সেলিনা হোসেন
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১২:২১ পিএম
আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৪১ পিএম
সেলিনা হোসেন। ফাইল ফটো
লীলাবতী, প্রাচীন বাংলার এক নারী। তার ছিল জ্যোতিষশাস্ত্রে অসামান্য দখল। এই নারী চাষাবাদ, গার্হস্থ্য জীবন ও পশুপালন সম্পর্কে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা খনার বচন নামে সুপরিচিত। এই প্রজ্ঞার জন্য তার জিহ্বা কেটে নেওয়া হয় বলে তার নাম খনা। উড়িয়া ভাষায় খনা অর্থ বোবা। খনাকে নিয়ে উড়িয়া ভাষায় প্রচলিত কিংবদন্তি উল্লেখ করা দরকার মনে করছি। রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্নসভার অন্যতম জ্যোতির্বিদ ছিলেন পণ্ডিত বরাহ। তিনি ভুলবশত তার নবজাত সন্তানের অকালমৃত্যুর কথা গণনা করেছিলেন। সেই সন্তানকে একটি বাক্সে করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন, এভাবে সন্তানটি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
একই সময়ে আরেক রাজ্যের রাজাসহ অন্য লোকেরা বিদ্রোহী রাক্ষসদের হাতে নিহত হন। বেঁচে যায় শিশু লীলাবতী। এই শিশু রাক্ষসদের হাতে প্রতিপালিত হতে থাকে। নদীতে ভেসে আসা শিশুসহ বাক্সটি দ্বীপবাসী রাক্ষসদের হাতে পড়ে। তারা দুজনকেই লালন-পালন করতে থাকে। বরাহের ছেলের নাম রাখা হয় মিহির। বড় হয়ে দুজনে জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী হন এবং গোপনে বিয়ে করেন। পরে দুজন ওই দ্বীপ থেকে পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন। তারা জ্যোতিষী গণনায় পালানোর নিরাপদ সময় বের করে সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে চলে আসেন।
লীলাবতী তার গণনায় মিহিরের পরিচয় জানতে পারেন ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও উজ্জয়িনী নগরের রাজসভার পণ্ডিত বরাহ তার বাবা। দুজনে রাজসভায় গিয়ে তাদের পরিচয় দিলে অতীতের ঘটনা স্মরণ করে বরাহ পুত্র ও পুত্রবধূকে স্বীকার করে নেন।
বাংলা কিংবদন্তিতে খনা লঙ্কাদ্বীপের রাজকন্যা। শুভক্ষণে জন্ম হয়েছিল বলে তার নাম খনা রাখা হয়। লঙ্কাদ্বীপের অধিবাসী ছিল রাক্ষসরা। তারা এক দিন খনার পিতা-মাতাকে হত্যা করে এবং খনাকে প্রতিপালন করে। একই সময়ে পণ্ডিত বরাহের ভাসিয়ে দেওয়া কাঠের বাক্স থেকে দ্বীপবাসী রাক্ষসরা মিহিরকে উদ্ধার করে। দুজনই রাক্ষসদের কাছে প্রতিপালিত হয়। বলা হয়, খনা বয়সে বড় ছিলেন এবং তিনিই মিহিরকে দেখাশোনা করতেন। পরে দুজন জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। এর পরের গল্প উড়িয়া কিংবদন্তির মতোই। তবে পার্থক্য এই যে, বরাহ তাদের কথা বিশ্বাস করতে না চাইলে খনা একটি বচনের মাধ্যমে বরাহের গণনা ভুল প্রমাণ করেন।
খনার কিংবদন্তির উল্লেখ এই কারণে, তিনি সিংহলের রাজকুমারী হলেও বিভিন্ন ইতিহাসে তার সম্পর্ক সূত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশের সঙ্গে। ফলে অনেকেই খনার ভাষাকে বাংলা বলে মনে করেন। তবে বাংলা হলেও তা যে বর্তমান ভাষা মূল ভাষার বিবর্তিত রূপ, সে বিষয়টি নিয়ে মতপার্থক্য নেই। ধারণা করা হয়, খনার আবির্ভাবকাল সম্ভবত তিন-চারশত বর্ষের মধ্যে হয়েছিল। খনা আমাদের বৈশাখ নিয়ে অসংখ্য বচন রচনা করেছেন। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য দুয়েকটি- ‘চৈত্রে দিয়া মাটি/বৈশাখে কর পরিপাটি’॥ আবার অন্য একটি বচনে তিনি বলেছেন, ‘চৈত্রেতে থর থর/বৈশাখেতে ঝড় পাথর/ জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে/ তবে জানবে বর্ষা বটে’॥ বৈশাখ নিয়ে খনার আরও একটি বহুল প্রচলিত বচন, ‘বৈশাখের প্রথম জলে/আশুধান দ্বিগুণ ফলে’।
বৈশাখ বাঙালির জীবনে শুধু ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠায় চিহ্নিত একটি দিন মাত্র নয়। পথচলার সহায়ক শক্তি। এ শক্তিকে অবদমন করার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান সরকার। পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিষিদ্ধ করেছিল। সরকারি ছুটি বাতিল করেছিল। বাঙালির অমিত শক্তির সামনে সেই অবদমন ধোপে টেকেনি। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন তার অমিত শক্তির বিশেষ দিক। এদিক বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সীমান্ত অতিক্রম করেছে। বৃহত্তর সামাজিক পাটাতনের পরিসর বাড়িয়েছে। সৃষ্টি করেছে উদ্যম ও ব্যাপ্তিতে জাতিসত্তার বলয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিদের দ্বারা আয়োজিত বৈশাখী উৎসব আজ নিজেদের পরিচয়ে উজ্জ্বল উদ্ধার।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা। অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ বৈশাখ, তোমার চেয়ে আর কে বেশি জানে যে এ দুটি পঙ্ক্তি একজন কবির শুধু ঋতুবন্দনা নয়, কবি জীবনের কল্যাণে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করেছেন। বছর ধরে জমে ওঠা গ্লানি ও জীর্ণতাকে দূর করে ধরণীকে শুচি করার কথা বলেছেন। সারা বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাওয়ার মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন। এই মন্ত্র ধূলিমলিন জরাগ্রস্ত পৃথিবীর চেতনা, যে বোধ জীবনের অবমাননা ঘটায়, তাদের দূর করে জীবনের দার্শনিক সুন্দরকে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন কবিগুরু।
এ সত্য মঙ্গলের সাধনার গভীর বোধটি বাংলা নববর্ষে সব বাঙালির ভেতরে থাকুক, এ আহ্বান ধ্বনিত হয় এই দিনকে কেন্দ্র করে। হে বৈশাখ, আমরা তোমার দিনের শুরুর যাত্রাকে স্বাগত জানাই। তুমি আমাদের জীবনে নববর্ষের সূচনা করো।
সেজন্য আমরা সমবেত কণ্ঠে বলতে চাই, নববর্ষ একটি নতুন, অন্যরকম সূর্যোদয় উদ্ভাসিত করো বাংলাদেশের মানুষের জীবনে। আমরা নতুন আলোয় দেশটাকে দেখতে চাই। এখনও অনেক জঞ্জালে ভরে আছে এ দেশের মানুষের জীবন। আমরা নতুন সূর্যোদয়ের দিকে তাকিয়ে বলতে চাই, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
আমরা তোমাকে চাই বৈশাখ। তোমার রুদ্র বৈশাখী জরাজীর্ণ পাতা উড়িয়ে নেওয়ার অমিত শক্তি, শান্ত-স্নিগ্ধ তারাভরা আকাশ, বৃষ্টির অপরূপ ছোঁয়া। দহন ও স্বস্তির সমন্বয়ে আমরা ভরে তুলতে চাই জীবনের বিশাল ক্যানভাস।
বৈশাখ, বাঙালিকে একাত্তরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে দাও। বাঙালি যেন বলতে পারে, হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে। বৈশাখী ঝড় অনৈক্যের জায়গাটিকে উৎখাত করে ঐক্যের জায়গাটি সমান করে দিক। মানুষ হিসেবে বাঙালির শুভবুদ্ধি একাত্তরের চেতনার মতো দীপ্ত হয়ে উঠুক। স্বদেশ যেন বাঙালির চেতনার সবটুকু জায়গায় অমলিন থাকে, যেন সে বোধে কোনো ফুটো তৈরি না হয়। যেন ব্ল্যাক হোলের মতো সে ফুটো স্বদেশকে গ্রাস না করে। বৈশাখ, বড় মিনতি তোমার কাছে। তুমিই তো পার বলতে, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা।’ জাতির জীবনে জমে যাওয়া আবর্জনা দূর করতে বাঙালিকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তুমি বিপুল শক্তি দাও।
তোমার কাছে প্রার্থনা, বৈশাখ, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়, যেন মনুষ্যত্ব বিকাশের অনুশীলনের প্রতিষ্ঠান হয়। আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন তোমার নতুন বছরকে নির্মাণ করার জন্য প্রতিজ্ঞাদীপ্ত হয়। বৈশাখী মেলা থেকে আম-আঁটির ভেঁপু কিনে আমাদের সন্তানরা নিজেদের হৃদয় খুলে শিক্ষা নির্যাসে আলোকিত মানুষ হোক। বৈশাখ উদযাপনের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। এ গৌরবের জায়গা পরবর্তী প্রজন্ম যেন ধরে রাখতে পারে- এ প্রার্থনা তোমার কাছে। কেন তোমার কাছে প্রার্থনা, বৈশাখ? বর্তমান সময়ে জীবনের যাত্রাপথে নারী-শিশু নির্যাতনের ধৃষ্টতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না বলে কি? যে সুষম জীবনব্যবস্থা আমাদের সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিলে আমরা প্রকৃত মানুষের জনগোষ্ঠী হতে পারতাম বলে কি? বৈশাখ, বড় গভীর প্রার্থনা তোমার কাছে।
তোমার কাছে প্রার্থনা, বৈশাখ, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার লোকজনকে দেশের মূলধারার জনগোষ্ঠীর কাতারে নিয়ে এসো। তাদের বঞ্চনার অবসান ঘটাও। তাদের বেদনাকে নিজের বেদনায় পরিণত করে বলো, অগ্নিস্নানে শুচি হোক বাংলাদেশ। আমরা সব জনগোষ্ঠীর মানুষ এক হয়ে ফসল উৎপাদন করি, বনভূমি রক্ষা করি, নদী রক্ষা করি, সৃষ্টির যা কিছু মহৎ সুন্দর তাকে আহ্বান করে মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের সমন্বয়ে প্রিয় স্বদেশের ভূখণ্ডকে সুন্দর করি। আবার সেই আহ্বান, এসো, এসো হে বৈশাখ। তোমার নতুন প্রাণের উজ্জীবিত শক্তিতে আমরা পাহাড়প্রমাণ সমস্যাকে দূর করব।
তুমি যদি নতুন বছর নিয়ে আসতে পারো, তাহলে আমরাও বছরের রূপবৈচিত্র্যকে ভিন্ন করতে পারব। আমাদের আশাবাদী সংগীতে বাজবে নবপ্রাণের গান। আমরা বলব, বৈশাখ, হে মৌন তাপস... হঠাৎ তোমার কণ্ঠে এ যে আমার ভাষা উঠল বেজে, দিল তরুণ শ্যামলরূপে করুণ সুধা ঢেলে। সমাজজুড়ে মূল্যবোধের অবক্ষয় গ্রাস করেছে নানা দিক। উৎসবের আনন্দ খর্ব করছে অপশক্তি। নিগৃহীত করছে নারীদের। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা উৎসবের সময়কে বেঁধে দিয়ে সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশকে খণ্ডিত করছে। এ আমাদের কাম্য নয়।
বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নিজের শিকড় খোঁজার প্রেরণা। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের পিছিয়ে পড়া সময়কে অতিক্রম করতে চাইছে অস্তিত্বের জাগরণের মধ্য দিয়ে। এটা প্রমাণিত যে, অস্তিত্বের জাগরণ ছাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্ভব নয়। দেশের উন্নয়নকে সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে পরিচালিত না করলে সে উন্নয়ন ব্যর্থ হতে বাধ্য, পরিণাম হয় ভয়াবহ। উন্নয়নের মেকি ডামাডোল প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ মানুষ। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের পণ্ডিত ও গবেষকরা ঐতিহ্যের আধুনিক বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছেন। কেবল সমাজতাত্ত্বিক নয়, তার নৃতাত্ত্বিক পর্যালোচনাও হচ্ছে। শুধু আবেগ দিয়ে নয়, ইতিহাসমুখী দৃষ্টি ও বিজ্ঞান-মনস্কতাও এই বিচার-বিশ্লেষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ঐতিহ্যের কল্যাণধর্মী মানবিক চেতনা বর্তমান বিশ্বের মানুষের এক পরম সম্পদ।
ষড়ঋতুর আবর্তন শেষে নতুন বছর আসে আমাদের কাছে। সারা বছরের খতিয়ান করা হয় ব্যক্তিজীবনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে। দেখা যায় অনেক প্রিয় স্বপ্ন হয়তো বাস্তবায়িত হয়নি। তাই বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সবাই স্বপ্ন দেখে, কখনও ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সে স্বপ্ন বহুল স্বপ্ন হয়। আমরা প্রার্থনার মতো উচ্চারণ করি বাংলার মাটি হোক শস্যবতী, নদী হোক জলবতী, বাঙালির উদ্যম হোক কল্যাণমুখী। মানুষ যেন পশু না হয়, মানুষের হৃদয়ে যেন মানুষেরই ছায়া বিরাজমান থাকে। আমাদের প্রার্থনায় আশার বাদ্য বাজাও, বৈশাখ। আমাদের অমিত শক্তিকে অভিনন্দিত করো।
সেলিনা হোসেন
কথাসাহিত্যিক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি