× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কার্জন হলে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বোমা বানাতাম

প্রবা প্রতিবেদক

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩ ০৯:৩৫ এএম

আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৩ ১১:২৭ এএম

মাহফুজা খানম। ছবি: সংগৃহীত

মাহফুজা খানম। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলে ডামি রাইফেল কাঁধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মার্চপাস্টের একটা ছবি প্রায়শ চোখে পড়ে। এই মার্চপাস্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই সময়ের ছাত্রনেত্রী মাহফুজা খানম। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নির্বাচিত নারী সহ-সভাপতি (ভিপি)। 

মাহফুজা খানম ১৯৪৬ সালের ১৪ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে বিয়ে করেন। তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী।

শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বহু সুবিধাবঞ্চিতকে শিক্ষায় আর্থিক সহায়তা করে আসছেন। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। এশিয়াটিক সোসাইটি, বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশন এবং খেলাঘর আসরসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের সভাপতি। একাধারে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, নারীনেত্রী, সমাজসেবী, মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক মাহফুজা খানম শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদকসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন। তার সঙ্গে প্রতিদিনের বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছেন সিরাজুল ইসলাম আবেদ 

প্রবা : আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী ভিপি, বিষয়টা ভাবতে কেমন লাগে? 

মাহফুজা খানম : আমাকে বলা হয় ডাকসুর একমাত্র মহিলা ভিপি। বিষয়টা ভালোই লাগে। আজকের যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশ বিনির্মাণে ৬ দফা বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। ঠিক সেই সময়টাতে, অর্থাৎ ৬৬, ৬৭ ও ৬৮ পর্যন্ত ডাকসুর ভিপি ছিলাম। যেই মুহূর্তে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যাত্রা, আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু সেই সময় আমার ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়েছিল এটা আমাকে অত্যন্ত গৌরবান্বিত করে। আমি সেই সময়টাতে বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে যেতে পেরেছিলাম। তিনি ছোট ছোট চিরকুট পাঠাতেন জেলের ভেতর অথবা বাইর থেকে। এমনকি সিগারেটের খোলের মধ্যে লিখে পাঠাতেন। 

প্রবা : যে সময়ে আমাদের দেশের মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হতেই শত বাধা পার হতে হয়েছে, সেই সময়ে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পড়াশোনাই করেননি ছাত্ররাজনীতি করেছেন এবং ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি হয়েছেন। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? 

মাহফুজা খানম : এ কথা বলতে হলে আমাকে ফিরে যেতে হবে বেগম রোকেয়ার কাছে। তার লেখা ‘অবরোধবাসিনী’র কাহিনি আমরা সবাই কম-বেশি জানি। সেই ‘অবরোধবাসিনী’ অতিক্রমকালের মধ্যে আমি পড়েছিলাম। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল ছিল বিজ্ঞানের। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিক্স, বোটানি, জুলজি নিয়ে ছিল কার্জন হল। এইখানে বিজ্ঞান অনুষদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের এবং এমএসসি-তে সর্বমোট ৪০-৪৫ জন মেয়ে ছিল। এখন যেখানে একটা বিভাগেই এক-দেড়শ মেয়ে পড়াশোনা করে। আমার বাবা-মায়ের উদার দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। পথটা খুব সহজ-সরল ছিল না, কণ্টকাকীর্ণ ছিল। অর্থাৎ সেই সময়ের সমাজে মেয়েদের পড়াশোনার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। মেয়ে কোথায় গেল, কী করল তা নিয়ে সমাজে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। কাছের জনরাই আঙুল তুলতেন। আমার বাবা-মা তা অগ্রাহ্য করেছেন। 

আমার মনে পড়ে, যখন আমি বাইরে কোথাও মিটিং করতে গেয়েছি তখন আমার বাসায় আত্মীয়-স্বজন এসেছে। তারা বিভিন্নভাবে বাবা-মা’কে কটূক্তি করত। কিন্তু তারা সব সময় আমার পাশে ছিলেন, আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। আমার সব কাজে সহায়তা করেছেন। আমি বিনম্র শ্রদ্ধায় তাদের অবদান স্মরণ করছি। ডাকসুর দীর্ঘ তিন বছর সময়ে তারা আমাকে সহায়তা না করলে আমার পক্ষে এই কাজগুলো করা সম্ভব হতো না। 

প্রবা : সাধারণত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের দেখা যায় পড়াশোনা, ল্যাব, প্র্যাকটিক্যাল ইত্যাদির পর আর কোনো সময় থাকে না। আপনি পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও রাজনীতির জন্য ঠিকই সময় করে নিয়েছিলেন। 

মাহফুজা খানম : ১৯৬২ সালে আমি যখন ইডেন গার্লস কলেজে পড়ি তখন হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও শরীফ কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে দেশে আন্দোলন শুরু হলো। সে সময়ে প্রতিদিনই প্রায় ধর্মঘট থাকত। আর ধর্মঘট মানেই ইডেন গার্লস কলেজের গেটে একটা তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। এক দিন আমি কার্জন হলের খোলা জায়গায় মাইক্রোস্কোপ নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন একজন এসে আমাকে জানালÑ অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান আবু মাহমুদ স্যারকে মেরেছে ছাত্ররা। ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঘটনা মনে হলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথমেটিক্সসহ বিভিন্ন বিভাগে গেলাম ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ সভা করলাম। সেই ছিল আমার ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রারম্ভিক যাত্রা।  

প্রবা : আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। 

মাহফুজা খানম : ছয় দফার কারণে আইয়ুব খান সরকার নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করতে থাকল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া হলো। পাকিস্তান সরকার ভেবে নিয়েছিল এই মামলার মাধ্যমে তারা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলাবে। এটা তাদের পূর্বনির্ধারিত ছক ছিল। কিন্তু আমরা ছাত্র ও জনতা এই আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলেছিলাম ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান সরকার আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। তাই এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আমাদের অধিকার আদায় করতে হবে, মনোজগৎ এমন একটা পরিবর্তন হয়েছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভেতরে। যার ফলে বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা দিলেন, তখন সবাই তার পক্ষে কাজ করার জন্য ঝঁপিয়ে পড়ল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের আরও একটা যাত্রা শুরু হলো। পরবর্তীতে সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির জয়লাভের পরও যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলেঅ না, তখন আমরা বুঝলাম যে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য। এর মধ্যে ঊনসত্তরে আমার বিয়ে হলো। 

১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে আমরা অনুভব করছিলাম যে, আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধে যেতে হবে। আমরা মেয়েদের নিয়ে ডামি রাইফেল দিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সেই সময়ের মেয়েদের রাইফেল কাঁধে মার্চপাস্টের একটা ছবি বেশ দেখা যায়। আমরা বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তারপর বোমা বানানোর জন্য কার্জন হলের কেমিস্ট্রি বিভাগ থেকে বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করতাম। এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি।

২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে আমরা পুরানা পল্টনের ৩/১ জি-তে ছিলাম। আমরা পল্টনের বিভিন্ন গলিতে ব্যারিকেড দিয়ে পাহারা দিতাম। সেদিন রাতে আমি এবং শফিক পাহারা শেষ করে কেবল বাসায় এসে শুয়েছি। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে গুলি, ট্যাঙ্কের শব্দ আসতে শুরু করে। এক সময় চারদিকে গুলির প্রচণ্ড শব্দে সবকিছু যেন ভেঙে ভেঙে পড়তে লাগল। তখন আমরা বাচ্চাটাকে নিয়ে খাটের নিচে ঢুকে গেলাম। খেয়াল করলাম চারদিকে গুলির শব্দ, সমস্ত আকাশ যেন লাল হয়ে গেছে। এভাবেই ২৫ মার্চ কাটল আমাদের। ২৬ মার্চ কারফিউ ছিল। এরপর ২৭ মার্চ আমার পাঁচ মাসের বাচ্চাকে জা-এর কাছে রেখে একটা রিকশা নিয়ে মায়ের বাড়ি স্বামীবাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে চলে গেলাম। চারপাশে বীভৎস দৃশ্য। 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমার বাচ্চা ছোট হওয়ার জন্য পার্টি থেকে আমাকে বলা হলো ঢাকাতে থাকতে। আমি ঢাকাতে থেকে গেলাম যুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদানের দায়িত্ব নিয়ে। আমরা আস্তে আস্তে সংগঠিত হতে লাগলাম। আমার কাজ ছিল বাইরে থেকে আসা কাগজপত্র, লিফলেট টেনসিল কেটে সাইক্লোস্টাইল করা। কার্জন হলের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে এই কাজগুলো করতাম। সেখানে তখন বেয়ারা ছিলেন হরলাল দাদা। তিনি আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিতেন। কাজ শেষ হলে বেরিয়ে আসতাম। এই কাজগুলো নটর ডেম কলেজেও করেছি। বোমা বানাবার জন্য ঢাকায় ইতোমধ্যে বড় একটা দল তৈরি হলো আমাদের। সবাই কার্জন হলের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বোমা বানানোর কাজ করতাম। প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল জাহানারা ইমামের সঙ্গে। আপার সঙ্গে কাজ করেছি এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে। জাহানারা ইমামের গাড়িতে করে ঢাকা শহরে আমরা লিফলেট বিতরণ করতাম। আমার বাড়িটি বিভিন্ন কাজের একটা কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। সেখানে এসে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতেন, খাবার খেতেন। ছোট্ট একটা রুমে সবাই একসঙ্গে ঘুমাতেন। 

প্রবা : ছাত্ররাজনীতি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কিন্তু পেশা হিসেবে বেছে নিলেন শিক্ষকতা, কেন?

মাহফুজা খানম : আমি সোজাপথে হাঁটা মানুষ ছিলাম না। সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে জানি- যা রাজনীতিতে খুব কঠিন ব্যাপার। আমি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট হয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশনে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। তাই আমার চাকরি হয়নি। পরবর্তীকালে পুরানা পল্টনে গার্লস কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে, আমার প্রথম চাকরি শিক্ষকতা। আমি নিজেকে একজন সার্থক শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছি। প্রজন্মকে গড়ে তুলতে এখনও কাজ করে যাচ্ছি। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা