সৌমিত্র শেখর
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০২:১৫ এএম
সংখ্যার যে জোর তা এখন বাংলার দখলে। পৃথিবীতে মাতৃভাষার বিবেচনায় বাংলার স্থান চতুর্থ। আড়াই হাজারের ওপর ভাষার মধ্যে চতুর্থ স্থান পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এই ভাষা বিকাশের একটা ইতিহাস আছে, আছে রাজনীতিও। বাংলাভাষী অঞ্চলে বাংলা কখনও রাজভাষা ছিল না তা নয়। কিন্তু সে ত্রিপুরায়। আমাদের এসব এলাকায় যখন পারসি রাজভাষা, তখন ত্রিপুরারাসী অবাঙালিরাই মূলত বাংলাকে রাজসভায় সমাদর করেছেন, বাঙালি হয়ে আমরা পারিনি।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে দেখা যাবে লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় ভাষা ছিল সংস্কৃত। কবি জয়দেব বাঙালি হলেও সংস্কৃত ভাষায় অমর কাব্য গীতগোবিন্দম্ লিখেছেন। মুসলিম শাসনামলে পারসি ভাষা রাজভাষা হিসেবে গৃহীত হয় এবং পরে ইংরেজ শাসকদের সময় ইংরেজি দখল করে নেয় পারসির স্থান। ১৯৪৭ সালের পর ইংরেজির বদলে আসে উর্দু। উর্দুর পাশে বাংলার স্থান করে নেওয়া যে সহজে হয়নি ১৯৫২ সাল তার প্রমাণ। পরে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সরকারের মূল কাজগুলো হয়েছে উর্দু বা ইংরেজিতেই। এখানে শুধু সংস্কৃত বা উর্দুর দোষ দিয়ে লাভ নেই। এসবগুলোই ছিল সে সময়কার এলিট শ্রেণির ভাষা। জনগণনা হয়নি সে সময়। বিজ্ঞজনেরা অনুমান করে বলেন, সনাতন এলিটরা যখন রাজক্ষমতায় তখন সংখ্যায় মাত্র ১৪% হওয়া সত্ত্বেও সংস্কৃতকেই তারা নিজেদের অর্থাৎ শাসকদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছে। কোটি কোটি প্রাকৃতভাষী ও তাদের ভাষা ছিল সুবিধাবঞ্চিত। তারা সংস্কৃত ভাষা শিখবার অধিকার বা সুযোগ কোনোটাই পায়নি। সারা ভারতের ২% মানুষও পারসি লিখতে-পড়তে পারত না। যেহেতু মুসলিম শাসকরা সে ভাষা জানত, সে কারণে এলিট বা শাসকদের জন্য এবং সাধারণ থেকে দূরত্বে থাকবার জন্য পারসিকে ভারতের রাজভাষা করা হলো। ইংরেজরা এসেছিল আগেই। তারপরও একটু বিলম্বে, ১৮৩৫ সালে তারা ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে গ্রহণ করল। তখন সারা ভারতে ইংরেজি জানা ভারতীয়দের হাতে গোনা যেত। এলিটরা এভাবেই সংস্কৃত>ফারসি>ইংরেজি>উর্দুতে এসে দাঁড়াল। মাত্র ৬% মানুষের ভাষা উর্দু যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হলো তা তো এলিটদের ভাষা ছিল বলেই। আজ স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষিত রাষ্ট্রভাষা বাংলা বটে, কিন্তু এলিটদের ভাষা বা শাসকদের ব্যবহৃত ভাষা বাংলা নয়।
বাঙালিরা ১৯৭১-এর আগে রাজা বা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল না বলে বাংলা রাজভাষা বা রাষ্ট্রভাষা হতে পারেনি। যারা ছিল তারা, নিজেদের সুবিধার ভাষাকে সে মর্যাদা দিয়েছে। বাংলা এবং বাঙালি বড় হয়েছে পথে পথে। তবে ভাষার ক্ষেত্রে একটা বিকাশশীলতা ঘটে রাজপ্রাসাদের বাইরেই। এর একটা কারণ বাঙালি, এই দুঃসময়েও কিছু দেশপ্রেমিক সন্তান জন্ম দিয়েছিল। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঠাকুরবাড়ির কয়েকজন, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ প্রত্যেকেই এলিটদের ভাষা খুবই ভালো করে শিখেছিলেন। রামমোহন রায় তো মিরাতুল আকবার নামে একটি পারসি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। এলিটদের ভাষা শিখে এঁরাও যে ভেতরে ভেতরে সংস্কারপ্রবণ হয়ে পড়েননি তা প্রতিজ্ঞা করে বলা যাবে না। তবে প্রচণ্ড স্বজাত্যচেতনার জন্য তাঁরা প্রত্যেকে বাংলা ভাষা বিকাশে অবদান রাখেন। এ অবদান তাঁরা না-ও রাখতে পারতেন। যদি না রাখতেন, লেখার ভাষা হিসেবে বাংলার অগ্রগতি নিশ্চিতভাবেই আরও বিলম্বে ঘটত। কিন্তু তাঁরা যে-যাঁর অবস্থান থেকে অবদান রেখেছেন এবং রাখতে গিয়ে তাঁদের চেতন-অবচেতনে বাংলা ভাষার লিখিত বিকাশধারায় একটি এলিটীয় ছাপ এসে পড়েছে। কেননা, যাঁরা লিখেছেন এবং যাঁদের জন্য লেখা হয়েছে তারা শ্রেণিগত দিক থেকে একই কাতারভুক্ত। শিক্ষার আলো তখনও ছড়ায়নি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও ভারতের সাধারণ শিক্ষা বিস্তার ৫% মানুষকে স্পর্শ করার মতো ছিল না।
বাংলা ভাষায় গণমানুষ বা গণমানুষের জন্য বাংলা ভাষা- এ জাতীয় কথা তাই ভিত্তি পেতে সময় লাগে। ‘ক্ষমতা’ খুবই শক্তিশালী একটি ধারণা। রাষ্ট্রক্ষমতায় গণমানুষের প্রতিনিধি গেলেই হবে না; পুরো ব্যবস্থাকে তাদের অনুকূলে না আনা গেলে গণমানুষের ভাষা পথে পথেই থেকে যাবে। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি ক্ষমতা নেওয়ার পর ১৯৪৭ পর্যন্ত ১৮২ বছরেও ইংরেজরা শতকরা পাঁচজন ভারতবাসীকে যেখানে সাধারণ শিক্ষাই দিতে পারল না, সেখানে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর মাত্র ১২ বছরে পুরো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রাশিয়াতে গেলেন তখন সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থাই তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল। কারণ মাত্র এক যুগের মধ্যে রাশিয়ার সব পাল্টে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে যে লেখাপড়ার ধারার প্রবর্তন করেছেন তা কিন্তু সোভিয়েত ধাঁচের আনুষ্ঠানিকতার শৃঙ্খলহীন শিক্ষা। রাশিয়ার শিক্ষা নিয়ে তিনি লিখেছেন : ‘রাশিয়ায় গিয়েছিলুম ওদের শিক্ষাবিধি দেখবার জন্য। দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছি। আট বছরের মধ্যে শিক্ষার জোরে সমস্ত দেশের লোকের মনের চেহারা বদলে দিয়েছে। যারা মূক ছিল তারা ভাষা পেয়েছে, যারা মূঢ় ছিল তাদের চিত্তের আবরণ উদ্ঘাটিত, যারা অক্ষম ছিল তাদের আত্মশক্তি জাগরূক, যারা অবমাননার তলায় তলিয়ে ছিল- আজ তারা সমাজের অন্ধকুঠুরি থেকে বেরিয়ে এসে সবার সঙ্গে সমান আসন পাওয়ার অধিকারী। এত প্রভূত লোকের যে এত দ্রুত এমন ভাষান্তর ঘটতে পারে, তা কল্পনা করা কঠিন। এদের এক কালের মরা গাঙে শিক্ষার প্লাবন বয়েছে দেখে মন পুলকিত হয়।’ (রাশিয়ার চিঠি : ৬)
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের তুলনাটা চলে এ কারণে যে, দুটো দেশই বড়, দুটোই কৃষিপ্রধান (অন্তত সে সমস্ত ছিল); বিপ্লবের এক যুগের মধ্যে রাশিয়ায় যা সম্ভব হয়েছিল ইংরেজদের পৌনে দুশো বছর বা মুসলিমদের সাড়ে পাঁচ শ বছরে তা ভারতে শতাংশ মাত্র সম্ভব যে হয়নি তার কারণ, শাসক হিসেবে তারা এলিট, গণমানুষের বিবেচনা তাদের ছিল না। রাশিয়ায় শিক্ষার সঙ্গে ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। কারণ ভাষা শিক্ষার বাহন। বৃহত্তর ভারতে শিক্ষা বা ভাষা কোনোটাই ছিল না পৃষ্ঠপোষকতা। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের এক বছরের মধ্যেই যে সংবিধান পাওয়া গেল তাতে লিখিতভাবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি মিলল বটে, কিন্তু বাস্তবে সে ভাষার সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ সুসম্পন্ন হলো না। আর সে ভাষার সঙ্গে গণমানুষর সম্পৃক্ততা তো থাকলই না। কেন?
প্রথমত বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় গণমানুষের অভিষেক ১৯৭১ সালের পরও হয়নি বলে। দ্বিতীয়ত যেটুকু বাংলার প্রচলন দেখা যায় তা বাঙালি এলিটভাবাপন্ন মানুষের ভাবনা সৃজিত ভাষা বলে। রাশিয়ায় হতে পেরেছিল, আমাদের দেশে হয় না। গণশিক্ষার প্রসার। কেন? প্রধান কারণ গণশিক্ষা দেওয়া হয় এলিটদের ভাষায়। শিশুদের যেমন শিশুদের মতো করে বোঝাতে হয়, তবে তারা বোঝে, সাধারণ মানুষকেও তাদের ভাষায় শিক্ষা দিতে হয়, তাহলে শিক্ষাটা তাদের কাজে লাগে। আমাদের দেশে কোনো সময় গণমানুষের ভাষাকে সমাদর করা হয়নি, না সাহিত্যে, না রাজনীতিতে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তো নয়ই। এখন ইংরেজির দাপট বলা হচ্ছে : বিশ্বায়ন- তাই। বলি, কখন ছিল না এ দাপট- সেই ১৭৬৫-এর পর থেকে? এখন স্বাধীন দেশে ইংরেজির প্রসারকে নিশ্চিত করতে বিশ্বায়নের কথা বলা হচ্ছে। প্রাচীন এলিটরা বলতেন, সংস্কৃত ভাষা শেখা যাবে না, এতে দেবতা অসন্তুষ্ট হবেন, শিখলে গণমানুষকে শাস্তি পেতে হবে। নব্য এলিটরা ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বলছেন, ইংরেজি শেখা যাবে। তবে শিখতে হলে এত হাজার টাকা টিউশন ফি দিতে হবে, এত লক্ষ ডোনেশন, মাসে মাসে প্রাইভেট টিউটরকে এত হাজার! টাকার অংক শুনে নিম্নবিত্তরা তো বটেই, মধ্যবিত্তদেরও মাথায় হাত। তাই ইংরেজি শিক্ষা বা এ যুগের এলিটদের ভাষাচর্চা একটি শ্রেণির মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। এলিটরা তাদের ভাষা ছাড়ছেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে গণমানুষের ভাষা থেকে এভাবেই এলিটরা রাষ্ট্রকে পৃথক করে নিয়েছেন বা রাষ্ট্রে গণমানুষের ভাষার স্থান দেননি।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে বাংলা ভাষার যে চর্চা ও বিকাশ, অন্তত লিখিত ক্ষেত্রে ঘটেছিল তাতে, আলালের ঘরের দুলাল-এর ভাষা বা হুতোম পেঁচার নকশার ভাষা সমাদর পেল না। এর কারণ দুটোই আরোপিত। এ গ্রন্থ দুটোর লেখকদের কেউ এ ভাষায় কথা বলতেন না। ফলে ভাষাচয়নে সমস্যা ছিল। আর যাদের জন্য লেখা হলো বই দুটো, তারাও এ ভাষায় কথা বলতেন না। শুধু জনতার ভাষায় লিখলেই চলে না, জনতা যদি শিক্ষিত না হয় এবং সে রচনা গ্রহণ না করে, তাহলে এর সমৃদ্ধি ঘটে না। অতএব, আগে জনতার শিক্ষা বিস্তার এবং জনতার ভাষা সম্প্রসারণ। কিন্তু লেখকরা তো আর জনশিক্ষা বিস্তারের জন্য গ্রামে গ্রামে মাঠকর্মী হবেন না। তাঁদের কাজ কী?
যাঁরা লেখক হবেন তাঁরা সমাজে অগ্রবর্তী পথিকৃতের মতো। শিক্ষা-সৃজন না করলে অন্যদের থেকে লেখকের পার্থক্য কোথায়? তবে লেখকের দায়বদ্ধতা বা ‘কমিটমেন্ট’ বলেও একটা কথা আছে, এটাও তাঁকে মানতে হবে। যিনি প্রকৃত লেখক তিনি সব শ্রেণির মানুষের জন্যই লিখবেন, খণ্ডিত জনগোষ্ঠীর জন্য নয়। তাই লেখার ক্ষেত্রে তাঁর একটি সর্বজনবোধ্য ভাষারীতি অনুসরণ করা শ্রেয়। সর্বজনবোধ্য ভাষারীতি আসলে গণমানুষের ভাষারীতির কাছাকাছি। কারণ গণমানুষই সর্বত্র বিরাজিত, এলিটরা নয়। বাংলা ভাষায় বিশ শতকের তিরিশের দশকে এবং তার কিছু পরে গণসাহিত্য রচনায় যে ঝোঁক দেখা গেছে তাতে জনগণের ভাষা ব্যবহৃত হয়নি। আর তাই গণসাহিত্য রচিত হলেও এর পাঠক জনগণ ছিল না, ছিল গণপ্রেম-শৌখিন পাঠক। তাই গণসাহিত্য রচনা সার্থকতা পায়নি। ইদানীং কিন্তু সাহিত্যগ্রন্থে, বিশেষ করে টেলিভিশন নাটকে বা বিজ্ঞাপনে ‘মুখের সহজাত ভাষা’ ব্যবহারের নামে যে উন্মাদনা আরম্ভ হয়েছে তাকে পুঁজির প্রতাপ বলা ভালো। এরা বৈশ্য, স্রষ্টা নন। ভেবে দেখুন, বাংলাদেশের টিভি নাটকগুলো কি নাটক, নাকি পণ্যের বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক দেখার চেষ্টা?
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীই বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে, এলিটরা নয়। তাই গণমানুষের ভাষা বাংলা ভাষার স্বাভাবিক অগ্রগতি ও বিকাশের প্রাণসুতো। এই প্রাণসুতো ধরা গেলে গণমানুষের ভাষা ব্যবহার করা যাবে অথবা ঠিকভাবে গণমানুষের ভাষা অনুধাবন করা গেলেও বাংলা ভাষার প্রাণসুতোর সন্ধান মিলবে।
লেখক : উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ