× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অচেনা চিরবসন্তের দেশে পহেলা বৈশাখ

মামুনুর রশীদ

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৩৩ পিএম

আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৫৫ পিএম

মামুনুর রশীদ। ফাইল ছবি

মামুনুর রশীদ। ফাইল ছবি

মুঘল সেনাপতি ইসলাম খাঁ ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে রাজমহল থেকে ঢাকায় সুবে বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন। এ আয়োজনে অগ্রবর্তী বাহিনীর দায়িত্ব পালন করেন তার সুদক্ষ সেনাপতি মির্জা নাথান। বাংলায় তখন অসংখ্য নদনদী, খালবিল বলতে গেলে জলা-জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কখনও স্থলপথে কখনও নৌপথে নানাভাবে তাঁকে ঢাকায় আসতে হয়েছিল। পথে ভাগীরথী নদী। নদী পার হতেই তিনি থমকে গেলেন। প্রচণ্ড গ্রীষ্মেও ঘাস কী করে সবুজ থাকে! সঙ্গে সঙ্গে এও দেখলেন, চারদিকে সবুজের সমারোহ। তখন বসন্তকাল শেষ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এ অভিযান শুরু হয়েছে। এরপর এই সবুজের মধ্য দিয়ে বড় বড় নদী পেরিয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছালেন। তাঁর অনুভবে বাংলা দাঁড়িয়ে গেল ‘বাহারিস্তানে গায়েবি’ হিসেবে, যার অর্থ ‘অচেনা চিরবসন্তের দেশ’।

এ নামে ফারসিতে তাঁর বইটি এখনও বাংলা নিয়ে যারা গবেষণা করতে চান, তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক। কিন্তু এখন তা আর গবেষকদের বা ঐতিহাসিকদের কাছে নয়, সাধারণ পাঠকের কাছেও একটি কৌতূলোদ্দীপক বই। ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তরের আরও কারণ ছিল। একটি বড় কারণ বারো ভূঁইয়া এবং মগ জলদস্যুদের দমন। সে কাজে ইসলাম খাঁ সমর্থও হয়েছিলেন, যদিও তিনি এখানে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতবিরোধ আছে। কেউ বলেন, ঢাকার বাইরে থেকে অসুস্থ হয়ে ফিরলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কেউ বলেন, দুপুরের খাওয়ার সময় নিজ দুর্গেই তিনি বোমার আক্রমণে মারা যান। এরপর ইব্রাহিম খাঁ ঢাকার সুবেদার হন। এ সময়ই যুবরাজ শাহজাহান বিদ্রোহী হয়ে বাংলায় চলে আসেন। ইব্রাহিম খাঁর ওপর নির্দেশ আসে শাহজাহানের বিদ্রোহ দমন করতে হবে। সেই বিদ্রোহ দমনকালে ইব্রাহিম খাঁ গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিজয়ী শাহজাহান ঢাকায় প্রবেশ করেন এবং লাখ লাখ টাকা, স্বর্ণ ও মূল্যবান সব বস্তু অধিকার করেন। সঙ্গে ছিল ঢাকার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মসলিন। শাহজাহান মাত্র কয়েক দিন পরই ফিরে যান। কিন্তু ঢাকা বড় বিশৃঙ্খলায় পড়ে যায়। পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা ঢাকায় লুণ্ঠন, বর্বরতা চালিয়ে যায় এবং বিপুল অর্থ নিয়ে চলে যায়।

এরপর শায়েস্তা খাঁ এসে ঢাকাকে নিরুপদ্রব করেন এবং টাকায় আট মণ চাল কেনার একটা অর্থনীতি চালু করেন। সুজলা-সুফলা বঙ্গদেশের ওপর যতই লুণ্ঠন হোক না কেন, ১৭০০ সাল পর্যন্ত আওরঙ্গজেব বছরে ১ কোটি টাকা এখান থেকে নিয়ে যান। ইতিহাসের এই ছোট্ট উদাহরণটা দেওয়ার প্রয়োজন এই যে, দুর্গম নদীবহুল এ বাংলায় মানুষ এত প্রতিকূলতার মধ্যেও কেমন করে বেঁচে থাকত? অনাহারে ক্লিষ্ট মানুষও আকবর প্রবর্তিত নববর্ষে মানে বৈশাখ মাসে তাদের খাজনাটি পরিশোধ করত। যদিও এ সময়টা নবান্ন নয়।

একসময় ঢাকা থেকে রাজধানী সরে যায় মুর্শিদাবাদ। ঢাকার নায়েব-নাজিমরা যতটা এখানকার সম্পদ লুণ্ঠনে ব্যস্ত ততটা ঢাকার দিকে তাকাননি। এত কিছু সত্ত্বেও ঢাকার জৌলুশ বিশ্বের নানা দেশের মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সপ্তডিঙা মধুকর সম্ভবত বাংলা থেকেই প্রাচ্যের এবং পাশ্চাত্যের ফসল বন্দরে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসত বাংলার সব সম্ভার। জানা যায়, এ সময় প্রায় ১ লাখ পাউন্ডের মসলিন ইউরোপের দেশগুলোয় যেত। বাংলার বয়নশিল্প ইউরোপের দেশগুলোয় রপ্তানি হতো।

মুঘলদের পরে আসে ইংরেজরা। নিষ্ঠুর, লুণ্ঠনপটু বর্বর ব্রিটিশরা লুণ্ঠন এবং নিপীড়ন শেষে একটা দরিদ্র বাংলাকে রেখে চলে যায়। ধর্মকে ব্যবহার করে বাংলাকে দুই টুকরো করে ভাইয়ে ভাইয়ে এক লড়াই লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। পাকিস্তানি শাসক প্রথমেই বেছে নিল ভাষা, তারপর সংস্কৃতি, একের পর এক সংঘাত করতে লাগল। কিন্তু বাঙালিকে পরাজিত করতে পারল না। নিজেই আত্মসমর্পণ করে চলে গেল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ এত লুণ্ঠন, এত আঘাতের পরও বাঙালি এগিয়ে গেল কীভাবে? একমাত্র যুদ্ধ, মহামারি ছাড়া কখনও পহেলা বৈশাখ পালন বন্ধ হয়নি। সংস্কৃতির অন্তঃসলিলা শক্তি কোনো দিন ব্যাহত হয়নি।

একদিকে সুফি-সাধকদের পরিক্রমণ, অন্যদিকে বাউলদের শান্তির বাণী একটা বড় শক্তি হিসেবে সমাজে আবির্ভূত হয়েছে। মানুষ হয়েছে আপসহীন। লালন শুধু শান্তির বাণীই প্রচার করেননি, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ, শ্রেণিশোষণ, ধর্মীয় নিপীড়ন এবং আন্তর্জাতিকতার বাণী তার গানে প্রচার করে গেছেন। শিল্পের উপাদানকে সামাজিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন উদ্দীপনায় মানুষ জেগে উঠেছে। মরমি গায়ক, পালাকার, অভিনেতা, শিক্ষাগুরুরা সমাজে একটা সংস্কৃতির নবতরঙ্গ তুলেছেন এবং উন্নত রুচির নির্মাণ করেছেন।

মৃত্তিকালগ্ন মানুষই সমাজের অভ্যন্তরে নতুন চিন্তা এবং দার্শনিকতা জন্ম দিয়েছে। তীর্থগুলোও সব সময় সংস্কৃতির পাদপীঠ হয়ে উঠেছে। সমাজের নানা অমঙ্গলকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আচার অনুষ্ঠান এবং প্রতীক ব্যবহার করে মানুষের ঐক্য ধরেও রেখেছেন তাঁরা। লোকায়ত দর্শন আর লোকসংস্কৃতির জন্ম সেখান থেকেই। কিন্তু এসবই নির্বিবাদে হয়নি। সমাজের ভেতর সব সময় দুর্বৃত্তয়ানও লুকিয়ে থাকে। দুর্বৃত্তের মাথা চাড়া দেওয়ার অভ্যাস সেই প্রাচীনকাল থেকেই। কিন্তু মানুষের প্রাত্যহিক গতিময়তা সেসব অতিক্রম করেছে ঐক্যবদ্ধভাবে।

আজ পহেলা বৈশাখে যে মঙ্গলযাত্রার বিরুদ্ধে দুর্বৃত্তের হুংকার শোনা যায় তা-ও কাগজের বাঘের একটা পাঁয়তারা। মানুষের ঐক্যের আয়োজনে তা খড়কুটোর মতোই ভেসে যাবে। উদীচীর অনুষ্ঠানে, রমনার বটমূলের বোমা হামলায় মানুষ এতটুকুও দ্বিধান্বিত হয়নি। এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। এগিয়ে যাওয়াই সমাজের ধর্ম। বিদেশি সেনাপতি মির্জা নাথান যে বাংলাকে দেখেছিলেন অচেনা চিরবসন্তের দেশ, তা বারবার বিদেশি শাসন-শোষণে কখনও বিধ্বস্ত হলেও ঝড়ের পরে প্রকৃতি যেমন শান্ত সামাহিত রূপে প্রকাশ পায় তেমনি বাংলাও নিজেকে প্রকাশ করে তার অনমনীয় চেহারা নিয়ে। তাই যতই বিনাশী আয়োজন হোক, প্রকৃতি আর মানুষ নিজেকে রক্ষা করবে নতুন রূপে।

তাই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বৈশাখের আবাহন চলবে অনন্তকাল।


মামুনুর রশীদ,

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা