× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাঙালির অবিনাশী শিল্পপ্রেরণা

জয়নাব শান্তু

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:১৩ পিএম

বাঙালির অবিনাশী শিল্পপ্রেরণা

মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি- পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াময় তিনটি ডাক। মায়ের ভাষার প্রতি রয়েছে আমাদের জন্মগত শাশ্বত অধিকার। আমাদের জাতির নাম বাংলা, ভাষার নাম বাংলা, দেশের নাম বাংলাদেশ। আমাদের বাংলা ভাষার ইতিহাস হাজার বছরের হলেও ভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আমরা বাঙালিরাই একমাত্র জাতি, যাদের রক্ত দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাই আমাদের বাঙালি জাতীয় জীবনের একটি অন্যতম দিন। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি শীর্ষক গ্রন্থে সম্পাদকের ভূমিকায় লেখা হয়েছিল- কেবল পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। “দুনিয়ার মানুষ হকচকিত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের শক্তিতে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ভাষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের এই বিশ্ব-ঐতিহাসিক আত্মত্যাগে। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে, জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দুনিয়াজোড়া মানুষের যুগ যুগব্যাপী যে সংগ্রাম-একুশে ফেব্রুয়ারি তাকে এক নতুন চেতনায় উন্নীত করেছে।” ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে একটি নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী সত্তার নতুন বীজ বপন করেছে। বাঙালির স্বাধিকারের স্বপ্ন সঙ্ঘশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নতুন ঐক্য দান করেছে। জাতি হিসেবে বাঙালির এই ঐতিহাসিক আত্মপ্রকাশ পরে তাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। 

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ৫ ডিসেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় উর্দুকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করা হবে না এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তন সভায় পাকিস্তানের স্রষ্টা ও গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়। তাৎক্ষণিকভাবে সমাবেশে উপস্থিত ছাত্র-জনতা তার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে। তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের কঠোর দমননীতি সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নাগরিক মধ্যবিত্তের সীমানা অতিক্রম করে বৃহত্তর জনজীবনেও আলোড়ন তৈরি করতে সক্ষম হয়। ফলে আন্দোলন ক্রমাগত বিস্তৃতি লাভ করে। যার ফলে ১৯৪৮ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হবেÑ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

কিন্তু পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ও সামন্ত আদর্শপুত্র শাসকশ্রেণি ও তাদের দোসররা বাংলা বর্ণমালা, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে গঠিত বাংলা ভাষার সংস্কার কমিটির রিপোর্টে এই চক্রান্তের পূর্বাভাস পরিলক্ষিত হয়। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সরকারি সিদ্ধান্ত বিদ্যমান ছিল। আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে বাংলার পরিবর্তে আরবি হরফ প্রবর্তনের প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবে পরিণত হয়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। ওই ঘোষণার প্রচণ্ড আঘাতে রুদ্ররোষে জাগ্রত হয়ে ওঠে শৃঙ্খলিত বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী এক সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়। গণশক্তির ভয় ভীত-সন্ত্রস্ত সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে। সকাল থেকে সেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রদের স্লোগানমুখর মিছিল একের পর এক অগ্রসর হতে থাকলে বিকাল সাড়ে ৩টায় মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। ২১ এবং ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসকদের গুলিতে জব্বার, রফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকে নিহত এবং ১৭ জন আহত হলে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এই রক্তদানের প্রতিক্রিয়ায় বৃহত্তর জনজীবনে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তীব্ররূপ ধারণ করে। বলা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মুষ্টিমেয় ছাত্র-শিক্ষক বা বুদ্ধিজীবী বা মধ্যবিত্ত নাগরিক আন্দোলন ছিল না, বা তা শুধু শিক্ষাগত অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনও ছিল না। বাংলার ওপর সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক বিরাট ও ব্যাপক গণ-আন্দোলন হিসেবেই একে চিহ্নিত করা যায়।

নোয়াম চমস্কি ভাষাকে ‘জ্ঞানের মনোবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ভাষা আন্দোলন বাঙালির মর্মমূলে যে চেতনার উদগীরণ ঘটিয়েছিল, বাঙালির সংগ্রামী মানসিকতাকে যেভাবে জাগিয়ে তুলেছিল, সেই প্রতিবাদী চেতনা কেবল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের প্রেরণাই দেয়নি, তা বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় প্রস্ফুটিত হয়ে বাঙালির স্বাধিকার চেতনা ও সৃজনশীলতার পথকেও উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। বাঙালির সাহিত্যচর্চার পথে অবিনাশী প্রেরণা হয়ে ছিল এই লড়াইয়ের ইতিহাস। আর তাই বলা যায়, ভাষা আন্দোলন হলো বাঙালির বঞ্চনার পটভূমিতে আঁকা ‘অশ্রু-তরল রক্তরঙের লিপি’।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা