আহমদ রফিক
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৪৭ পিএম
আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:১৩ পিএম
আহমদ রফিক
বাঙালির জীবনযাপন উৎসব-পার্বণকেন্দ্রিক। এসব উৎসব-পার্বনের সেই সুদূর অতীত থেকে ধর্মীয় আবরণে হলেও এসব ক্ষেত্রে অংশীজন ছিল সমাজের প্রায় সব স্তরের শুভবোধসম্পন্ন মানুষই। যে অসাম্প্রদায়িকতা ছিল আমাদের মূলশক্তি এর ওপর বারবার অপশক্তি আঘাত করে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনাকে দুর্বল করার চেষ্টা বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে।
কিন্তু আশার কথা হলো, প্রগতিমনা অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। বলতে গেলে ঘাত-প্রতিঘাতে আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা আরও ঋদ্ধই হয়েছে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ এই ভূখণ্ডের গণমানুষের সাহিত্য, সংগীত, ভোজনরীতি, পোশাক, উৎসব ইত্যাদির মিথস্ক্রিয়াকে বোঝানো হয়। এই ভূখণ্ডের বাঙালিদের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের বেশি পুরোনো। আমাদের সংস্কৃতির আলো অনেক ছড়ানো। পরিধি বিশাল ও ব্যাপক।
এক কথায় বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে প্রথিত। একই সঙ্গে এও সত্য, আমাদের যে নিজস্ব সংস্কৃতি তা অত্যন্ত পুষ্ট এবং এর উপাদান অনেক। এই পুষ্ট সংস্কৃতিকে এবং উপাদানে আঘাত করে অপশক্তি ঢেকে দিতে চেয়েছে অন্ধকারে। কিন্তু পারেনি। স্বাধীনতার পূর্বাপর প্রতিটি গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম, অধিকারের আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর বারবার প্রকাশ ঘটেছে।
এর মধ্য দিয়েই আমরা অন্ধকারকে পরাভূত করে আলোর সন্ধান করেছি এবং এই আলোর বিচ্ছুরণ আমাদের সামনের পথ আলোকিত করেছে। আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে উদ্বুদ্ধ নববর্ষ উদযাপন এবং এই উৎসবকেন্দ্রিক নানা আয়োজনের আজকের যে বিকাশ এর প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে অতীত।
এই সমাজে চৈত্র সংক্রান্তির যে আয়োজন তাও অনেক পুরোনো এবং এ ক্ষেত্রে আমরা প্রকৃতির আভা প্রতিভাত হতে দেখি। আমাদের এখানে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ নববর্ষ উদযাপনের স্বীকৃতি জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ইউনেসকো থেকেও মিলেছে।
অসাম্প্রদায়িকতার দিক থেকে বিবেচনা করলে পহেলা বৈশাখ অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রকৃতিগতভাবেও বৈশাখের গুরুত্ব সমভাবেই স্বীকার্য। সব মিলিয়ে বৈশাখ উদ্দীপনামূলক এক মাস, যা আমাদের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে, ভবিষ্যতের জন্য পুষ্ট করে। পহেলা বৈশাখ সব সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবনব্যবস্থা গড়তে উদ্ধুদ্ধ করে।
বাঙালি যে বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি এর প্রমাণ ইতিহাসের অধ্যায়জুড়ে রয়েছে এবং একই সঙ্গে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের আমাদের এই সাজাত্যবোধ ও বাঙালিয়ানা নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করে আরও অনেককে উজ্জীবিত করেছে। এর নজির কিন্তু আমাদের সামনে কম নেই।
আমরা দেখছি, পহেলা বৈশাখে আমাদের নান্দনিক আয়োজন সবার মঙ্গল কামনায় হয়ে থাকে। অন্ধকারের শক্তিকে হটিয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা, যার ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়, তাতে অনেক বিদেশিও উচ্ছ্লভাবে শরিক হন। আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতি ৫২ বছরের, বিশেষ করে বলতে গেলে বিগত এক যুগে যথেষ্টই হয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, সব ক্ষেত্রে আমরা এখনও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। অধিকারের ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে, শিক্ষা ক্ষেত্রে এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বৈষম্যের ছায়া বিস্তৃত। তবে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্যের ছায়া ক্রমেই বাড়ছে তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এবং অঙ্গীকার-প্রত্যয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মূল অঙ্গীকার ছিল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আক্ষেপ আছে অনেক। আমরা এর কোনোটিই এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রূপ দিতে পারিনি। এর পেছনের অন্যতম কারণ রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
হীনস্বার্থবাদী কিছু রাজনীতিকের কারণেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এ দেশে ফের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ পায়। এসব কিছুই কম কথায় বলে তা শেষ করা যাবে না। প্রগতিবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা তো বটেই, সচেতন মানুষমাত্রই তেমন অজানা নয়।
নববর্ষ উৎসব উদযাপন এবং আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই যেন সব কিছু শেষ হয়ে না যায়, কিংবা থেমে না থাকে। এর চেতনা লালন-ধারণ করে আমাদের ঋদ্ধ সংস্কৃতির। আলোকে মানুষে মানুষে বন্ধন আরও সুদৃঢ় করতে হবে। অন্ধকারের সব শক্তিকে হটিয়ে দিতে যূথবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নজর দিতে হবে প্রান্তজনদের দিকে।
তাদের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় শামিল করে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় আরও দৃঢ় করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শূচি হোক ধরা…।’ রবীন্দ্রনাথের এই প্রত্যাশা প্রগতিবাদী সচেতন সবার হৃদয় স্পর্শ করেছে।
তার প্রত্যাশাযুক্ত এই আহ্বানেই আমরা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রায় শরিক হই। বৈশাখের অনুষ্ঠানমালায় তা হয় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিভাত। ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক শক্তি তথা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ধারক সবাইকে একত্রিত হয়ে একটা প্রবল সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করতে হবে।
এই আন্দোলন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এই আন্দোলন অশুভশক্তিকে হটানোর আন্দোলন। এই আন্দোলন প্রগতির আলো আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলন। এই আন্দোলন অধিকারের ভূমি সমতল করার আন্দোলন। এই আন্দোলন ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতার অপছায়া সরনোর আন্দোলন।
এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে, অধিকারের সব বিষয় নিশ্চিত করে স্ববিরোধীদের হটিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আরও দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জমিন তৈরি করার আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মৌলবাদীদের সব আস্ফালনের পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
আমাদের প্রাণের পহেলা বৈশাখে বরাবরের মতো এবারও যার যার অবস্থান থেকেই অসাম্প্রদায়িক উৎসবে আমরা প্রাণে প্রাণ মেলাব।
বাঙালির আত্ম পরিচয়ের অনুসন্ধান বাংলা নববর্ষে বাঙালির ইতিহাসজুড়ে যে বিশাল ভূমিকা তার মর্মার্থ যেন আরও গভীরভাবে আত্মস্থ করতে পারি। বাংলা নববর্ষ ফিরে ফিরে আমাদের জীবনে আসবেই। উদযাপিত হবে উৎসবও। দিনবদলের পালায় উৎসবকে ঘিরে রচিত হবে নতুন অধ্যায়ও।
রমনার বটমূল থেকে শুরু করে মহানগর-নগর-শহরজুড়ে পহেলা বৈশাখে চিরন্তন আহ্বান নিয়ে আমরা দাঁড়াব। কিন্তু আমরা যেন আমাদের শিকড়ের দিকে তাকাতে ভুল না করি। গ্রামবাংলার যে ঐতিহ্য এবং গ্রামই যে আমাদের শক্তির মূলকেন্দ্রÑ এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
আমাদের সংস্কৃতির শিকড় কিন্তু সেখানেও ব্যাপকভাবে ছড়ানো। বলা যায়, মূল ক্ষেত্র তো সেখানেই। আমরা যদি আমাদের মিলনকে যথার্থ করতে চাই, প্রাচুর্য ও সৌন্দর্যকে রক্ষা করতে চাই, তাহলে আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি-ঐহিত্যকে আরও গভীরভাবে ধারণ করে লালন করতে হবে।
শেষ করি রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বিভোর, সেদিন সব মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ বাঙালির সব উৎসবের সর্বজনীন রূপ আরও আলোকোজ্জ্বল হোক। দূর হোক অন্ধকার। আলো, আরও আলো চাই। বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হোক। প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়া দূর হোক। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আহমদ রফিক
ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক