× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সর্বস্তরে বাংলা চালু : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

হাকিম আরিফ

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:২৪ এএম

সর্বস্তরে বাংলা চালু : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

মাতৃভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিশু যে ভাষিক সমাজে জন্মগ্রহণ করে, মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা খুব সহজেই শিখে নেয়, সে ভাষাতেই সে কথা বলতে চায়; লেখাপড়া শিখতে চায়। এটি তার মৌলিক অধিকারের মধ্যে বর্তায়। এই অধিকারটি পৃথিবীর সমৃদ্ধ ও উন্নত ভাষার শিশুরা চর্চা করার সুযোগ পেলেও এই বিশ্বের অনেক শিশুই এ থেকে বঞ্চিত। এই বঞ্চনার অনেক কারণ আছে। প্রথমত, কোনো কারণে মাতৃভাষাটির মৃত্যু ঘটলে, মাতৃভাষীরা সচেতনভাবে অন্য ভাষা গ্রহণ করলে, বা মাতৃভাষাটি তথাকথিত শাসকগোষ্ঠী দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে। বায়ান্ন সালে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে শেষোক্ত আশঙ্কাটি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাংলার সাহসী তরুণেরা পাকিস্তানি শাসকের বাংলা ভাষা ও ভাষিক সংস্কৃতি বিনাশের এই অপতৎপরতা বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিরোধ করেছিল। বায়ান্নর ভাষাযোদ্ধা ও সৈনিকদের রক্তদানের কিছু অন্তর্নিহিত প্রেরণা ছিল। একে আমরা একুশের চেতনা বলে থাকি। 

একুশের চেতনার দ্বিমাত্রিক উদ্দেশ্য ছিল। প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, বাংলা ভাষাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করা। আর পরোক্ষ উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ক্ষেত্রে বাঙালিকে অকুতোভয় করে তোলা। কারণ এতে করেই বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিহিত ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে শহীদদের পরোক্ষ উদ্দেশ্যটি নিঃসন্দেহে পূরণ হয়েছিল, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আসুন অনুসন্ধান করে দেখি, বায়ান্নর ভাষাশহীদদের প্রত্যক্ষ বা প্রথম উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থা কী?

বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। একটি হচ্ছে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেওয়া এবং দ্বিতীয়টি, বাংলা ভাষার বিভিন্ন ধরনের অবয়বগত উন্নয়ন সাধন করা যাতে এই ভাষা দিয়ে জ্ঞানের সব শাখাতেই কাজ করা যায়। ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভাষাটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেলেই তার উন্নয়নের কাজ শুরু হয় এবং এর যাবতীয় উন্নতির জন্য পরিকল্পনা, নীতি, অর্থ বরাদ্দ শুরু হয়। বাংলাদেশের বাংলা ভাষার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, বাহাত্তর সালে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। এটি বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রাপ্তি এবং এক্ষেত্রে বাংলা ভাষাটি ভাগ্যবানও বটে। কারণ সাত হাজারেরও বেশি ভাষার মধ্যে কমসংখ্যক ভাষাই এ মর্যাদা পেয়েছে। এ কারণেই বাংলা ভাষার জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার তৈরি হয়। সেটি বাংলাদেশ নামক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের সবকিছুরই ভাব প্রকাশের জন্য উপযোগিতা লাভ করে। স্বাধীনতাপরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকার শুরুও করেছিলেন খুব ভালোভাবেই। কুদরাত-ই-খুদার নেত্বত্বে দেশের প্রথম শিক্ষানীতিতে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অবস্থানটিও ছিল খুবই স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। এখানে বলে রাখা ভালো, শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলাকে গুরুত্ব প্রদান করা হলেও ইংরেজি এবং বিভিন্ন বিদেশি ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও অতীব গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছিল। সেই গুরুত্বের আলোকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুতরাং বাংলা ভাষার ওপর গুরুত্ব প্রদান মানেই ইংরেজি বা অন্য বিদেশি ভাষা শেখা ও চর্চা করার ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ, এ কথা কিছুতেই ঠিক নয়। 

কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পর বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের বিষয়টি অন্ধকারে চলে যায়। পরবর্তীতে আশির দশকে এরশাদ সরকার সর্বস্তরে বাংলা প্রচারের ক্ষেত্রে কিছু জনপ্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সাতাশি সালে বাংলা ভাষা প্রচার সেল প্রতিষ্ঠা করা, যার উদ্দেশ্য ছিল অফিস-আদালতসহ জ্ঞানচর্চার সকল ক্ষেত্রে বাংলা চালুর প্রয়োজনীয় কাজটি করা। এ ছাড়া তখন দোকান ও অফিসের সাইনবোর্ডে বাংলা ভাষাকে আবশ্যিক করে তোলা হয়। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ যত না আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করা হয়, তার চেয়ে তা ছিল অনেক বেশি লোকদেখানো। 

সেই থেকে আজ দুই হাজার তেইশ সাল প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পার হলেও বাংলা কি সর্বস্তরে প্রচলিত হয়েছে? উত্তরটি অবশ্যই না। আসুন তার কিছু খতিয়ান তুলে ধরি। প্রথমেই আমরা বলতে চাই, স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেসব বিভাগে বাংলার প্রচলন শুরু হয়েছিল, তা আজ অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাবে একটি নীরব ভাষাসরণ ঘটে গেছে। তার মানে অনেক বিভাগ বর্তমানে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগগুলোতে বাংলার চর্চা নেই বললেই চলে। তা ছাড়া বাংলাদেশে যে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেখানে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ অনুপস্থিত বললেই চলে।

এ তো গেল উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার পশ্চাদপসরণের কথা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও বাংলাচর্চার অবস্থাটি একান্ত অর্থেই ঘোলাটে। কারণ স্কুলে শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা শিখানোর পর্যায়টি খুবই অবৈজ্ঞানিক এবং প্রথাগত। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই বারো বছর একটি ভাষাকোর্স হিসেবে বাংলা পড়েও সঠিকভাবে লিখতে পারে না। তা ছাড়া দেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষা-পূর্ববর্তী স্তরে মূলধারার বাংলা শিক্ষামাধ্যম ছাড়াও ইংরেজি এবং মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বিরাজমান, যেখানে বাংলার চর্চা ও প্রসার খুবই হতাশাজনক এবং দায়সারা গোছের। মোট কথা, একটি দেশে মূলধারার শিক্ষামাধ্যম ছাড়া অন্য মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকা মূলধারার ভাষাটির প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ। বাংলাদেশে বাংলার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের অন্য ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার দুরবস্থা লক্ষণীয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব বেসরকারি কোম্পানি, বহুজাতিক কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা এবং এনজিও রয়েছে সেখানে বাংলাচর্চাকে নেতিবাচক এবং অযোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষায় অফিস ফাইল লেখা হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশের আইন-আদালতেও কিছুদিন আগ পর্যন্ত বাংলার প্রচার ছিল না বললেই হয়। কিন্তু অতিসম্প্রতি নিম্ন ও উচ্চ আদালত বেশ কিছু রায় বাংলায় প্রদান করে আশার আলো জাগিয়েছে। তবে সার্বিক বিচারে তা নিঃসন্দেহে পর্যাপ্ত নয়।

ওপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী একাত্তর বছর এবং স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পার হলেও শহীদদের প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্যটি পরিপূর্ণ অর্থে বাস্তবায়িত হয়নি। একুশের প্রধান চেতনাটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং এক্ষেত্রে তার যাত্রাটি পেছনের দিকে ধাবমান। কিন্তু এর কারণ কী? তা অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

প্রথমত, বাংলা ভাষার ব্যাপারে বাঙালির সীমাহীন ভালোবাসা থাকলেও শ্রদ্ধাবোধ নেই। সে কারণে বাংলা ভাষাটির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাই স্বাধীনতার পর অর্ধশতক বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত একটি ভাষার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কোনো নীতিও তৈরি হয়নি এবং দেশবাসীকে তা মানার জন্য কোনো আইনও প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। মজার বিষয়, স্বাধীন দেশে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও কোনো ভাষানীতি হয়নি বা এ বিষয়ে কেউ ভাবনাচিন্তাও করেননি। একজন বাঙালি শিশু বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশু জন্মগ্রহণের পর কতটি ভাষা শিখবে সে বিষয়ে সরকারের কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এক অদ্ভুত ভাষানীতিহীন দেশে আমরা বসবাস করছি। তা থেকেই বোঝা যায়, ভাষা আন্দোলনের জন্মদানকারী দেশে ভাষা বিষয়ে আমাদের কেমন অশ্রদ্ধা বিরাজমান।

এর জন্য দায়ী কারা? আমরা নিজেরাই। সরকার, শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, প্রকৌশলী কেউই চাইনি, বাংলা প্রকৃত অর্থে কার্যকর ভাষা হয়ে উঠুক। প্রথমত, এক্ষেত্রে শিক্ষিত ও ধনবান বাঙালিদের মধ্যে এক ধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতাও কাজ করে। এ ছাড়া বাংলা ভাষার অর্থসম্পর্কটি যে বড়ই দুর্বল। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা তুলনায় বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্মীদেবীর কৃপা যে অনেক কম পান। সে কারণে বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদেরকে তাদের সচ্ছল পিতামাতা বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদান করাতেই অধিক তৎপর। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে বাংলা ভাষার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যেতে বাধ্য। 

তাহলে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচারের ক্ষেত্রে উল্লিখিত বাধাসমূহ উতরানোর উপায় কী? এক্ষেত্রে কিছু প্রায়োগিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। নিচে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে।

১. বাংলাকে ভালোবাসার পাশাপাশি একে শ্রদ্ধার আসনে বসাতে হবে। 

২. মনের মধ্যে গোপন হয়ে থাকা ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ইত্যাদি ভাষার মতো বাংলাও যে সবকিছু প্রকাশের বাহন হতে পারে, তা মনের মধ্যে লালন করতে হবে।

৩. বাংলা ভাষার সঙ্গে এর অর্থসংযোগ বাড়াতে হবে। অর্থাৎ বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেও কোনো শিক্ষার্থী চাকরি ক্ষেত্রে অর্থগতভাবে দীনহীন হবে না।

৪. সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ভালো বাংলা জানাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৫. বাংলা ভাষায় দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন বিষয়ের যে অসংখ্য পরিভাষা তৈরি হয়েছে সেগুলো যাতে সবাই ব্যবহারে উৎসাহ দেখায় সেজন্য পরিভাষা মান্যায়ন করতে হবে।

৬. বাংলাদেশে শিক্ষানীতির মতো ভাষা পরিকল্পনা ও নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য সংসদ থেকে আইন পাস করতে হবে।

লেখক : মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা