মানব ভাষার ইতিহাস উত্থান ও পতনের ইতিহাস। তথ্যবিবরণী মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ সালের দিকে এই গ্রহের বুকে ২০ হাজারের মতো ভাষা অস্তিত্বশীল ছিল। বর্তমানে তা প্রায় এক-তৃতীয়াংশে এসে পৌঁছেছে। অসংখ্য ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। আবার অনেক ভাষা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। যেসব ভাষা এখনও টিকে আছে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, তাদের সংখ্যা এখন আর ৭ হাজারের বেশি হবে না। এ ব্যাপারে একটি অতি আশ্চর্যজনক তথ্য হলো : প্রতি মাসে পৃথিবীর বুক থেকে দুটি করে ভাষা হারিয়ে যায় এবং এ গতি অব্যাহত থাকলে আগামী শতাব্দীর ভেতরই আরও ৬ হাজার ভাষা ভূপৃষ্ঠ থেকে বিলীন হয়ে যাবে। এ কথার সমর্থনে আরও তথ্য দেওয়া যায় যে, বর্তমান পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল ভাষাগুলোর মধ্যে ৯০% ভাষাই এক লাখেরও কম মানুষ ব্যবহার করে। ৪৬টি ভাষায় মাত্র ১ জন করে এবং ৩৫৭টি ভাষায় ৫০ জনেরও কম করে মানুষ কথা বলে। আন্দামান ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বো ভাষায় কথা-বলা শেষ প্রতিনিধি ছিলেন বোয়া সিনিয়র। তার মা ছিলেন দীর্ঘদিন বো ভাষায় কথা-বলা একমাত্র জীবন্ত মানুষ। ভাষা সম্পর্কে এমন অসংখ্য চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত রয়েছে ভাষাবিজ্ঞানীদের থলেতে। আবিষ্কার হচ্ছে নিত্যনতুন তথ্য। যেসব ভাষা এক সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রভুত্ব করেছিল, তাদের অনেকেই আজ হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলান্তে। হিব্রুর মতো দাপুটে ভাষা, যা এক সময় ‘ঐশী বাণী’ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল, তা আজ মৃত ভাষা। সংস্কৃতের মতো প্রভাবশালী আর্যভাষা আজ মানুষের বচন থেকে নির্বাসন নিয়ে পণ্ডিতের গবেষণার উপাত্ত জোগাচ্ছে। তবে ভাষা নিয়ে সবটুকুই হতাশার খবর নয়। দরকারি পরিচর্যায় যেকোনো ভাষার মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব- এমনকি রোধও করা যেতে পারে। কারণ, ভাষা জন্মসূত্রে কিংবা জীববৈজ্ঞানিক কারণে মরণশীল নয়।
বিশ্বজুড়ে মানুষের ভাষাগুলোকে মোটা দাগে দেশীয়/দেশি/দৈশিক ভাষার (indigenous language) শ্রেণিতে ফেলা যেতে পারে। এগুলো বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাতৃভাষা। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশি দেশে একাধিক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষা রয়েছে। সেগুলো কেবলই তাদের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম নয়। সেগুলো তাদের অমূল্য সম্পদ। তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ধারক-বাহক। মাতৃভাষাকে আঁকড়ে ধরেই মানুষ পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আজ পৃথিবীজুড়ে মানুষের ইনডিজিনাস ভাষাগুলো দ্বিতীয় শ্রেণির ভাষা হিসেবে মর্যাদাহীন হয়ে পড়ছে এবং অজ্ঞতা, দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা প্রভৃতির সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে ক্ষমতা-সমর্থিত মূলধারার ভাষাগুলোকে আধুনিকতা, উন্নয়ন এবং সংহতির পরিচায়ক হিসেবে গ্রাহ্য করা হচ্ছে। মূলধারার প্রবল প্রভাব ও প্রতাপে ইনডিজিনাস ভাষাগুলো স্বমহিমায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকশিত হতে পারছে না। শত শত অস্ট্রেলীয় আদিবাসী এবং নেটিভ আমেরিকান
ভাষা এভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশেও এর দৃষ্টান্ত দুষ্প্রাপ্য নয়।
বাংলাদেশে ৯৮% মানুষ বাংলায় কথা বললেও এখানে ৪৫টিরও বেশি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ৩০টিরও বেশি দেশজ ভাষায় কথা বলে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং ভাষিক পরিচিতি রয়েছে। তাদের ভাষা ও হস্তলিপি এখনও বিপন্ন। যদিও তারা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশের সংবিধান-স্বীকৃত সব মৌলিক ও সাধারণ অধিকার সমভাবে ভোগ করার অধিকারপ্রাপ্ত; তবুও নিজেদের ভাষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিপূর্ণ বিকাশের পুরোপুরি অনুকূল পরিবেশ তারা পাচ্ছে না। জাতীয় কারিকুলামে জাতীয় ভাষার আধিপত্য থাকায় তাদের নতুন প্রজন্মগুলোকে মূলধারার ভাষা-শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে একীভূত হতে হচ্ছে। সেটিও কোনো সমস্যার নয়, বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য ও সংহতিতে সম্পৃক্ত হওয়ায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু একই সঙ্গে নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক ভাষা ও ঐতিহ্য ভুলে যাওয়া আত্মমর্যাদার জন্য কম গ্লানিকর নয়। আত্মপরিচয়ের সংকট মানুষের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক সংকট- যে সংকটে ভুগছে আমাদের সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী।
জাতিসংঘও মানুষের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতার ধারণার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশ্বজুড়ে মাতৃভাষা সচেতনতা সৃষ্টি- ও বিকাশের জন্য নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এ সংবেদন সৃষ্টি করা হচ্ছে যে, মানুষের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো তার মাতৃভাষা। ইউনেস্কো জনসম্মুখে (গণগ্রন্থাগার, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ, হোটেল- রেস্তোরাঁ, জিম-ক্যাফে প্রভৃতিতে) স্থানীয় ভাষায় কথা বলা এবং সাহিত্যিক টেক্সট পঠনের পরামর্শ দিচ্ছে। উপদেশ দিচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন অবহেলিত, অবিকশিত স্থানীয় ভাষা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে। জাতিসংঘের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকার ঘোষণাপত্র : Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৭) মানুষের মাতৃভাষার অধিকার সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক দলিল। সে ঘোষণাপত্রের ১৩-১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাস, ভাষা, বাচনিক ঐতিহ্য, দর্শন, লেখ্য পদ্ধতি, সাহিত্য প্রভৃতি পুনরুজ্জীবিত করা, ব্যবহার করা, উন্নয়ন করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সঞ্চারিত করার অধিকার আছে।’ আবার অনুচ্ছেদ ১৪-১-এ বলা হয়েছে : ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব শিক্ষা প্রদান এবং শিক্ষা গ্রহণের সাংস্কৃতিক পদ্ধতির উপযোগী পন্থায় তাদের শিক্ষা পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার সংরক্ষণ করবে।’
কিন্তু এসব আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, প্রস্তাব, ঘোষণা ইনডিজিনাস মানুষ এবং তাদের অবহেলিত ভাষাগুলোর কোনো দৃশ্যমান উপকার করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা, এমনকি অনেক কথিত উন্নত বিশ্বের প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য প্রান্তিক সংখ্যালঘু মানুষ এখনো ঘোরতর সাংস্কৃতিক সংকটে দিন কাটাচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করা শাসকশ্রেণির আত্তীকরণ নীতি এবং তাদের কর্তৃত্বপূর্ণ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। এক ধরনের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের শিকার হচ্ছে।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাংলদেশ মানবজাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ত্যাগের নজির সৃষ্টি করেছে। সৃষ্টি করেছে সর্বোচ্চ গৌরব অর্জনের দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের জরায়ুতে সুপ্ত ছিল একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র। আমাদের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের যে দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা, তার সূচনা আমাদের ভাষা চেতনায় এবং উপসংহার মহান মুক্তিযুদ্ধোত্তর বিজয়ে। বাঙালির ইতিহাসে বায়ান্ন এসেছিল, তাই একাত্তর এসেছে। ভাষা আন্দোলন এসেছিল, তাই স্বাধীনতা সংগ্রাম এসেছে, মুক্তিযুদ্ধ এসেছে, সর্বোপরি বিজয় এসেছে। যে চারটি বড় স্তম্ভের ওপর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার অন্যতম প্রধান হলো জাতীয়তাবাদ। আবার এ জাতীয়তাবাদের চেতনাবাদী প্রধানতম স্তম্ভটি হলো বাংলা ভাষা। যে কারণে বাংলাদেশ একটি জাতি রাষ্ট্র, তার মর্মমূলে আছে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির ত্যাগ এবং অর্জন আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বাঙালির অমর একুশে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় অভিষিক্ত। বাঙালিই প্রথম মানবজাতিকে বুঝিয়েছে তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অন্বেষণ এবং বিকশিত করার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হলো তার মাতৃভাষা।
অমর একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় উন্নীত করতে তাঁর এবং তাঁর সরকারের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। যে দায় ও দীক্ষা থেকে তিনি আপন মাতৃভাষার মহিমা বিকাশে কাজ করে যাচ্ছেন, সেই একই চেতনা থেকে বাংলাদেশের সব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ইনডিজিনাস ভাষাগুলোর মর্যাদা রক্ষা ও বিকাশে তিনি এবং তাঁর সরকার একইভাবে কাজ করে যাবেনÑ এ প্রত্যাশা সবার।
বাংলাদেশ বৈচিত্র্যের লীলাভূমি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কিংবা নৃতাত্ত্বিকÑ সকল বিচারেই। বং থেকে বাংলার কিংবা গঙ্গারিদ্দি থেকে বাংলাদেশের যে সহস্র বছরের ইতিহাস, তা বর্ণিল হয়ে উঠেছিল আর্য-অনার্য, দ্রাবিড়-অদ্রাবিড়, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান- বৌদ্ধসহ নানা জাতির, নানা বর্ণের, নানা ভাব-ভাষা ও ভাবনার মানুষের মিথস্ক্রিয়ায়। এখনও নানা প্রতিকূলতার ভেতরেও সে বর্ণিলতা, সে ঐক্য ও সংহতি লোপ পায়নি। যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করেছে আজকের বাংলাদেশ, তাতেও সব মানুষের ত্যাগ ও তিতিক্ষা রয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির জারকে জারিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিনির্মিত করতে হলে এখানে সর্বদাই একটি বহুত্ববাদী সমাজ ও সংস্কৃতি-কাঠামো গড়ে তোলার উদার স্পেস সৃষ্টি করতে হবে। আর সে জন্যে প্রয়োজন এ দেশে বসবাসকারী সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে, সব জাতিগোষ্ঠীকে, সব ভাষাভাষীকে তাদের নিজ নিজ ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে স্বতন্ত্র ও সম্মিলিতভাবে বিকশিত হতে দেওয়া।
এ সুবিশাল বৈচিত্র্যের ওপরই গড়ে উঠবে ঐক্য ও সংহতির সৌধ এবং সেটাই সার্থক গণতন্ত্রের, সার্থক জাতীয়তাবাদের, সার্থক সমাজতন্ত্রের এবং সার্থক ধর্মনিরপেক্ষতার নিদর্শন। ধর্ম, বর্ণ, জাতি কিংবা ভাষা, সংস্কৃতি যার যার- রকিন্তু বাংলাদেশটা তো সবার। এ সুসমন্বয় হোক ভাষা মাসের চেতনা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.