একটি সাঁওতালি কবিতা
‘সামান কওয়া : সমাজ জীউয়ী ডিগিমিগি
হায়রে হায়!
অপেরা যাঃ সমাজ দরে ঞুত গোয়ারো
দেহো দেহা অলক কড়া বিদ্যা দীউহে জেরেদপে আপেরেয়াঃ
সমাজ দরে মার্শাল তাবনপে।’ (লাগড়ে মেরেঞ)
বাংলা অনুবাদ
‘আর যেখানে যেসব সমাজ উজ্জ্বল আলো ঝরে
আর আমাদের সমাজ দ্যাখো অধিকারে ছাওয়া
ইশকুলে আজ চললে যারা তাদের কাছে বলি
দাও জ্বেলে দাও এই সমাজে বিদ্যার পিদ্দিম।’
মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই কত হৃদয়বিদারক তা বাঙালির চাইতে বেশি কেউ জানে না। শহীদ দিবস এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি তার মাতৃভাষার অধিকার সার্বিকভাবেই প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বহুভাষিক বাংলাদেশের অপরাপর জাতিসত্তার মাতৃভাষার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। অত্যন্ত মর্মান্তিক সত্য হলো, বাঙালি নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বৈরাচারের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। পারিপার্শ্বিক জাতিসত্তার সঙ্গে বাঙালি দখলদার শাসকের মতো আচরণ শুরু করে। আদিবাসী লোকসকল স্বাধীন দেশে পরাধীন জাতির মতো মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত রয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দশকের (১৯৯৫-২০০৪) কার্যক্রমসমূহের একটি ছিল শিক্ষা। কিন্তু সর্বজনীন শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মাতৃভাষা চর্চার অধিকার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এই অধিকার এখনও নিশ্চিত হয়নি।
বহুভাষিক বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও ৪৫টি আদিবাসী জাতিসত্তা আছে। সংখ্যায় এরা ২০ লক্ষাধিক। এই সংখ্যা সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতের মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, ‘১৯৯১ সালের জনসংখ্যা রিপোর্টও সঠিক নয়। তবুও ওই অনুযায়ী হিসাব করলে ২২ লক্ষ। কিন্তু ব্রিটিশ আমলের হিসাব অনুযায়ী গণনা করলে ৫০ লক্ষ।’ (জাতীয় প্রেস ক্লাব, ১৯.০২.২০০২)। এরা প্রত্যেকেই মাতৃভাষায় কথা বলে। আবার কারও কারও রয়েছে বর্ণমালা। কিন্তু তারপরও আদিবাসীরা নিজের ভাষায় মাকে মা বলে ডাকার রাষ্ট্রীয় অধিকার পায়নি বলেই শিক্ষা ক্ষেত্রে আদিবাসীদের অগ্রগতি কম। অবশ্য এক্ষেত্রে আরও কিছু অনুষঙ্গ যুক্ত রয়েছে। এখানেও অধ্যাপক আবুল বারকাতের মন্তব্যটি উল্লেখ করা যায়, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশে ৬০-৬৫ ভাগ বলা হচ্ছে স্বাক্ষর। ওই তথ্যও সত্য নয়। যদি তা সত্য হয়, তবে আদিবাসীদের সাক্ষরতার হার ১৮%, এ ক্ষেত্রে পুরুষ ১০% এবং নারী ৮%।’
আদিবাসীদের একটি বড় অংশের বসবাস তিন পার্বত্য জেলা- খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবান জেলায়। এই তিন পার্বত্য জেলায় ১১টি আদিবাসী জাতিসত্তার বসবাস। এখানে গত শতকের পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত সাক্ষরতার হার খুবই কম ছিল। কাপ্তাই জলবিদ্যুতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে দিশেহারা পার্বত্য আদিবাসীরা শিক্ষার্জনের পথে আত্মনিয়োগ করে। এক্ষেত্রে চাকমারা অগ্রগণ্য হলেও পরে তাদের দেখাদেখি মারমা এবং ত্রিপুরা জাতিসত্তার লোকসকল এগিয়ে আসে। কিন্তু অপরাপর পার্বত্য আদিবাসীদের মধ্যে লেখাপড়ার বিষয়টা তেমন দোলা দিতে পারেনি। মুরং জাতিসত্তার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ১৯৮০ সালে বান্দরবান সদরে ইউনিসেফের অর্থায়নে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই স্কুলের জন্য ইউনিসেফের বরাদ্দকৃত টাকাও যথাসময়ে ছাড় করানো যায়নি। এক দশক আগের এক জরিপ থেকে জানা যায়, ৯৬ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত পার্বত্য জেলা তিনটিতে ৯টি কলেজ, ৭৮টি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ১ হাজার ১৭৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। কিন্তু পরের এক দশকে এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আর বাড়েনি বরং কমেছে। এখানকার অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা একের অধিক নয়। পার্বত্য জেলা তিনটিতে সরকারি স্কুল-কলেজের দৈন্যদশা বর্ণনাতীত। পার্বত্য জেলাগুলোতে শিক্ষকদের বদলি করা হয় শাস্তিস্বরূপ। অন্তত এখানে বদলি হয়ে আসা সমতলভূমির শিক্ষকরা তাই মনে করেন। এমতাবস্থায় তাদের কাছ থেকে উন্নততর শিক্ষা প্রত্যাশা করা যায় না।
এই সমস্যা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, বাংলাদেশের অপরাপর আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও একই রকম মর্মান্তিক। আর এ সকল অভিজ্ঞতা শুধু আমার একার নয়, আমার মতো আরও যারা বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিসত্তার খবরাখবর রাখেন, তাদের সকলের অভিজ্ঞতাও যে অভিন্ন তা বিভিন্ন বক্তব্য বিশ্লেষণ, মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ আয়োজিত ‘মাতৃভাষার অধিকার ও বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজ’ শিরোনামের সেমিনারে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা ফজলে হোসেন বাদশার একটি মন্তব্যে আদিবাসীদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। তিনি আক্ষেপ করেই বললেন, ‘রাজশাহীতে এমন রেস্টুরেন্ট আছে, যেখানে লেখা আছেÑ এখানে আদিবাসীদের কাছে খাদ্য বিক্রি করা হয় না।’ (জাতীয় প্রেস ক্লাব, ১৯.০২.২০০২)। এমন অবস্থা যেখানে বিরাজমান, সেখানে আদিবাসীদের শিক্ষার পরিবেশ বিশেষ করে তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাকে নিশ্চিত করা কতটুকু সম্ভব তা অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সরেণের সঙ্গে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে গিয়েছিলাম। এ উপজেলার ৮০ ভাগ লোকই আদিবাসী। এখানকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কিন্তু অল্পসংখ্যক বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলেই অবস্থিত। শিক্ষকের সকলেই বাঙালি। বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার ৬০ ভাগ। এর মধ্যেই ৫০ ভাগ হলো আদিবাসী। প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘ওরা স্কুলেই আসে না। পড়বে কী?’ এতক্ষণে মনে পড়ে যায় মহাশ্বেতা দেবীর ‘চট্টীমুণ্ডা’ ও তার ‘তীর’ বইতে লেখা একটি লাইন, ‘তুই যদি ভালো গরমেন্ট হবি, তবে আমার এত দুঃখ কেন?’ মহাশ্বেতা দেবীর কলমে উঠে আসা এই মন্তব্যটি আজ আর শুধু মুণ্ডাদের বেদনাহত আর্তি নয়, বাংলাদেশের ৪৫টি আদিবাসী জাতিসত্তার সকলেরই বুকভাঙা আর্তনাদ।
স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষার ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারণের কারণে বাংলাদেশে বসবাসকারী মাতৃভাষা বাংলা নয়, এমন জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তীকালে সেই জাত্যভিমানে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে তাকে আরও রক্তাক্ত করে তোলা হয়। ফলে এদেশে কখনোই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি শাসকশ্রেণির সহমর্মিতা লাভ করেনি। স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার মতো প্রয়োজনীয় জল-হাওয়া পায়নি। এরই প্রভাব পড়েছে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাসহ সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায়। শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে অনাগ্রহ এবং ধারণাগত সীমাবদ্ধতা। পাঠ্যপুস্তকেও আদিবাসীদের জীবনযাত্রা-কৃষ্টি-সংস্কৃতির কোনো প্রভাব-প্রতিফলন নেই। রয়েছে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং শিক্ষার পদ্ধতিগত সংকট। এ ছাড়া আছে ভাষা সমস্যা। আদিবাসী শিক্ষার্থীরা যেমন বাঙালি শিক্ষকদের ভাষা বুঝতে পারে না, ঠিক তেমনি শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের ভাষা এবং আচরণের সঙ্গে অভ্যস্ত নয়। ফলে শিক্ষালয়ে পাঠদানের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ছাড়াও জাতীয় পাঠ্যসূচিতে আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-প্রথা সম্পর্কে বিকৃত ধারণা রয়েছে। যা কিনা পাঠের সময়ে আদিবাসীদের বেদনাহত করে। এ সকল নানাবিধ কারণে অপরাপর বিষয়ের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও আদিবাসী লোকসকল বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে অচ্ছুতই থেকে যাচ্ছে।
ভিয়েতনামের অবিচ্ছিন্ন জাতীয় সাংস্কৃতিক ধারা থেকেও আমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারি। এখানে ৫৪টি জাতিসত্তার লোকসকল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে। সাধারণভাবে সর্বত্র ভিয়েতনামি ভাষার প্রচলন থাকলেও সকল জাতিসত্তার নিজ নিজ ভাষা এবং সংস্কৃতি অধিকার অক্ষুণ্ন রয়েছে। এখানে জাতিসত্তাসমূহ নিজ নিজ ভাষায় কথা বলে। নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি চর্চায়ও কোনো বাধা নেই। সরকার এ সকল ভাষা ও সংস্কৃতি লালন ও বিকাশে সার্বিক সহযোগিতা করছে। এখানে সরকারিভাবেই প্রতিটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এত ভিন্নতা সত্ত্বেও এখানে জাতিগত কোনো বিরোধ নেই। আছে বহিরাগত শক্তি প্রতিরোধের সম্মিলিত প্রত্যয়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে বঙ্গলিপিতে ককবরক ভাষায় আদিবাসীদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ত্রিপুরায় বসবাসকারী ত্রিপুরা, নোয়াতিয়া, রিয়াং, জমাতিয়া, কলই এবং রূপিনী জাতিসত্তা ওই ককবরক ভাষার অনুসারী। পশ্চিম বাংলায় ১৯৭০ সালে সাঁওতালদের জন্য এ রকম একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনাগত মতপার্থক্যের জন্য তা বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে সাফল্য লাভ করে। বাংলাদেশের এই উদ্যোগের সঙ্গে বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে আমার সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করতে গর্ববোধ করছি। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ গ্রামীণ ট্রাস্টের দারিদ্র্য বিমোচন গবেষণা কর্মসূচির অর্থায়নে সাঁওতাল শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করে। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার বর্ষাপাড়া গ্রামে ১৯৯৯ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম সাঁওতাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার এটাই ছিল প্রথম উদ্যোগ। ফলে ধনুক ধরা আদিবাসী সাঁওতাল শিশুর হাতে বই ওঠে। পরবর্তীকালে এখানে আরও চারটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সাঁওতাল শিশুরা প্রথম যেই পুস্তক হাতে পায়, ‘গিদরৌ কোয়া: পৗহিল পুথি’ অর্থাৎ প্রথম পাঠ। প্রথম বই হাতে পেয়ে সাঁওতাল শিক্ষার্থীরা আনন্দের আতিশয্যে সমস্বরে উচ্চারণ করে, ‘অ-তে অলঃ পড়হাঃ চেদ মা বোন, আ-তে আঃ সার মেনাঃ তি ঞ’ অর্থাৎ লেখাপড়া শিখব মোরা, তীর ধনুক আছে আমার। এখানে মূলত সাঁওতাল বর্ণমালা শিক্ষা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মতোই সাঁওতাল ভাষায়ও স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ আছে। তবে এখানে অতিরিক্ত দুটি স্বরবর্ণ ও ছয়টি ব্যঞ্জনবর্ণ আছে। আর আছে একটি অতিরিক্ত চিহ্ন। এটি হলো বাংলা (ৗ, ঔ চিহ্ন) চিহ্নের শেষ অংশ ৗ। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ এটিকে বঙ্গলিপিতে সাঁওতালি ভাষা বলছে। গ্রামীণ ট্রাস্টের অর্থায়নে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সাঁওতাল শিশুদের স্কুলগামীকরণের লক্ষ্যেই প্রথম বইটি রচনা করে। অতঃপর তারা বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে একটি লেখক প্যানেল তৈরি করে। এখানেই আমি আমার নিজস্ব সম্পৃক্ততা খুঁজে পাই এবং নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজেকে ঋদ্ধ করি। এ প্যানেলে সাঁওতাল ভাষা বিশেষজ্ঞও ছিলেন। সম্মিলিত উদ্যোগে প্রথমে সাঁওতাল ভাষায় রূপকথার বই ‘সেবেলে সড়ম বিসীবোন আজ্ঞুম’ লেখা হয়। পরে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সাঁওতালি ভাষায় সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ বিষয়ে একাধিক পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয়। ফলে সাঁওতাল শিশুরা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ভাষার পরিবর্তে মূল ভাষা হিসেবে সাঁওতালি ভাষা শেখে। অবশ্য তারা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকেও গ্রহণ করে। যাতে পরবর্তীকালে মূলধারায় শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়। আদিবাসী জনসমাজে শিক্ষার বিস্তার এবং তাদের নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি সাঁওতাল ভাষায় প্রণীত বইয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে ছিল, আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষা এবং তাদের এদেশের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করে বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটানো।
এ সকল সাঁওতাল স্কুল উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রের মতোই পরিচালিত হয়। একজন শিক্ষক ৩০ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করেন। শিক্ষালয়ের সকল শিক্ষকই সাঁওতাল নারী। প্রথম শিক্ষালয়ের শিক্ষক হলেন বর্ষাপাড়া গ্রামেরই দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী পরীটুডু। দশম শ্রেণির পর তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই সাঁওতাল স্কুল তাকে আবার উদ্যমী করে তোলে। পরীটুডু এখন স্বপ্ন দেখছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের, একই সঙ্গে সাক্ষর করে তুলবে নিজ জনগোষ্ঠীর সকল শিশুকে। একদিন যেখানে অভিযোগ ছিলÑ সাঁওতাল শিশুরা স্কুলে যায় না, সেখানে আমরা এসে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। সাঁওতাল শিশুরা স্কুলে অনুপস্থিত থাকে না। অবশ্য এই স্কুল জাতীয় আদিবাসী পরিষদ প্রতিষ্ঠিত স্কুল, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগই বলে দেয়Ñ ভারত, ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশেও আদিবাসীদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব। বহুদিন আগেই জেনেছিলাম চাকমা বর্ণমালা কম্পিউটারে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চাকমা ভাষায় গল্প, কবিতা, নাটক লেখা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছিলেন, ‘চাকমা ভাষায় উপন্যাস চাই।’ তাও লেখা হয়েছে। কিন্তু তারপরও চাকমা ভাষাভাষীদের ভাষাগত বেদনার অবসান হয়নি। তারা মাতৃভাষার নাটক করে প্রত্যেক বিযু উৎসবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশাসনের কাছ থেকে এ জন্য অনুমতি নিতে গেলে আয়োজকদের নাটকের পাণ্ডুলিপির বাংলা অনুবাদ করে দিতে হয়। কিন্তু চাকমা জাতিসত্তার লোক সকলের প্রশ্ন, যারা চাকমা ভাষা বোঝে না, তারা আমাদের দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না কীভাবে অনুধাবন করবে? প্রাজ্ঞজনদের হয়তো এক্ষণে সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথাটি স্মরণে আসবে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। এদেশের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। তাই আমাদেরও উচিত, বহুভাষিক দেশ বাংলাদেশে আদিবাসীদের ভাষার অধিকার আর উপেক্ষিত থাকবে না। তারাও আমাদের মতো মাতৃভাষায় মাকে মা বলে ডাকতে পারবে। নিজস্ব মাতৃভাষায় সকল আদিবাসী প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাবে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের বেসরকারি উদ্যোগের আলোকে সরকার যদি এগিয়ে আসে, তবেই একটি সমন্বিত শিক্ষা কর্মসূচির আলোকে সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পাবে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত আর সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব হবে বহুভাষিক বাংলাদেশে নিরক্ষরতামুক্ত, পারস্পরিক সুসম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন জাতিসত্তার পৃথক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তোলা। অন্যথায় লেখক আহমদ ছফার উদ্ধৃতিই সত্য বলে গণ্য হবে, ‘আমরা মুখে যা-ই বলি না কেন, এ দেশটি আসলে পূর্ব পাকিস্তানই রয়ে গেছে। এটাকে সত্যিকারের বাংলাদেশ বানাতে গেলে একটি সেক্যুলার সমাজ, একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র তৈরি করার চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে এর বাংলাদেশ নাম সার্থক হবে।’ (আহমদ ছফা, বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র, পৃষ্ঠা-১৬)। লেখক আহমদ ছফার মন্তব্য ভুল প্রমাণ করতে হলে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে শিক্ষা বিষয়ে আদিবাসীদের তিন দফা দাবিসমূহ উল্লেখ করছি :
১. আদিবাসীদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
২. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে;
৩. শিক্ষাক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা জোরদার করা, দক্ষতা বৃদ্ধি বা পেশাগত প্রশিক্ষণে আদিবাসীদের অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।
লেখক : আদিবাসী অধিকারকর্মী
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.