× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ভাষা-সংস্কৃতি ও দুটি চেতনা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৩:৫৪ এএম

ভাষা-সংস্কৃতি ও দুটি চেতনা

১৯৫২ থেকে ২০২৩, সময়ের ব্যবধান ৭১ বছর। এই ৭১ বছরের মধ্যে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ই রয়েছে। এর মধ্যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ স্বাধীনতার সংগ্রাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনস্বীকার্য, ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জন। এর সঙ্গে মুক্তির প্রশ্নটা রয়েই গেছে। এই মুক্তির জন্য সর্বস্তরে ও ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ চাই– এই কথাটি বহুবার বলেছি। কেন সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ চাই? উত্তর হলো, আমরা যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি এবং আরও বড় কথা সুস্থ, স্বাভাবিক এবং ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার একান্ন বছর পরও বাংলা ভাষার অবস্থা ও অবস্থানই বলে দিচ্ছে, তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমাদের স্বাধীনতা সর্বজনীন হয়নি। এর অর্থ হলো, সংগ্রামী সংগ্রামটা চলবে। 

আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির শত্রু-মিত্র একাধিক। আমাদের সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ ভেতরে ও বাইরে। এর বিরুদ্ধে সমাজবিপ্লবের কথা বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু সমাজবিপ্লবের জন্য সংস্কৃতির চর্চা চাই। সংস্কৃতি কখনই আদর্শ-নিরপেক্ষ হয় না, হওয়ার উপায় নেই। বিপ্লবীদের সংস্কৃতি চর্চাও হতে হবে পরিচ্ছন্ন রূপে সমাজবিপ্লবের আদর্শে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ-ও বলে রাখা ভালো, তাতে সাহিত্যের ভূমিকা থাকবে অন্য কোথাও নয়, একেবারে শীর্ষেই। অনস্বীকার্য, ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির সংস্কৃতির ঐক্যের ভিত্তি। সন্দেহ নেই বাংলা ভাষা বিকশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় অতুলনীয় সাহিত্য ও সংগীত রচিত হয়েছে, কিন্তু ভাষা চূড়ান্ত অর্থে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। কেন পারেনি? এর সহজ উত্তর, শ্রেণির কারণে। বাঙালি তার ভাষার দ্বারাও বিভক্ত বটে। অতীতে তো সাম্প্রদায়িকতা ছিলই, এখনও যে নেই তা তো নয়। ছিল আঞ্চলিকতা। সব বাঙালিকে আজও শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হয়নি আবার শিক্ষিত বাঙালি সবাই বই পড়েন না। উচ্চশিক্ষিতরা চর্চা করেন ইংরেজি ভাষার। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য যে আন্দোলন তার রূপটা ছিল গণতান্ত্রিক, ভেতরের আকাঙ্ক্ষাটা ছিল সমাজতান্ত্রিক। অস্বীকার করার পথ নেই, ওই পথেই নতুন রাষ্ট্র এসেছে, যে রাষ্ট্রের লক্ষ্য গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, রাষ্ট্র ওই লক্ষ্য থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকল এবং যাচ্ছেও। 

নতুন রাষ্ট্র মধ্যবিত্তের নিজের পক্ষে অসম্ভব ছিল, কেননা এই শ্রেণির দাবি ছিল সায়ত্তশাসন। লক্ষ ছিল দর-কষাকষি। তবে এ-ও সত্য, মধ্যবিত্তের একাংশ স্বাধীনতা পেয়ে গেছে, তাদের স্ফীতি ঘটেছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এবং প্রায় অসম্ভব পরিমাণে। কিন্তু তারা সংস্কৃতির মিত্রপক্ষে পরিণত হয়নি। কারণ, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুঁজিবাদী। এই শ্রেণির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য বাংলার চেয়ে ইংরেজিকে অধিক প্রয়োজনীয় মনে করেন। এই অভিযোগ অসত্য কি, তারাই দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছেন, সন্তানদের রাখছেন বিদেশে এবং দেশে যখন বিদ্যালয়ে পাঠান তখন অতিঅবশ্যি ‘ভালো’ ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল খোঁজেন। তারা বাংলা নববর্ষ বোঝেন না, কেউ কেউ বুঝলেও তাদের কাছে বাংলা নববর্ষ বলতে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ বোঝেন এবং কথোপকথনে ইংরেজিই বেশি ব্যবহার করেন বাংলার তুলনায়। বাংলা যে রাষ্ট্রভাষা হয়েও রাষ্ট্রের ও সমাজের ভাষা হচ্ছে না তার কারণ এই বিশেষ শ্রেণি সর্বত্র যারা নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ হিসেবে বিরাজমান। এই অবস্থায় সংস্কৃতির গতি যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে যদিও অনেকেই এখনও যুক্ত এবং তাদের আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই কিন্তু তাদের সামনে সীমাবদ্ধতার দেয়ালটিও। শ্রমজীবী বাঙালি অত্যন্ত সংগ্রামশীল, ওই সংগ্রামশীলতার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে একাত্তরে। একাত্তরের মহান অধ্যায়ে আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছিল নতুনভাবে। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ স্বাধীন দেশে ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনায় একে একে আঘাত লাগতে থাকল এবং আমাদের চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির শত্রুপক্ষ আরও শক্তি নিয়ে শক্তিশালী শত্রুতে পরিণত হতে থাকল। 

আগ্রাসী বিশ্বায়ন বাঙালির জন্য দাঁড়ানোর কোনো জায়গা রাখবে না। রবীন্দ্রসংগীতকে পপসংগীত বানাতে চাইবে, সংগীতের নামে আদিম হল্লাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। তেমনটি কি ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়নি? পঞ্চাশের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্ত ছায়াছবি দেখত, যেমন ‘হারানো সুর’, ষাটের দশকে দেখত ‘কাঁচের দেয়াল’, এখন আর সে প্রেক্ষাগৃহে যায় না। কেন যায় না? সচেতন মহলের কাছে এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা নয়। মধ্যবিত্ত ‘পারলে ঠেকা’ এ রকম ছবি দেখতে চায় না সেটা সত্য, কিন্তু ঘরে বসে টেলিভিশনে যা দেখে তা যে ভিন্নমানের এ-ও কিন্তু নয়; ভাষা ও দেহাকৃতি ভিন্ন মর্মবস্তু অভিন্ন। তবে আশার কথা, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যবিত্তকে প্রেক্ষাগৃহমুখী করার 

প্রয়াস চালাচ্ছেন এই প্রজন্মের প্রতিভাবান কয়েকজন পরিচালক, শিল্পী-কলাকুশলী। অনেক দুঃসংবাদের মধ্যে এটি সুসংবাদ বটে। এই ঢাকা শহরে একসময় পৌষমেলাও হয়েছে। একটি হাজারীবাগে, অপরটি রমনায়। উপলক্ষ একই, কিন্তু দুটি মেলার মধ্যে পার্থক্য অনতিক্রম্য। যে সংস্কৃতিকে আমরা বাঙালি সংস্কৃতি বলে গণ্য করতে চাইব তার প্রতিশ্রুতি ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। তাকে হতে হবে ঐক্যবদ্ধ ও গণতান্ত্রিক অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক ও ইহজাগতিক, যার মধ্যে থাকবে বাঙালির সংগ্রামশীলতার প্রকাশ। সেই সঙ্গে সে হবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে করা যাবে এই কাজ। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ার একটা উপায় হচ্ছে তাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা। 

সাম্রাজ্যবাদকে প্রত্যাখ্যানের কাজটি কঠিন হওয়ার কথা নয়। কারণ, বাঙালি মধ্যবিত্তের ভালো কাজের তালিকাটা সামান্য নয়। আমরা যে সংস্কৃতির পরিচয়ে পরিচিত হই, কিছুটা হলেও গর্ব করি, তার গঠনে মধ্যবিত্তের ভূমিকাই প্রধান। উচ্চবিত্ত থেকেছে উদাসীন; বিত্তহীনদের কথা আলাদা। প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার কাজটা মধ্যবিত্তই করেছে, তাকেই করতে হয়েছে। না করে উপায় ছিল না। কেননা, সব দেশেই মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিমনস্ক, আমাদের দেশেও তা-ই। আমাদের দেশে হয়তো কিছুটা বেশিই। কেননা, অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনীতিতে, আমাদের অর্জনটা উৎফুল্ল হওয়ার মতো নয়, বরং বেশ ম্রিয়মাণ। সেজন্য মধ্যবিত্তের পক্ষে সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা, শিল্পকলার ওপর জোর দিতে হয়েছে। কেননা, সংস্কৃতিতেই সে সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, অন্যত্র নয়। ব্যাপার আরও ছিল, সেটা হলো আত্মপরিচয়। সংস্কৃতি দিয়েই সে নিজেকে পরিচিত করেছে, অন্যের কাছে তো বটেই নিজের কাছেও। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই মানুষ। পারিবারিকভাবে রবীন্দ্রনাথরা জমিদার ছিলেন ঠিকই, কিন্তু রুচি ও সংস্কৃতিতে তিনি নিজে ছিলেন মধ্যবিত্ত। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, মধুসূদন ও বেগম রোকেয়াও মধ্যবিত্তই। আলাউদ্দিন খাঁ, উদয়শঙ্কর, রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়, জয়নুল আবেদীন এই শ্রেণি থেকেই এসেছেন। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন বসু – সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তান। 

শিক্ষাকে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সমষ্টিগত অর্জন মধ্যবিত্তের কারণেই। বিজ্ঞানী হিসেবে যারা বড় মাপের কাজ করেছেন তাদের কেউই মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাইরে নন, হওয়া সম্ভব ছিল না, হওয়ার উপায় নেই। রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রত্যেকটিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছ থেকেই নেতৃত্ব এসেছে, তা সে আন্দোলন উদারনৈতিক হোক কিংবা হোক বামপন্থী। চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ চন্দ্র বসু, একে ফজলুল হক সবাই মধ্যবিত্ত, শেখ মুজিবুর রহমানও তা-ই, মওলানা ভাসানী এবং কমরেড মুজফফর আহমদ দুজনই মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে এসেছেন। রাজনৈতিক সচেতনতা যা তৈরি হচ্ছে সেটাও মধ্যবিত্তেরই অবদান। কৃষক আন্দোলন হয়েছে, তাতে তীব্রতা ছিল অসচেতনাও ছিল, কিন্তু সেগুলো স্থানীয় এবং বিচ্ছিন্ন। ব্যাপক আন্দোলন মধ্যবিত্ত নেতৃত্বেই তৈরি। উচ্চবিত্তরা আন্দোলনে আসাটা পছন্দ করেনি। তাদের সংখ্যাও অবশ্য কম ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্তের অসুবিধা হলো, উচ্চবিত্তের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের একধরনের হীনম্মন্যতাবোধ। সরাসরি বলতে চাইলে বলা যায়, মধ্যবিত্ত নিজেই উচ্চবিত্ত হতে চায়। নিচে নামাকে সে যত ভয় করে ততটা ভয় মৃত্যুকেও করে কি না, সন্দেহ। ওদিকে উচ্চবিত্তের পক্ষে নিচে নেমে যাবার ভয়টা কম। সে জানে যে, সে রয়েছে বেশ শক্ত অবস্থানে। রাজনৈতিক আন্দোলন হয় এবং হবে, হচ্ছে; রাষ্ট্রের ভাঙাগড়া চলছে, চলবে। কিন্তু উচ্চবিত্তের তাতে কোনো বিপদ ঘটে না। সে নিরাপদেই থাকে। কেবল তা-ই নয়, তার সুবিধাই হয়। দেশে এত যে রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেল এর কোনোটাই বিত্তবানদের জন্য কোনো বিপদ ডেকে আনেনি বরং প্রত্যেকটি পরিবর্তনেই তারা লাভবান। আগে যতটা ধনী ছিল পরে তার চেয়ে অধিক ধনী হয়েছেন। ওই পরিবর্তনগুলো মধ্যবিত্তের একাংশের জন্যও লাভের কারণ হয়েছে।

আমরা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের অবদানের কথা বলি, সেটা ঠিকই আছে। অবদান অস্বীকার করবে কে। কিন্তু মধ্যবিত্তের কারণেই ওই সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে রয়েছে। তাতে ব্যাপক জনগণের অংশ নেই, যার জন্য প্রাণশক্তিতে সে ক্ষীণ। বলা যায় সংকীর্ণ। সেখানে গণতান্ত্রিকতা নেই, নেই সেই ইহজাগতিকতা যা শ্রমজীবী মানুষের জীবনের বৈশিষ্ট্য। এ দেশের মধ্যবিত্ত ধর্মভীরু, একাংশ সাম্প্রদায়িক, এখন তারা মৌলবাদীও হয়েছে; এই দৃষ্টিভঙ্গি তারা জনগণের ভেতর সংক্রমিত করে দেয়। অতীতে করেছে, এখনও করছে।

বিশ্ব পুঁজিব্যবস্থার কারণেই বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হতে পারেনি। বাংলাদেশ যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে, তা পুঁজিবাদের পেছনে ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে। কথিত যে কাঠামোর ওপর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে, তা খুবই ভঙ্গুর এসব কারণেই, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি বিশ্বমানের হতে পারেনি। রাষ্ট্রের দৈন্যয় বাংলা বৈশ্বিক রূপ পায়নি। আমাদের এখানে আসলে সত্যিকার অর্থে সামাজিক বিপ্লব হয়নি। সামাজিক বিপ্লবের সুফল গণমানুষের কাছে পৌঁছায়নি বলেই আমরা জাতি হিসেবে আজও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সমৃদ্ধ হতে পারিনি। আর এ কারণে আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হতে পারেনি। ভাষার জন্য জাতি রক্ত দিল। আর সেই রক্তের ওপর ভর করে একটি রাষ্ট্র দাঁড়াল। অথচ আজও বাংলা ভাষার সর্বত্র প্রয়োগ হলো না। রাষ্ট্র তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা জারি করে বৈষম্য বজায় রেখেছে। যারা উচ্চবিত্ত তারা ইংরেজি শেখেন। আর মধ্যবিত্তের যারা বাংলা শেখেন, তাদের মধ্যে গভীর কোনো চর্চা নেই। প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল বই এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় বই বিতরণ অব্শ্যই ভালো উদ্যোগ। আশা করব, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য শুধু প্রাক-প্রাথমিক নয়, এই ব্যবস্থা যেন অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। একটি সভ্য রাষ্ট্র এবং সভ্য জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব, দেশের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা করা।

স্বাধীনতা কতটা এসেছে এবং কী পরিমাণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে, তা নির্ণয় করবার অনেকগুলো নিরিখ আছে। প্রধান নিরিখ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। আরেকটি জরুরি নিরিখ হচ্ছে মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার। প্রশ্নটা প্রতিবছরেই নতুন করে ওঠে। সংগ্রাম ও অগ্রগতির পরেও জীবনের সর্বস্তরে ও পর্যায়ে বাংলা ভাষার প্রচলন কেন ঘটছে না? প্রশ্নটি এবারে আরও বেশি করে শোনা যাবার কারণ হতে পারে দুটি। এক. স্বাধীনতার একান্ন বছর পরও বাংলা ভাষার প্রচলন নেই। উচ্চ আদালতে তার ব্যবহার এখনও নেই বললেই চলে, উচ্চশিক্ষায় সে অব্যবহৃত, উচ্চ প্রশাসনে উপেক্ষিত, উচ্চ শ্রেণিতে অসম্মানিত। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে এই, সংবাদপত্র ও আকাশমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে, তাদের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তারা জনগ্রাহ্য প্রসঙ্গগুলোকে সামনে আনার ব্যাপারে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষার প্রশ্নের চেয়ে অধিকতর জনগ্রাহ্য প্রসঙ্গ আর কী-ই বা হতে পারে? বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। বাংলা যাদের মাতৃভাষা পৃথিবীতে আজ তাদের সংখ্যা ২৫-২৬ কোটি, সেই হিসেবে বাংলা এখন চতুর্থ স্থানে। বাংলায় রয়েছে উৎকৃষ্ট সাহিত্য। এরপরও প্রশ্ন হচ্ছেÑ তাহলে অন্তরায়টা কোথায়? বলা হবে অভাব আছে সদিচ্ছার। কিন্তু কার ইচ্ছার কথা বলা হচ্ছে? ব্যক্তির, নাকি প্রতিষ্ঠানের? ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের সদিচ্ছা কিন্তু অনেক আগেও দেখা গেছে, এখনও যে দেখা যায় না তা নয়, তবে তাতে কাজ হয়নি, বাংলা চলেনি।

বাংলা ভাষার শত্রু অন্য কেউ নয়। শত্রু হচ্ছে দেশের শাসক শ্রেণি এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভু। ভাষার লড়াইটা আসলেই একটা রাজনৈতিক লড়াই, আগেও ছিল, এখনও রয়েছে। এ দেশে বাংলা তখনই সর্বস্তরে ও সর্ব পর্যায়ে চালু হবে যখন এ রাষ্ট্র জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তার আগে নয়। ভাষা প্রচলনের চেষ্টাকে তাই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এর বাইরের কাজগুলো হবে সংস্কারমূলক, তাতে অর্জন কিছু ঘটলেও তা বিস্তৃত হবে না, তাদের ধরে রাখাও সম্ভব হবে না।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা