ছিল চট্টগ্রাম। গিয়ে দেখি- প্রায় ২০০ জনের সবাই ছেলে। সবাই বলছিলেন কেন এমন চাকরিতে এলাম। ট্রেন চালকের কাজ কঠিন, মেয়েরা পারবে না। সবার কথা শুনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিলাম। ভাইকে গিয়ে বললাম, মানুষরা উল্টাপাল্টা কথা বলে- আমি নাকি পারব না এমন কাজ।
ভাই বলল আগে জয়েন কর, পরে দেখা যাবে। তারপর জয়েন করলাম, পোষ্টিং দিল চট্টগ্রাম। আমি অনুরোধ করেছিলাম যে, আমি নারী আর আমার বাড়ি টাঙ্গাইলে। ঢাকায় থাকলে আমার সুবিধা হয়। সব শুনে আমাকে ঢাকায় পোস্টিং দিয়ে দিল। আমি ঢাকার ডিজেল ওয়ার্কশপ ট্রেনিং ইউনিটে যোগদান করলাম।
দেশের বিভিন্ন লোকোশেডে গিয়ে প্রাক্টিক্যাল, থিওরিটিক্যাল কাজ করলাম। চট্টগ্রাম, লাকসাম, হালিশহর, সিলেট, আখাউড়া , কুলাউড়া এভাবে দুই বছর ঘুরে ঘুরে ট্রেনিং শেষ হলো।
প্রবা : আপনাকে যে ধরনের পোশাক পরতে হয় সেটা মেয়েদের না, এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন?
সালমা খাতুন : প্রথম দুই বছরের প্রশিক্ষণের পরে আমাদেরকে যখন ঢাকা লোকোশেডে পোস্টিং দিলে তখন থেকে পোশাক পরতে হয়েছে। পোশাক নিয়ে সবাই উৎসাহ দিয়েছে। কেউ কখনও কিছু বলেনি।
প্রবা : চাকরিটা কি মেয়েদের জন্য কঠিন? এই সেক্টরে নারীদের সম্ভাবনা দেখেন?
সালমা খাতুন : এ ধরনের চাকরিই কঠিন, শুধু মেয়েদের জন্য আলাদা করে কঠিন বলে মনে হয়নি। আমার অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এটা ছেলেদেরই চাকরি। সবাই আমাকে বলেছেন, এটা ছেলেদের চাকরি, ছেড়ে দাও, তারা কেউ মিথ্যা বলেননি। পুরোটাই সত্য। এখনও সমস্যার মুখোমুখি হই। কিন্তু মেয়েদের সম্ভাবনা বেশি দেখি। এমন কাজে তাদেরকে স্বাগত জানাই। আমি যে কষ্ট করে প্রশিক্ষণ নিয়েছি সেগুলো আর এখন নেই। এই দিক থেকে নতুনরা এগিয়ে থাকবে। নারীরা না আসলে পরিবর্তন হবে না। সে কারণেই নারীদের আসা উচিত।
প্রবা : চাকরি জন্য বিয়ে নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়েছেন, আপনার স্বামী বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
সালমা খাতুন : অনেকে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়েছে। কেউ খোঁজ নিতে এসে আমার পেশা জেনে চলে গেছে। সে কারণেই চাকরি পাওয়ার পর বিয়ে করতে সাত বছর লেগেছে। তাদের মন্তব্য ছিল- মেয়েদের চাকরি করা ভালো না, তার ওপর আবার ট্রেন চালক।
আমার স্বামী আমার পেশা জেনেই আমাকে বিয়ে করেছেন। আমার স্বামী পুরোপুরি সহযোগিতা করেন। ডিউটি বেশি রাত হলে আমাকে নিয়ে আসেন। অনেক সময় খুব ভোরে বের হই, সে আমাকে কর্মস্থলে পৌঁছে দেয়। আমার স্বামী জজ কোর্টে চাকরি করেন।
প্রবা : অনেক দূরত্বে ডিউটি করেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, পরিবারের দেখাশোনায় সমস্যা হয় না?
সালমা খাতুন : বেশিরভাগ সময় প্রতিবেশীদের সাহায্য নেই, আত্মীয়স্বজনের সাহায্য নেই। বাচ্চার ক্লাসমেটের অভিভাবকদের সাহায্য নেই। সবাই সাহায্য করে। আগের দিন জানতে পারি ডিউটি কখন, সেভাবে সব ঠিক করে রাখি।
প্রবা : প্রথম দিনের ট্রেন চালানোর অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?
সালমা খাতুন : যোগদানের সাথে সাথেই ট্রেন চালাতে দেয় না। অনেক বছরের অভিজ্ঞতা দরকার হয়। অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকোমাস্টার হিসেবে কমপক্ষে দশ বছর দায়িত্ব পালন করার দুই বছর লোকমাস্টারের সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তখন ট্রেনের লোকোশেডের মধ্যে ইঞ্জিনের ঘোরানো, শান্টিং করা। চালানো শিখিয়ে দুই বছর পর চালাতে দেয়।
আমার প্রথম ট্রেন চালাই ঢাকা-জয়দেবপুর ডেমু রুটে। এটা ২০১৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় ডিউটি। যেদিন শুনলাম আমার কাল ডিউটি, আমার স্বামী বলল তাড়াতাড়ি ঘুমাও, কিন্তু আমি চিন্তায় সারারাত ঘুমাতে পারিনি। সকালে ড্রেস পরে বের হয়েছি। আমাকে খুব ভালো একজন এসিস্টেন্ট দিয়েছে। এসিস্টেন্টকে বললাম, আমার ভয় করছে। সে বলল- ‘আপা ভয় পাইয়েন না, আমি তো আছি।’যখন উঠলাম দেখলাম সব স্বাভাবিক। সেদিন আপ ডাউন দুই ট্রিপ দিতে হয়েছে।
প্রবা : কাজটা কেমন কঠিন?
সালমা খাতুন : আমাদের এক সেকেন্ডও বেখেয়ালি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ একটু পর পরই সিগন্যাল চলে আসে। মানুষ, গাড়ি, গরু ছাগল এমনকি বাজার পর্যন্ত রেল লাইনের ওপরে, এগুলোও আমাদের খেয়াল করতে হয়। প্রতিটি সিগন্যালই আমাদের ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। অনেক সময় ডিউটি করতে হয়, এমন শঙ্কাতো থাকেই। সে কারণেই এসিস্টেন্টে দেওয়া হয়। বার বার সতর্ক করা হয়, হুইসেল দেন, সিগন্যাল হলুদ, সিগন্যাল, সবুজ এই ধরনের কথা চলতেই থাকে। সব বিষয়েই সচেতন করা হয়।
প্রবা : কখনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন?
সালমা খাতুন : না, এখন পর্যন্ত আমার ট্রেনে দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমি সতর্ক থাকার চেষ্টা করি। সতর্ক থাকলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা একেবারেই থাকে না। লোকোমাস্টার হওয়ার আগে আমি লোকোশেডে অনেক কাজ করেছি।
প্রবা : লোকোমাস্টারের কাজে চ্যালেঞ্জটা কী?
সালমা খাতুন : ইঞ্জিন বগিতে তো টয়লেট থাকে না। মেয়েদের তো কাজ করতে হবে এখানে। আমাদের অনেক সময় ট্রেন চালাতে হয়। কয় ঘণ্টা পরে কোন স্টেশনে থামব আর কখন টয়লেটে যাব। ইঞ্জিন বগির ফ্যান বেশিরভাগ সময় থাকে নষ্ট, প্রচণ্ড গরম। নিরাপত্তারও কিছু বিষয় থাকে। ডিউটি শেষে গভীর রাতে ফিরতে হয়। আমার চাকরির তো ২০ বছর শেষ। পরবর্তীতে যারা আসবে তাদের জন্য এটা থাকা উচিত।
প্রবা : কখন হয়রানির বা নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন?
সালমা খাতুন : আগে রেল মানেই ছিল পুরুষ কর্মকর্তা ও কর্মচারী। আমি আসার পরই নারীরা আসা শুরু হয়েছে। এখন ৫০ জনেরও বেশি নারী কাজ করে। আমার সাথে কখনও কেউ এরকম আচরণ করেনি। খারাপভাবে কেউ কখনও আমাকে দেখেনি। সবার থেকে সম্মান পেয়েছি।
প্রবা : ইতিহাসের অংশ হয়ে আপনার কেমন লাগে?
সালমা খাতুন : এটা নিয়ে আমার পরিবারের সবাই গর্ববোধ করে। আমার বন্ধুরাও আমাকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। তবে এ পরিচয় দিয়ে সুবিধা নেই না। জানার পর মোটামুটি সবাই ভালোবাসে। সেদিন ডাক্তারের কাছে গেলাম তাকে পরিচয় দেওয়ার পর আমাকে বলল, আপনার নাম তো আমরা বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সময় পড়েছি। পরীক্ষায় এসেছে। সবাইকে আমাকে দেখে খুশি হন।