× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মাস্টার রনি

তৃতীয় লিঙ্গের অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধা

আহমাদ শামীম

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:২৮ পিএম

আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ২৩:০১ পিএম

 তৃতীয় লিঙ্গের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার রনি। দীর্ঘ পাঁচ দশক ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। জীবনসায়াহ্নে এসে চান রাষ্ট্রের স্বীকৃতি      ছবি: ফারহান ফয়সাল

তৃতীয় লিঙ্গের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার রনি। দীর্ঘ পাঁচ দশক ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। জীবনসায়াহ্নে এসে চান রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ছবি: ফারহান ফয়সাল

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয় সমাজে। ‘হিজড়া’ শব্দেই আটকে যায় তাদের পরিচয়। অথচ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই মানুষগুলোর আছে অবদান। এমনই একজন রনি হিজড়া ওরফে মাস্টার রনি। তার যুদ্ধদিনের কথামালা আর লোকচক্ষুর অন্তরালের জীবনের অপ্রাপ্তির গল্পগুলো পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করেছেন তিনি...

১৯৭১ সালের মার্চ মাস, স্বাধীনতার ডাক পৌঁছে গেছে দেশের প্রতিটি কোণে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নির্ভয়পুর গ্রামের ১৮ থেকে ১৯ বছরের এক যুবকের মনেও দোলা দিয়ে যায় মুক্তির ডাক। আবদুল হালিম বেলাল নামে এ যুবক অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা। শারীরিক অবয়ব পুরুষালি হলেও হাঁটাচলা, কথাবার্তায় ছিল মেয়েলি ঢং। কিন্তু নিদারুণ সেই যুদ্ধের সময় এত কিছু ভাবার সময় কোথায়!

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা আক্রমণ করে ঢাকা। কুমিল্লায়ও চলে আসতে পারে তারা যেকোনো সময়। সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলের মানুষ প্রস্তুত ছিল ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়ে কুমিল্লায়ও হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। যুবক বেলাল পরিবারের সঙ্গে চলে যান ভারতে। সেখান থেকে সমবয়সিদের সঙ্গে দেশমাতৃকার ডাকে নাম লেখান মুক্তিবাহিনীর দলে। মাত্র ৪৫ দিনের ট্রেনিং শেষে জীবন বাজি রেখে ২ নম্বর সেক্টরের অধীন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে অংশ নেন বেশ কিছু অপারেশনে।

ওই যে বললাম, যুবকটির চালচলনে ছিল ভিন্নতা। যুদ্ধের পর তা প্রকাশ পায় প্রকটভাবে। নিজেই বুঝতে পারেন তিনি অন্যদের চেয়ে ‘আলাদা’। আলাদা বলেই একদিন ছাড়েন গ্রাম। চলে আসেন ঢাকায়। আবদুল হালিম বেলাল হয়ে যান ‘রনি হিজড়া’ ওরফে মাস্টার রনি।

মুক্তিযুদ্ধের এই অকুতোভয় সৈনিক দুর্ঘটনাবশত একদিন হারিয়ে ফেলেন তার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট। এরপর কেটে যায় প্রায় পাঁচ দশক। নিজ পরিবার, স্বজন, সহযোদ্ধা আর বন্ধুদের কাছে মৃত বা হারিয়ে যাওয়া মানুষটি চলে গেলেন বিস্মৃতির আড়ালে। এতগুলো বছর ধরে অজানাই ছিল তার গল্প, তার যুদ্ধদিনের কথামালা। ২০২১ সালে সাবেক গণমাধ্যমকর্মী ও তথ্যচিত্র নির্মাতা শরিফুল ইসলাম পলাশের হাত ধরে ‘অগ্নিঝরা দিনের না বলা কথা’ তথ্যচিত্রের মাধ্যমে আবারও যেন নতুন জীবন পান আবদুল হালিম বেলাল ওরফে মাস্টার রনি।

জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাস্টার  রনি

জীবিত থেকেও সবার কাছে হারিয়ে যাওয়া মানুষটির সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে ১১ ডিসেম্বর সোমবার দুপুরে যাই মিরপুরের মাজার রোডে। শাহ আলী মাজারের বিপরীত গলিতে তার বর্তমান নিবাস।

সাদা শ্যাম বর্ণের সুঠাম মানুষটির গায়ে ফতুয়া ও সাদা লুঙ্গির সঙ্গে কালো চাদর, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। প্রথম দেখায় পরিচিতজনের মতো হাত বাড়িয়ে জানতে চাইলেন কেমন আছি। পাঁচ তলা ভবনের নিচতলার একটি রুমে একাই থাকেন মাস্টার রনি। ‍রুমে তেমন কিছুই নেই। নিত্যব্যবহারের কিছু জিনিসপত্র, জামাকাপড় আর উঁচু একটি খাটের পাশে চেয়ারপাতা। সেখানে বসেই কথা চলে আমাদের।

জানতে চাই যুদ্ধে যাওয়ার প্রেক্ষাপট। প্রশ্ন শুনে, শীতের ঘন কুয়াশার মতোই স্মৃতির কুয়াশা কাটতে কাটতে মাস্টার রনি গিয়ে পৌঁছেন ১৯৭১-এর দিনগুলোতে। মেলে ধরেন স্মৃতির পাতা।‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরই বুঝে যাই যুদ্ধ আসন্ন।’ অন্য অনেকের সঙ্গে মাস্টার রনিও গ্রামের একজন আনসার অফিসারের কাছে নিয়েছিলেন যুদ্ধের প্রথম তালিম। লাঠি হাতে ছিল সেই ট্রেনিং। এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তানি সেনারা চৌদ্দগ্রাম আক্রমণ করলে শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যান দুই ভাই আর বাবা-মার সঙ্গে। সেখানে তার গ্রামের সমবয়সি কয়েক তরুণের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মাস্টার রনির ভাষায়, ‘পাকিস্তানিরা আমার দেশ আক্রমণ করেছে, আমার গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। দেশকে তো স্বাধীন করতে হবে, বাঁচি কি মরি এসব ভাবনা তখন মাথায় ছিল না।’ 

যুদ্ধে যাবেন কথাটা মাকেই প্রথম বলেছিলেন। ‘মা আমার কথা শুনে চুপ করে থাকেন। বাবা অসুস্থ ছিলেন। তিনি প্রথমে বাধা দেন। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে ছিলাম অনড়। বাবাকে বললাম তোমার তো আরও দুই ছেলে আছে। তখন মা বললেন, যুদ্ধে যা তুই, তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে দিলাম। মায়ের এ কথার পর বাবাও আর নিষেধ করেননি।’

স্মৃতি হাতড়ে মাস্টার রনি বলতে থাকেন, ‘মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানো আমাকেসহ আরও অনেককে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় রাজনগর তাকিয়া ক্যাম্পে। ১৫ দিন থাকার পর যাই মেলাঘর ক্যাম্পে। ভারতীয় আর্মিরা বাছাই করে।এরপর নিয়ে যায় আসামের লায়লাপুরে। ৪৫ দিন ট্রেনিং শেষে আবার ফিরে আসি মেলাঘর ক্যাম্পের হেডকোয়ার্টারে।’ মাস্টার রনি ও তার সহযোদ্ধাদের দায়িত্ব ছিল দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে রাতের বেলা অতর্কিত পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর হামলা করে আবার ফিরে যাওয়া। সহজ ভাষায় তিনি ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা।

যুদ্ধের প্রসঙ্গে তুলতেই মাস্টার রনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম অপারেশন ছিল কুমিল্লার নির্ভয়পুরে। ওই অপারেশনে গিয়ে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। কয়েকজন সহযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ক্যাম্প থেকে বলা হয়েছিল, আমরা যেহেতু বয়সে তরুণ, অভিজ্ঞতাও কম তাই আমাদের পাঠানো হবে নিজ নিজ গ্রামে বা কুমিল্লার চেনাজানা এলাকাগুলোয়। এরপর আর কোনো সমস্যা হয়নি।’

তবে নির্ভয়পুরের সেই অপারেশন এখনও মাস্টার রনিকে নাড়া দিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘নির্ভয়পুরের অপারেশনে তিন দিন উপোস ছিলাম সবাই। সকাল নাগাদ এক বাড়িতে গিয়ে খাবার চাইলাম। বাড়ির মুরুব্বিকে জানালাম আমরা কারা, কোথা থেকে এসেছি। তিনি সব শুনে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন। মুরগি জবাই দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা হলো। বিশ্রাম আর খাবারের জোগান দেখে আমরা আনন্দিত। ওই লোকটি তখন এসে বললেন, আপনাদের জন্য একটু পান আর ধূমপানের ব্যবস্থা করতে বাজারে যাচ্ছি। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। তিনি চলে যাওয়ার পর তার কিশোর বয়সি মেয়ে এসে আমাদের জানায়, আপনারা কি জানেন আমার বাবা কে? তিনি কোথায় গিয়েছেন? তিনি শান্তিবাহিনীর সদস্য। পাকিস্তানি ক্যাম্পে গেছেন আপনাদের বিষয়ে জানাতে। জীবন বাঁচাতে চাইলে এক্ষুনি পালান। আমরা দেরি না করে বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু দূরে অবস্থান নিই। দেখতে চেয়েছিলাম মানুষটি আসলেই রাজাকার কি না। ঘণ্টাখানেক পর দেখি সত্যিই তো, লোকটি পাকিস্তানি আর্মিদের নিয়ে তার বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের না পেয়ে হতাশ হানাদার বাহিনী তার মেয়েটিকে অর্থাৎ আমাদের জীবন বাঁচিয়েছিল যে, তাকে নিয়ে যেতে চায়। অনেক কাকুতিমিনতি করায় তাকে আর নিয়ে যায়নি। ওই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে আসার পর ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করি, মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল এসে লোকটিকে নিয়ে যায়। মেয়েটি তখন তার বাবাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল অনেক। কিন্তু তাকে তখন তার নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’

গেরিলা যোদ্ধাদের প্রতিটি অভিযানই হতো সাহসিকতায় পূর্ণ। এমনই এক দুঃসাহসিক অভিযানে গিয়েছিলেন মাস্টার রনি। তা-ও আবার সম্পূর্ণ একা। স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়ে শরীর দুলিয়ে বলতে থাকেন তিনি, ‘রাধানগর ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন মুখার্জি। তিনি একদিন আমাদের প্লাটুনের ৩০-৩৫ জনকে ডেকে বললেন চৌদ্দগ্রাম আর্মি ক্যাম্পের ম্যাপ করে আনতে হবে। কে যেতে পারবে? বড়ই ভয়ানক কাজ। ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। কেউ রাজি হচ্ছিল না। আমি তখন বললাম, আমি যেতে চাই। কিন্তু ম্যাপ আকারে আনতে পারব না। ক্যাম্পের কোথায় কী আছে এসব বিষয় দেখে এসে জানাতে পারব। ক্যাপ্টেন মুখার্জি রাজি হলেন। আমি তখন দেশে প্রবেশ করে নানাবাড়ি চলে যাই। নানাকে গিয়ে বললাম এ বিষয় জানালাম। বললাম এলাকার একজন রাজাকারকে ডেকে এনে দিতে। তার সহযোগিতা লাগবে। তিন দিন লুকিয়ে ছিলাম নানাবাড়ি। তিন দিন পর নানা এক রাজাকারকে নিয়ে এলেন। যাকে আনলেন সে আমার সহপাঠী, স্কুলের বন্ধু! বন্ধুকে পেয়ে আমার উদ্দেশ্যের কথা জানালে সে বলল, আমি রাজাকারে নাম লিখিয়েছি জীবন বাঁচানোর জন্য, আমার পরিবার, আমার গ্রাম বাঁচানোর জন্য। আমি তোকে এ কাজে সাহায্য করব। ওই বন্ধুর সঙ্গে তখন ওদের ক্যাম্পে যাই। চলনে-বলনে মেয়েলিভাব ছিল আমার, নাচগানও পারি। ক্যাম্পে গিয়ে ওদের ক্যাপ্টেনকে বললাম, আমি তোমাদের নাচগান শোনাব! তিনিও মজা পেয়ে রাজি হলেন। ওই সন্ধ্যায় কয়েকটি উর্দুগান গেয়ে নাচলাম। সবাই খুশি হলো। তখন থেকে প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্পে যাই, সব দেখে এসে ক্যাপ্টেন মুখার্জির কাছে রিপোর্ট করি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, চৌদ্দগ্রাম পাকিস্তানি ক্যাম্প দখলের পর মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় আর্মির সঙ্গে আমাকে দেখে ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন বেশ খেপে গিয়েছিলেন। তু গাদ্দার হ্যায় বলে চিল্লাতে লাগলেন। আমিও তাকে বলেছি, তুমি আমার দেশ দখল করতে চেয়েছ। আমি আমার দেশ মুক্ত করতেই এ কাজ করেছি। আমি গাদ্দার নই। তুমি গাদ্দার।’

অকুতোভয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন হতে পারত অন্য অনেকের মতোই। স্বাধীন দেশে আপন পরিচয়ে বসবাস করার ইচ্ছা তারও ছিল। কিন্তু তিনি তো সবার মতো ছিলেন না। লিঙ্গপরিচয়ে অন্যদের চেয়ে আলাদা। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় চলে আসতে হয় তাকে। নিজের মতো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সঙ্গেই কাটাতে থাকেন জীবন। বাসা পাল্টাতে গিয়ে কিছু কাগজপত্রের সঙ্গে হারিয়ে ফেলেন মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট। সেই সার্টিফিকেট উদ্ধারে নেননি কোনো উদ্যোগ। নিজের মতো করেই থাকতে চেয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। কিন্তু প্রকৃতি এমনটা চায়নি বলেই আবার দেখা মিলেছে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হালিম বেলালের, যার পরিচয় এখন ‘রনি হিজড়া’।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলে তার নেই কোনো দুঃখবোধ। বরং বুকে হাত দিয়ে গর্বের সঙ্গেই বলেন, ‘আমি তো হিজড়া, থার্ড জেন্ডার। এ নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। গর্বের সঙ্গে বলি, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।’

আগেই বলেছি, নির্মাতা শরিফুল ইসলাম পলাশের তথ্যচিত্রের পর যেন নতুন করে জন্ম হয়েছে মাস্টার রনির। কিন্তু যুদ্ধের পর প্রায় ৫০ বছর পরিবার ছেড়ে কীভাবে কাটল তার সময়, বেঁচে থাকতে কী করতেন এসব বিষয়ে প্রশ্ন জাগে। তিনি বলেন, ‘এ সময়গুলো একা একাই কাটিয়েছি। হিজড়াদের সঙ্গে থেকেছি। টাকার জন্য টিউশনি করতাম। সেই থেকে আমার নামের আগে মাস্টার শব্দটা যোগ হয়। রনি হিজড়ার বদলে আমাকে সবাই ডাকে মাস্টার রনি বলে।’

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে উন্নাসিকতা। আলাদা চোখে দেখা হয় তাদের। কিন্তু মাস্টার রনি সেসব ভাবনা দারুণভাবে পাশ কাটিয়ে বাস করছেন সমাজেরই সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বর্তমান বাসায় ভাড়া থাকেন ২০০১ সাল থেকে। মাস্টার রনি বলেন, ‘বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে প্রথমে ঝামেলা হয়েছিল। হিজড়া বলে বাড়িওয়ালা প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু তাকে বুঝিয়ে বলার পর রাজি হন। তার সঙ্গে কোনো ঝামেলা হয়নি কখনও। পাশের রুমে যারা থাকেন তাদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক। পাশের বাসার ছোট মেয়েটি আমার কাছেই থাকে প্রায় সারা দিন।’

তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষটি  এখন চান শুধু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি

স্থানীয়দের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্কের প্রমাণ পাই ছবি তুলতে গিয়ে। বাসার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ফাঁকে অনেকে এসে জানতে চান, আমরা কারা, কেনই বা মাস্টার রনির ছবি তুলছি। পত্রিকা থেকে এসেছি শুনে তারা আশ্বস্ত হন। ছবি তোলার সুযোগে ‍দুয়েকজন দাঁড়িয়ে পড়েন তার সঙ্গে। পাশের মসজিদের ইমাম সাহেব এগিয়ে আসেন। মাস্টার রনি পরিচয় করিয়ে দেন তার সঙ্গে। ছবি তোলায় যেন সমস্যা না হয়, কেউ কেউ পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। বোঝা গেল সবার সঙ্গে দারুণ সদ্ভাব তার।

মাস্টার রনি জানালেন, নিজেকে এতগুলো বছর আড়াল করার পর আবারও ফিরে গেছেন নিজ পরিবারে। বাবা-মা বেঁচে নেই। আছেন দুই ভাই। পলাশের তথ্যচিত্রের সূত্রে ২০২১ সালে দেখা হয় ভাইয়ের সঙ্গে। সে সময়কার কথা জানতে চাইলে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন তিনি। আবেগে ধরে আসে গলা। বলতে থাকেন, ‘বড় ভাইকে দেখে আমি কথা বলতে পারি নাই প্রথমে। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। ভাই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কথা বল আমার সঙ্গে। কোথায় ছিলি এত দিন। কেমন আছিস। কান্নার দমক থামিয়ে অনেকক্ষণ পরে তার সঙ্গে কথা বলি। ভাই শুধু বলেছিলেন, তোকে ফিরে পেয়েছি আর কিছু চাই না। তুই আমার ভাই, আমার রক্ত। তুই কে, তুই কেমন এসব ভাবতে চাই না।’

স্বেচ্ছা আড়ালবাস কাটিয়ে জনসম্মুখে তার আসল পরিচয় উদ্‌ঘাটিত হওয়ার পরও মাস্টার রনির সঙ্গে সরকার বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়নি কোনো যোগাযোগ। এ দুঃখবোধ আছে তার। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। নিজের ইচ্ছাতেই আমি আড়ালবাস বেছে নিয়েছি। কিন্তু প্রকাশ্যে আসার দুই বছর পার হতে চলল। সরকারের তরফে কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমি একজন বীর ‍মুক্তিযোদ্ধা, জীবনসায়াহ্নে এসে রাষ্ট্রের কাছে অন্তত এ স্বীকৃতিটা চাই আমি।’ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু হলে নতুন করে আবেদন করবেন বলেও জানান মাস্টার রনি।

এক বিকেলের অনেক কথার শেষে এলো বিদায় নেওয়া সময়। কথা বলতে বলতে আবারও মূল সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে আসেন মাস্টার রনি। হাত মিলিয়ে চলে আসার মুহূর্তে মনে হলো, একটি স্বাধীন দেশের জন্য এ দুটি হাতেই তো উঠেছিল অস্ত্র, এখনও দারুণ সবল-শক্ত ‍দুটি হাত। আমরা এগোতে থাকি। মাস্টার রনি শূন্য চোখে দাঁড়িয়ে থাকেন, তার দৃষ্টিতে ছিল অনেক না-বলা কথা। অনেক পাওয়া-না-পাওয়ার বেদনা।

রাষ্ট্র হয়তো বাকি সব বীর মুক্তিযোদ্ধার মতো তাকেও স্বীকৃতি জানাবে। সেটা যত দ্রুত সম্ভব, ততই মঙ্গল, এই মানুষটির জন্য তো বটেই; মঙ্গল রাষ্ট্রের জন্য, মঙ্গল আমাদের জন্যও। কারণ তাদের কাছে যে অনেক ঋণ আমাদের। এ ঋণ শোধ করার সময় চলে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা