× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা চর্চা

কুদরত-ই-হুদা

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০২:০৮ এএম

বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা চর্চা

খবর-প্রতিবেদনগুলো আমি দেখেছি। আমার মতো অনেকেই দেখেছেন নিশ্চয়ই। এইসব খবর-প্রতিবেদনগুলোর শিরোনাম সাধারণত এমন থাকে, ‘বহির্বশ্বে বাংলা ভাষার চর্চা’ বা ‘বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ছে।’ এই ধরনের লেখাপত্র ও প্রতিবেদন সাধারণত ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ২০১৭ সালের ২১শ ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদন দেখলাম। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘৪ মহাদেশের ৩০টি দেশের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে।’ এহেন খবর আমাদের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক ও পুলকজাগানিয়া তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মাতৃভাষার ‘বিশ্বজয়ের’ খবর যাকে গর্বিত করে না সে তো নরাধম; ‘সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’!

পৃথিবীর খুব গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা-শিক্ষার বন্দোবস্ত আছে। আছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণার জন্য ব্যবস্থা। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অনেক বিদেশি শিক্ষক-অধ্যাপক-গবেষক বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ রকম অন্তত ডজনখানেক অধ্যাপক-গবেষকের নাম বলা যাবে। জাতীয়তাবাদী আবেগকে খুব যত্নে লালন করেন বাংলাদেশের এমন অনেক বাঙালি শুনে আনন্দে আত্মহারা হবেন যে সারবান, বেইজিং, শিকাগো, মেলবোর্ন, দিল্লি, লন্ডন, হার্ভার্ড, মন্ট্রিয়ল, হাইডেলবার্গ, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বাঘা বাঘা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষাশিক্ষা ও সাহিত্য গবেষণার সুবন্দোবস্ত আছে। 

কিন্তু এসব ‘পুলকসঞ্চারী’, ‘গর্ব’ করার মতো খবরের মধ্যে অন্তত দুই তরফা অস্পষ্টতা আছে। একটা অস্পষ্টতা হলো এই যে, আমরা জানি না ওসব জায়গায় লোকেরা কেন ও কী নিয়ে কাজ করে। দ্বিতীয় তরফের অস্পষ্টতা অনেকটা লালনের গানের মতো। লালনের একটা গানে তিনি বলেছেন, ‘ও সাঁই নিকট থেকে দূরে দেখা/যেমন কেশের আড়ে পাহাড় লুকায় দ্যাখ্ না’। বাংলা ভাষার ঘরের মধ্যে থেকে আপনি যখন দূর-দ্বীপবাসের বাংলা চর্চা দেখে মুগ্ধ হন তখন আপনার দায়িত্বের পাহাড়টা আড়ালে পড়ে যায়। আপনার নিজের দেশে বাংলা ভাষাটার কী অবস্থা তা আপনি দেখতে পান না। জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্য যে অন্ধত্ব দরকার হয় আপনি সেই অন্ধত্বের শিকার হন। এবং নিজেকেই দেখতে পান না। এই দেখতে না পারার ফলে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। আসলে আপনি আপনার দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে থাকেন। কিন্তু ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে!’ থাকে না। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করা যাক।

প্রথম অস্পষ্টতা নিয়ে কথা পাড়া দরকার। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বাংলা ভাষাশিক্ষা দেওয়া হয় সেখানে কারা ভাষা শেখে? চোখ বুজে বলা যায়, অধিকাংশই বিদেশি লোকজন। এসব লোক সেখানে বাংলা ভাষা শেখে তাদের অতিরিক্ত ভাষাশিক্ষার অংশ হিসেবে। অতিরিক্ত ভাষা হিসেবে বাংলাকে বেছে নেওয়ার একশটা কারণ আছে। এর মধ্যে একটা কারণ এই যে, এই ভাষা একটা বড় পণ্য বাজারওয়ালা দেশের ভাষা। আমরা ভাষাভাষীর দিক থেকে বাংলাকে যে পৃথিবীর সপ্তম ভাষা বলি তা আামাদের কাছে যতই শ্লাঘার বিষয় হোক না কেন, বিশ্বের মানুষের কাছে তা মূলত একটা বড় বাজার। এই বাজারে নানাভাবে যুক্ত থাকতে হয় পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলোকে। বাংলাদেশ নিয়ে পৃথিবীর বড় বড় দেশের কামড়াকামড়ি-হুমড়োহুমড়ির আর কী কারণ থাকতে পারে বাজার আর গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়া! ফলে পৃথিবীর বড় বড় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই ভাষার একটা কদর থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এতে বাংলা ভাষার চর্চা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে এবং বাংলা ভাষা স্বাস্থ্যবান হচ্ছেÑ এমনটি মনে করার কোনো কারণ নাই। কারণ, ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বাংলা ভাষাশিক্ষা দেওয়া হয় তা নিশ্চয়ই কাজ চালানোর শিক্ষা। এই ধরনের শিক্ষানবিশ বিদেশিদের দ্বারা কখনও একটি ভাষার শক্তি বাড়ে না। ভাষা শক্তি সঞ্চয় করে মাতৃভাষীদের কাছ থেকে। নিজের দেশে বহুবিচিত্র কাজে ব্যবহৃত হতে হতে একটি ভাষা অধিকতর শক্তিমান হয়ে ওঠে। কোনো বিদেশির ভাঙা ভাঙা কাজ চালানো বাংলা ব্যবহারের ভেতর দিয়ে বাংলার শক্তি আগেও বাড়েনি, এখনো বাড়ছে না, ভবিষ্যতেও বাড়বে না।

ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসবিষয়ক গবেষণা হয়। এই গবেষণা যখন কোনো অবাঙালি করে তখন অবশ্যই তিনি বাংলা ভাষায় গবেষণা করেন না। এমনকি ওইসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বসে কোনো বাঙালিও বাংলায় কাজ করেন না। করেন ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায়। এই গবেষণার সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নতুন নতুন প্রবণতা বা দিক আবিষ্কারের একটা সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে। এটা খুবই ভালো ব্যাপার। কিন্তু অন্য ভাষায় বাংলা সাহিত্য ও ভাষার গবেষণার সঙ্গে বাংলা ভাষার অভ্যন্তর শক্তি বৃদ্ধির তো কোনো সম্পর্ক নাই। এটা অনেকটা ইংরেজি বা পর্তুগিজ ভাষায় বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনার মতো। এতে বরং যে ভাষায় ওই চর্চাগুলো হয়ে থাকে, সেই ভাষাই সমৃদ্ধ হয়। ওই ভাষা অপরিচিত চিন্তা, ভাষা, সাহিত্য ও বিষয়কে মোকাবিলা করতে গিয়ে গায়-গতরে ও চৈতন্যে আরও প্রকাশক্ষম হয়ে ওঠে। তাতে বাংলা ভাষার খুব একটা কিছু যায়-আসে না। তা ছাড়া ওইসব গবেষণার সঙ্গে জ্ঞানের আধিপত্যেরও একটা গভীর সম্পর্ক আছে। আধুনিক যুগে উপনিবেশ তো আর জমি দখল করে বিস্তার করার রেওয়াজ নাই। ফলে জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যও এক ধরনের উপনিবেশ। সেই উপনিবেশের বিস্তারই ঘটে ওইসব প্রাচ্যতাত্ত্বিক গবেষণার মধ্য দিয়ে। আমাদের তো অজানা নয় যে, বাংলাদেশের সাহিত্য ও ইতিহাসের অনেক তত্ত্ব আসে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেসবের জাবর কাটনেওয়ালা মাত্র। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিস্তার সম্পর্কে যেসব ইতিহাস চালু আছে তার অধিকাংশই এসেছে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে। আমেরিকার ইটন তো এই ব্যাপারে নমস্যে পরিণত হয়েছেন! আমি বলছি না বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশিদের গবেষণার মূল্য নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু এর সঙ্গে ভাষার উন্নতির কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। বরং জ্ঞানতাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদিতার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক খালি চোখেও দেখা যায়। ফলে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক চর্চার মধ্যে জাতীয়তাবাদী আবেগ বোধ করার ও গর্বিত হওয়ার বড় কোনো কারণ নেই। এর চেয়ে সেটা বড় অহংকারের ব্যাপার হতো, যদি বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা আর সাহিত্য নিয়ে বড় বড় গবেষণা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় মানসম্মত গবেষণা খুব কমই হয়েছে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক গবেষণার জন্য বাংলা ভাষাটিকে অনেক ক্ষেত্রে সাবালক বলে বিবেচনা করা হয় না। ইংরেজির শ্রীচরণই আজও ভরসা!

বিদেশে বাংলা চর্চার এ তো গেল প্রথম তরফের গোমরের ব্যাপার। দ্বিতীয় তরফের গোমর বা অস্পষ্টতা আরও ভয়ংকর। এটাকেই আমি বলেছি, ‘কেশের আড়ে পাহাড় লুকায় দ্যাখ্ না’। আমরা যখন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে বাংলা ভাষা চর্চার ব্যাপার দেখে আপ্লুত হই তখন নিজের ভাষার প্রতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যটা আড়ালে পড়ে যায়। তৃপ্তি ও গর্বের আড়ালে এই সত্য বেমালুম ঢাকা পড়ে যায় যে, আমাদের মাতৃভাষার প্রতি আমরা যথেষ্ট সুবিচার করতে পারিনি। রাষ্ট্রের সব কাজে এই ভাষাটির প্রতিষ্ঠায়ন ঘটাতে পারিনি। নিজ দেশে বাংলা ভাষাটিকে আমার আজও শিক্ষা ও গবেষণার বাহন করে তুলতে পারিনি। সব কাজের উপযোগী ও সক্ষম করে তোলার জন্য ভাষাটির বহুবিধ ব্যবহার কায়েম করতে পারিনি। ভাষাটিকে দিন দিন গরিবের ভাষা করে তুলছি। অথচ গরিবের ভাষা বলে একদিন এই ভাষাটিকে উপেক্ষা করায় আমরা পথে পথে তাজা ফুল ফুটিয়েছিলাম। নিজেদের এই দীনতাকে ঢাকার আশ্রয় হিসেবে আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই বিদেশে বাংলার প্রসার হচ্ছে বলে তৃপ্ত হতে চাইছি এবং হচ্ছিও। কিন্তু একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার, যে প্রদীপ নিজের ঘরে আলো জ্বালাতে পারে না সে বিশ্বে জ্বালাবে কী করে!

২১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এটি নিঃসন্দেহে বাঙালির জন্য একটা বড় শ্লাঘার ব্যাপার। কিন্তু নিজের দেশে নিজের ভাষার প্রতিষ্ঠায়ন ঘটাতে না পারলে সেই লজ্জারও একটা আন্তর্জাতিক রূপ দাঁড়ায় বৈকি! একেই বলে, লোকে শুনলে কী বলবে! ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলার চর্চা নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে কৃত্রিম ও মেকি মর্যাদাবান সাজার চেয়ে নিজের দেশে ভাষাটিকে মর্যাদাবান করে তোলা একান্ত জরুরি। এই সুমতি আমাদের মধ্যে যত দ্রুত দেখা দেয় ততই বাংলা ভাষাটির জন্য যেমন তা শুভকর হবে তেমনি জাতি হিসিবেও আমাদের জন্য মর্যাদাকর হবে। অন্যথায়, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা নেহাতই হীনতার পরিচায়ক বলে মনে করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা