সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:০৪ এএম
ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি বিরাজ করছে, এযাবৎ যা লেখা হয়েছে তার ভিত্তিতেই বলছি। প্রথমত, ভাষা আন্দোলনের সূচনা হিসেবে ১৯৪৮- কে বলা হয়েছে। কারণ, সে বছর ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাঙালি প্রথম রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু ইতিহাস বলে শূন্যে কিছু ঘটে না, এর পটভূমি কোথায়? আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি পটভূমির শুরু হয়েছিল ১৮৬৭ থেকে উপনিবেশ ভারতে। যার কারণ সে বছর বেনারসে হিন্দু নেতা যারা ছিলেন তারা দেশ ও মানুষ নিয়ে ভাবতেন, একটা সভায় মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ভারত স্বাধীন হলে ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হবে হিন্দি, এই ঘটনাকে আমি মনে করি ভাষার রাজনীতিকরণ এবং সাম্প্রদায়িকীকরণের সূচনা। কারণ এর পরপর থেকে মুসলমান নেতাদের লেখাজোকায়, বক্তব্য, বিবৃতিতে পাওয়া গেল যে তা হালো মুসলমানদের ভাষা হবে উর্দু। তবে বলে রাখি উর্দু বা হিন্দি কোনোটাই ভাষা নয়, উপভাষা। এ দুটোরই জন্ম হয়েছে মুগল আমলে সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য হিন্দুস্তানি ভাষা থেকে, যাতে ফার্সি শব্দ ছিল, আরবি শব্দ ছিল, সংস্কৃত শব্দ ছিল এবং ভারতের স্থানীয় অনেক শব্দ ছিল। তো মধ্য শতকের পর থেকে একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি, সেটা হচ্ছে যে হিন্দুস্থানি থেকে মুসলমানি আরবি ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে হিন্দি তৈরি করা হলো। আবার একইভাবে বিপরীত মুসলমানরা হিন্দুস্থানি থেকে সংস্কৃত, ভারতীয় শব্দ বাদ দিয়ে উর্দু ভাষা তৈরি করল। তো উর্দু ভাষার সঙ্গে ইসলামি আবেগ জড়িয়ে থাকল, এই জন্যে যে উর্দু ভাষা লেখা হয় আরবি হরফে। আবার হিন্দি ব্রাহ্মী হরফে লেখা হয়। তো দুই ক্ষেত্রেই ধর্মীয় আবেগ কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়। এবং সে জন্যেই আমি এখান থেকেই শুরু করি ভাষা সংগ্রামের আন্দোলনের পটভূমি। পাকিস্তান যখন হয়ে উঠছে, তখন সাতচল্লিশের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সময়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন বলেছেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সেই সময়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন যে, বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। যুক্তিটা কি? যুক্তি হচ্ছে, পাকিস্তানি নাগরিকদের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। পাঠ্যবইয়ে লেখা আছে ৫৬ ভাগ, কিন্তু এটা হবে ৫৪ ভাগ। কারণ আমাদের দুই ভাগ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, কিন্তু বাংলায় কথা বলতে বাধ্য হয়। আর এ সময়ে আরেকটি ঘটনা, আমি কেন সাতচল্লিশ থেকে ভাষা আন্দোলনের কথা বলছি। সাতচল্লিশের পয়লা সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিসের জন্ম হয়েছিল। তমদ্দুন মজলিস ভাষাকেন্দ্রিক বিতর্কের ভিত্তিতেই সৃষ্টি হয়েছে। ১৫ সেপ্টেম্বর, ওই সাতচল্লিশে তারা একটা পুস্তিকা প্রকাশ করল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু এবং ওখানে বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষেরা লিখেছিল, যেমন আবুল মনসুর আহমেদের কথা বলি, তিনি বলেছিলেন, যদি পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষা চালু হয় তাহলে রাতারাতি বাঙালিরা অশিক্ষিত জাতিতে পরিণত হবে। কাজেই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২১ এবং ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে (তার শেষ আসা) বলেছিলেন, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। তবে কার্জন হলে ২৪ মার্চ যখন বক্তৃতা করেন, তখন কার্জন হলে উপস্থিত ছিলেন ভাষা মতিন, তরুণ বয়স, তিনি ছোটোখাটো মানুষ, চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। অন্যরাও প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই সময়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কয়েক মিনিট চুপ করে ছিলেন। তার মুখের ওপরে এমন প্রতিবাদ তিনি কোনোদিন দেখেননি। পরে তিনি বক্তৃতা শুরু করেছেন, তবে তার মূল বক্তব্যই ছিল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৫১তেও খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন। আবার ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান তখন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, স্বৈরাচারী- তিনিও উর্দু করতে চেয়েছিলেন, পারেননি। তখন বাংলাদেশে বাঙালিরা ৯৮ ভাগ উর্দু বুঝত, আর উর্দু ভাষায় পাকিস্তানের মোট নাগরিকদের মধ্যেও ৬.০৭ ভাগ
উর্দুতে কথা বলত। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেও উর্দুতে কথা বলতেন না। কারণ তিনি গুজরাটের মানুষ ছিলেন। তবে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুর আগে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে বলে গিয়েছিলেন, তিনি জীবনে দুটো ভুল করেছেন। এক, ১৯৪৬ সালের ৭-৯ এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম লীগ রাইটার্স কনফারেন্সে লাহোর প্রস্তাব এস্টেটমেন্টকে এস্টেট করেছিলেন এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সহযোগিতা করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এবং আরেকটি ভুল তিনি করেছিলেন উর্দুর সপক্ষে নিজের মতামত দিয়ে। এখন প্রশ্ন হলো- কেন পাকিস্তানিরা উর্দু নিয়ে এত মাতামাতি করল। এক নম্বর উত্তর- উর্দু ইসলামি ভাষা। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতেন, আর সেটা ভুল ছিল তা তিনি স্বীকার করেছেন। আরেকটি কারণ- উর্দু ভাষা আরবি হরফে লেখা হয়। আরেকটি হচ্ছে পূর্ব বাংলায় উর্দু ভাষা চালু হলে বাঙালিদের অবদমিত রাখা যাবে। সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা আর কি। আর বাঙালিরা সংগত কারণে ঠিকই বুঝেছিল এটা শুধু ভাষার লড়াই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের অস্তিত্বের লড়াই। সেই জন্যে ভাষা আন্দোলনকে আমি বলি, বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র থেকেই ক্রমাগতভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য হয়ে আমার মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। সে কারণে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস জড়িয়ে আছে এমন একটা কথা বলা যায়। ভাষা আন্দোলন আটচল্লিশ থেকে নয়, সাতচল্লিশ থেকে। এটা মনে রাখতে হবে এটা শুধু ভাষার লড়াই ছিল না, বাঙালির অস্তিত্বের সংগ্রাম। চূড়ান্ত পর্যায়ে আমার বক্তব্য, ভাষা আন্দোলনকে স্বীকার করে নিতে হবে এটা বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের আন্দোলন।
লেখক : ইতিহাসবিদ, বঙ্গবন্ধু চেয়ার, বিইউপি