× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার আলো

যতীন সরকার

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৫৫ পিএম

যতীন সরকার। প্রবা ফটো

যতীন সরকার। প্রবা ফটো

অফিস, আদালত কিংবা যেকোনো প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা এখনও ইংরেজি বছরকে অনুসরণ করি। ইংরেজি বছর শুধু আমরাই অনুসরণ করি, এমনটি নয়। অন্যান্য অনেক দেশই তা করে। তারপরও কোনো রাষ্ট্রই তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করতে পারে না। নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে বৈচিত্র্য আছে। এক অঞ্চলের ঐতিহ্য কিংবা সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য অঞ্চলের সংস্কৃতির মধ্যে ফারাক আমাদের চোখ এড়ায় না। তবে প্রায় সব দেশের ঐতিহ্যেই নিজেদের বর্ষবরণের প্রথা রয়েছে। বাংলাদেশেরও নিজস্ব বর্ষবরণের উৎসব আছে।

বাংলা নতুন বছরকে বঙ্গাব্দ বলে অভিহিত করা হয়। আমাদের দেশে শুধু বাঙালিরাই বর্ষবরণ উৎসব ঘটা করে পালন করে এমনটি বলা যাবে না। সংখ্যালঘু জাতিসত্তারাও বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈসাবি উৎসব পালনের প্রথা বহু পুরোনো। এই বৈসাবি উৎসবও মূলত বৈশাখকে অবলম্বন করেই। বর্ষবরণের আয়োজনে নানা পরিবর্তন এসেছে। এখন আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানের মাধ্যমে বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানাই। কাকতালীয়ভাবে বৈশাখেই রবীন্দ্রনাথের জন্ম। তাই বৈশাখ এলেই আমরা আমাদের জাতিগত সংস্কৃতি স্মরণ করি। বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতিফলন বৈশাখজুড়েই পালন করা হয়। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রেও আমাদের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে ধর্মের ভিত্তিতে দুটো দেশভাগ হয়। বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের একটি অংশ। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিপালনে বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎসব বৈশাখকেও বাতিল করে দিতে চেয়েছিল। বৈশাখ হিন্দুয়ানি উৎসব বলে অপপ্রচার শুরু করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা।

এমন অন্যায়ের প্রতিবাদে বাঙালি সমাজ সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। ওই সময় থেকেই বাংলা নববর্ষকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপনের চল শুরু করি আমরা। পাকিস্তান শাসনামলে রমনার বটমূলে নববর্ষের আয়োজনের সূচনা ঘটেছিল এবং উদযাপনের এই উৎসাহ আজও চলমান। পহেলা বৈশাখ আজ শুধু আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার জাগরণ ঘটায় না। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে আমরা নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম হই। এজন্যই রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে নববর্ষকে আহ্বান করা হয়।

নববর্ষকে আহ্বান করতে গিয়ে আমরা এক ধরনের আত্মসচেতনতা গড়ে তুলতে পারি। বাঙালির এই আত্মসচেতনতার প্রকাশ ঘটাতেই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। বৈশাখ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকা তো বটেই, সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রার মাধ্যমে বৈশাখী উৎসবের শুরু ঘোষণা করা হয়। জাতিগত সাংস্কৃতিক চেতনার এই বিশেষ দিকটিকে আমরা হারিয়ে যেতে বসেছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানিদের নানা অপপ্রচারের কারণে। সন্দেহ নেই, তাদের এই অপপ্রচারই বাঙালিকে তার সংস্কৃতি সম্পর্কে আত্মসচেতন করে তুলেছে।

ফলে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় আমরা প্রতিবাদ করেছি এমনকি বাংলা নববর্ষকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির অপপ্রচারে তীব্র নিন্দা জানিয়েছি। স্বাধীন দেশে নতুন বছরকে আমরা আরও বিশেষভাবে স্মরণ করি। কিন্তু উৎসবের উৎসাহে নববর্ষ উদযাপনই যথেষ্ট নয়। বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে আত্মসচেতনতা গড়ে তোলাও জরুরি। 

সম্প্রতি জাতীয় সংসদের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি তার বক্তব্যে বলেন, ‘গণতন্ত্রবিরোধী সব অশুভশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’ বাংলা নববর্ষেও গণতন্ত্রবিরোধী অশুভশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। সংস্কৃতি সবার এবং গণতন্ত্র মানে মানুষের ঐক্যবদ্ধতা। নিজস্ব ঐতিহ্যের ক্ষেত্রেও তাই গণতান্ত্রিকব্যবস্থার অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। কারণ মৌলবাদী অপশক্তি বর্তমানে শক্তিশালী হয়ে না উঠলেও নানা সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে থাকে। তাদের এই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টাকে প্রতিহত আমাদেরই করতে হবে। বাংলা নববর্ষে যেমন নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, তেমনি নিজ কর্তব্যবোধের জায়গা থেকেও নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। 

যেমনটা বলেছি, রবীন্দ্রনাথের গান দিয়েই বাংলা নতুন বছরকে এখন উদযাপন করা হয়। বিগত বছরের অর্জন-অনার্জন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, গ্লানি, পরিতৃপ্তিকেও আমরা স্মরণ করি। এই পূর্বস্মৃতি আমরা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে পারি। পাশাপাশি বিগত বছরে যা অর্জন করতে পারিনি তা অর্জনের জন্য অনুপ্রেরণা নিতে পারি। শুধু তা-ই নয়, জাতি যদি উল্পোপথে হাঁটা শুরু করে তাহলে সাংস্কৃতিক একাত্মতার মাধ্যমে আবার সঠিক পথে ফিরে আসা সম্ভব হয়। কোনো অশুভশক্তি যদি ভুলপথে জাতিকে পরিচালনা করতে চায়, তাহলে নববর্ষের মাধ্যমে তাকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়। এগুলোই আত্মসচেতনতার বিষয়। নতুন প্রজন্মকে বাঙালি আত্মসচেতনতার দিক সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। 

বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ক্ষেত্রে একটি বিষয় আমার চোখে পড়ে। বাংলা নববর্ষের আয়োজনে সব শ্রেণির বাঙালিই অংশগ্রহণ করতে পারে। এই উৎসবের অংশ একজন নিম্ন আয়ের মানুষও। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষই দিনমজুর। অধিকাংশ সময় এই মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এই অসহায় মানুষের সামনেই একশ্রেণির মানুষ পান্তা ভাত খেয়ে বৈশাখ উদযাপন করে। বিষয়টি আমার দৃষ্টি প্রাকৃত বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি এক ধরনের ঠাট্টা-বিদ্রূপ ছাড়া কিছু মনে হয় না। দেশের সাধারণ মানুষ সব সময় পান্তা ভাত খেতে পারে না।

তাই পান্তা ভাত কোনো উৎসবের উপলক্ষ হতে পারে না। বাংলা নতুন বছরে প্রত্যেকেই একটু ভালো খাবারের আয়োজন করার চেষ্টা করে। দেশের যেকোনো প্রান্তে এমনকি গ্রামাঞ্চলেও আয়োজনের এই বিষয়টি আমাদের চোখ এড়াবে না। কাজেই পান্তাভাত নিয়ে একশ্রেণির মানুষের এই তোড়জোড়কে আমি কোনো মতেই সমর্থন করতে পারি না। 

এই মুহূর্তে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মূল চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এই উৎসবের অংশ হিসেবে সবাই যেন অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব বাঙালি তো বটেই, দেশে অবস্থানরত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষদেরও এই উৎসবে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। সবাই যেন এই উৎসবে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। সবার অংশগ্রহণই পারে জাতিগত একাত্মতার ক্ষেত্রে সচেতনতা গড়ে তুলতে।


যতীন সরকার

শিক্ষাবিদ ও লেখক

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা