প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৪ পিএম
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের প্রথম ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সালমা খাতুন।
সালমা খাতুন; ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র। নারী ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। ব্যাটিং-বোলিং এবং ফিল্ডিং সব জায়গাতেই সমান মুন্সিয়ানা দেখিয়ে দখল করেছিলেন বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারের খেতাব।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের প্রথম ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে অপ্রতিরোধী ডানহাতি ব্যাটার সালমা খাতুনের সঙ্গে কথা বলেছেন লোপা মমতাজ
প্রশ্ন : শুরুতেই জানতে চাই একজন সালমা খাতুন কীভাবে ক্রিকেটার সালমা খাতুন হয়ে উঠলেন?
উত্তর : এই কথা আমি সব সময় বলি, আমি আসলে ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলতাম এবং আমার যদি কোনো ফেভারিট খেলা বলেন সেটা হচ্ছে ক্রিকেট। আমাকে কেউ হাতে ধরে খেলা শেখায়নি। নিজে থেকেই ব্যাট ধরা শিখেছি। সব সময় চিন্তা করতাম যদি ছেলেরা পারে, তাহলে মেয়েরা কেন পারবে না?
প্রশ্ন : ক্রিকেট সাধারণত ছেলেরা খেলে আসছে, এখন অনেক নারীও এগিয়ে এসেছে। একজন নারী হিসেবে এলাকার বা পরিবারের সহযোগিতা কেমন পেয়েছিলেন?
উত্তর : যখন বাসায় খেলাধুলা করতাম, তখন আমার আশপাশের মানুষ কী বলত তা কখনও মাথায় নিতাম না। কারণ আমি ক্রিকেট এতটাই ভালোবাসতাম যে, কেউ কিছু বললে তা কখনও কানে নিতাম না। কারণ আমি জানি আমি কোথায় আছি। এও জানি, আমি কতটা নিরাপদে থাকি বা কোন ধরনের মেয়ে। আমার ফ্যামিলিও জানে। আমার আম্মু কখনও কখনও বকা দিত, তখন আমার মামারা সাপোর্ট করত। বলত, ওকে বকা দিচ্ছো কেন? ও তো আমাদের সঙ্গেই খেলতে যাচ্ছে আর কারও সঙ্গে যাচ্ছে না। আর আমরা তো জানি আমাদের ভাগনি কেমন। আমার মামাতো ভাইয়েরাও বেশ সাপোর্ট করত। এমনকি পাড়ার ছেলেরাও বেশ সাপোর্ট করত। আমার মনে আছে, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে যখন খেলতাম ওরাই আমাকে বলত ক্যাপ্টেন সালমা।
প্রশ্ন : পাড়া বা মহল্লা থেকে যেদিন প্রথম জার্সি পরে স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস শুরু করলেন সেদিন কেমন লেগেছিল?
উত্তর : আমি কখনও কল্পনাও করিনি বাংলাদেশে উইমেন’স ক্রিকেট টিম হবে। ২০০৭ সালের কথা। আমি তখন গোপালগঞ্জে দাদার বাড়ি গিয়েছি বেড়াতে। খুলনা জেলা স্টেডিয়ামে মেয়েদের খেলা হচ্ছে খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসি। সেদিন আমি থ্রিপিস পরেই যাই। সেখানে দেখলাম, জাহানারা, সুখতারা, বৈশাখী অনেক মেয়ে প্র্যাকটিস করতেছে। সেখানে কোচ ছিলেন মরহুম শেখ সালাউদ্দিন স্যার, ইমতিয়াজ হোসেন পিলু স্যার এবং শংকর স্যার।
আমাকে সালাউদ্দিন স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি পেস বল নাকি স্পিন বল করতে পার? সেদিন কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে তিনটা পেস বল আর তিনটা স্পিন বল করলাম, যেহেতু আমি দুটোই পারি। আসার সময় আমাকে সালাউদ্দিন স্যার জিজ্ঞেস করেন, তোমার ট্রাউজার, গেঞ্জি, জুতা আছে? আমি বললাম, না স্যার। স্যারের একটা স্পোর্টসের দোকান আছে, তিনি সেখান থেকে পোশাক এনে দিলেন। এসব নিয়ে পরের দিন থেকে প্র্যাকটিস শুরু করি। বাসা থেকে সালোয়ার কামিজ পরেই যেতাম ওখানে, যাওয়ার পর ট্রাউজার গেঞ্জি পরতাম।
প্রথম দিন আমি যখন প্র্যাকটিস করি, ব্যাটিং করি, খুলনা স্টেডিয়ামের যত লোক ছিল আমাকে দেখে এত ইন্সপায়ার করেছে! এত খুশি হয়েছে, বলেছে একটা ছেলেও এত ভালো ব্যাটিং করতে পারে না বা ফিল্ডিং করতে পারে না। এমন কোনো ব্যক্তি ছিল না যে, সেদিন প্রশংসা করেনি।
প্রশ্ন : অনেক জায়গায় পড়েছি, আপনি বলেছেন গোলপাতার ঘর ছিল, আপনি উপার্জন করে মায়ের জন্য পাকা বাড়ি করেছেন।
উত্তর : ২০০৭ সালে প্রথম মালয়েশিয়া ট্যুর হয় আমাদের। সেখান থেকে আসার পর আমার হাতে ২০ হাজার টাকা ছিল। আমার প্রথম উপার্জন। ওই টাকা সম্বল করে টিন দিই। আর তিন হাজার ইট হলেই ওয়াল উঠে যাবে, এই কথা আম্মু আমাকে বলল। আমি পরে আমার কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলু স্যারকে জানাই। তিনি আমাকে মেয়ের মতো দেখেন। তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করছি। তিনি ২৫ হাজার টাকা দিলেন। এটা দিয়ে ওয়াল করে দুটি রুম উঠাই। সত্যি কথা বলতে কি, আমি খুব সঞ্চয় করি। খেলাধুলা করে যে টাকা পাই আমি খরচ করি না। বাসার জন্য জমাই। যখনই হাতে টাকা এসেছে, তখনই বাড়ির কাজ ধরেছি। ওভাবেই আস্তে আস্তে বাড়িটা করি। এখন আল্লাহর রহমতে পাঁচটা রুম হয়েছে। সবই ছাদ দিয়ে করেছি। আম্মুর একটা স্বপ্ন পূরণ করেছি। আরেকটা স্বপ্ন আছে আম্মুকে গাড়ি কিনে দেওয়ার। সেটাও পূরণ হবে আশা করি।
প্রশ্ন : আমাদের সমাজে নারীদের ঘরের বাইরে কিছু করাটা তেমন ইতিবাচক নয়। স্বাভাবিকভাবেই নারীদের রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। সালমা খাতুনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। ক্রিকেটার হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন? কীভাবে তা মোকাবিলা করেছিলেন?
উত্তর : অনেকেই অনেক কথা বলত- যখন আমি খেলতাম। বিশেষ করে যারা ক্রিকেটটা বোঝে না, তারাই সমালোচনা করে। আমি বলেছি না, আমি কখনও এসব কথা কানে নিতাম না। যদি ওসব কানে নিতাম তাহলে আমি সালমা আজ এখানে আসতে পারতাম না। আমি খুব সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করি। আমি জানি আমি কী। আমি আমার জায়গা থেকে অনেস্ট থাকার চেষ্টা করি। যারা একসময় সমালোচনা করত তারাও এখন আমার জন্য শুভ কামনা করে।
প্রশ্ন : প্রথম যেদিন ক্যাপ্টেনশিপ পেলেন, কেমন লেগেছিল?
উত্তর : আমি কখনই চিন্তা করিনি যে, বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেন হব। এর পুরো ক্রেডিটটাই এহসান স্যারের। এটা ২০০৮ সালের ঘটনা। হংকং টিম বাংলাদেশে আসবে আমাদের সঙ্গে খেলতে। তখন ঢাকায় ক্যাম্প ডাকা হয় আমাদের কমপ্লেক্সেই। আমরা জয়েন করি। প্র্যাকটিস শুরু করি। দুটি দল তৈরি হয়। একটা দলে আমাকে ক্যাপটেন করা হয়। এহসান স্যার আমাদের প্রতিটি ম্যাচের খেলা ফলো করতেন। মাঠে শুধু খেললেই হবে না। তাকে মাঠ চালানোর মতো অ্যাবিলিটিও থাকতে হবে। খেলার সেন্স থাকতে হবে। স্যার প্রতিটা ম্যাচে আমার খেলা ফলো করতেন। একদিন প্র্যাকটিসের মাঝখানে আমার কোচ এহসান স্যার আমাকে ডাক দিয়েছিলেন। বললেন, বেটা আমার সঙ্গে চলো। তিনি আমাকে বেটাই বলেন সব সময়।
আমি বললাম কোথায় যাব। তিনি বললেন, ক্রিকেট বোর্ডে যেতে হবে। কেন স্যার? বললেন, প্রশ্ন করো না। আমার সঙ্গে চলো। যাওয়ার পথে গাড়িতে আবার জানতে চাইলাম। তখন বললেন, ক্রিকেট বোর্ড থেকে ডিসাইড করা হয়েছে তোমাকে ক্যাপ্টেন বানানো হবে। আর এখন কোথায় যাচ্ছি? স্যার বললেন প্রেস কনফারেন্স। আমি তো অবাক। আমি জীবনেও কোনো দিন মিডিয়ার সামনে কথা বলিনি। তিনি বললেন, আমি তোমার সঙ্গে বসে থাকব। যা জিজ্ঞেস করবে তুমি শুধু উত্তর দেবে। গাড়িতেই আমার হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। ঘাম ছুটতেছে। এই তো।
প্রশ্ন : স্টেডিয়ামে মেয়েরা খেলছে, দর্শকদের কাছে এটা বেশ নতুন। তাদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পেতেন?
উত্তর : প্রথম প্রথম কেউ এত যেত না দেখতে। আমরা যখন প্রথম খেলা শুরু করি তখন মিডিয়ায় বলেন বা অনলাইনে বলেন এতটা প্রচার ছিল না। দর্শকদের মাঝে তার আনন্দটাই কিন্তু অন্যরকম। এখন ডে বাই ডে উন্নতি হচ্ছে।
প্রশ্ন : একটি মেয়ের সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে ক্রিকেটার হয়ে ওঠার জন্য একজন সালমা খতুনের কাছে পাঁচ ফর্মুলা জানতে চাই।
উত্তর : পেশাদার ক্রিকেটে যদি আসতেই হয়, তাহলে ক্রিকেট সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে। আপনি যেখানেই যান সবখানেই প্রস্তুতিটা ভালো হওয়া জরুরি। যদি প্রস্তুতি ভালো না হয়, তাহলে লাভ হবে না। জাতীয় দলে যদি খেলতেই হয়, তাহলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। শুধু পরিশ্রম করলেই হবে না, নিয়মানুবর্তী হতে হবে। ডিসিপ্লিনটা এখানে খুব জরুরি। ক্রিকেটে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নাহলে পেশাদার হওয়া যাবে না। অনেকেই কিছুদিন প্র্যাকটিসের পর ভাবেন তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। এমন ভাবনা থাকলে কোনো খেলাতেই টেকা যাবে না। অবশ্যই পরিবারের সহযোগিতা প্রয়োজন। পরিবার যদি পেছন থেকে সাপোর্ট দেয়, তাহলে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না। ক্রিকেট বোর্ড একবার একটি প্রোগ্রামের আয়োজন করেছিল, কে হতে চাও সালমা। তখন দেশের প্রতিটি জেলা থেকেই মেয়েরা এসেছিল। নারীদের ক্রিকেটে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য ক্রিকেট বোর্ডের এমন উদ্যোগ দেখে আমার ভালো লেগেছে।
প্রশ্ন : ক্রিকেটে মেয়েদের দল নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
উত্তর : অতীতে ক্রিকেটে আমাদের যে অবস্থান ছিল তা থেকে আমরা এখন অনেক ভালো অবস্থানে আছি। তবে এখান থেকে আরও ভালো কিছু করার সুযোগ তো রয়েছেই। যদি আমরা ভালো কিছু করতে চাই, তাহলে ভালো খেলতে হবে এবং নিজের পারফরম্যান্সের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নতুনদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে হবে। আমাদের দেখে যেন অন্যরাও এগিয়ে আসতে শুরু করে। আমাদের নারী দল নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। আমার বিশ্বাস, আমরা আরও অনেক দূর যেতে পারব। আমি যত দিন দলে আছি চেষ্টা করব দলকে নিজের সেরাটি দিতে। কদিন আগে আমরা অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে খেলার সুযোগ পেয়েছি। এটা আমাদের জন্য প্রথম। সেখানে আমরা আমাদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং আশা করি সামনে আরও ভালো কিছু করার সুযোগ আছে।