× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

দুর্গার রূপক অনুসন্ধান

ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৩ ১২:২৬ পিএম

আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৩৮ পিএম

প্রচ্ছদ : গ‍ুপু ত্রিবেদী

প্রচ্ছদ : গ‍ুপু ত্রিবেদী



ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য

দুর্গা ও অসুরের যুদ্ধের কাহিনি কে না জানে? কে না জানে সুরথ রাজার দুঃখের কাহিনি? কিন্তু আধুনিক-কালের গবেষকদের মনে অন্য রকম একটা চিন্তাও মাথায় এসেছে। অবশ্য গবেষকদের ধারণা, এই তথ্যও আগেই ছিল বা এটাই দুর্গার আসল পরিচয়। বাইরের শত্রুদের আক্রমণের কারণে বহু গ্রন্থ বিনষ্ট হওয়ায় অথবা কাহিনি রূপকভাবে লেখার প্রচলন থাকায়, সেই কাহিনি আমরা জানতে পারিনি বা বুঝতে পারিনি। এ যুগের গবেষকরা হয়তো সেই তথ্যই নতুন করে প্রকাশ করতে চাচ্ছেন, হয়তো নতুন চিন্তাভাবনায় সেই তথ্যই ফিরে আসছে নতুন বাক্যবিন্যাসে। কী সেই পরিচয়? 

ভগবান কৃষ্ণ ছদ্মরূপ থেকে বের হয়ে তাঁর মা যশোদাকে যখন ঈশ্বরের রূপ দেখালেন, তখন তিনি তাঁর মুখের ভেতর গোটা মহাবিশ্বকে দেখতে পেলেন। অর্জুনকে যখন কৃষ্ণ বললেন, তাঁর মানুষের রূপটি ছদ্মরূপ, আসলে তিনি ঈশ্বর। তখন অর্জুন তার প্রমাণই চেয়ে বসলেন। কৃষ্ণ দেখালেন তাঁর আসল রূপ, অর্জুন দেখলেন গোটা মহাবিশ্বকে। একইভাবে স্বামী বিবেকানন্দও রামকৃষ্ণের কাছে ঈশ্বরকে দেখতে গিয়ে মহাবিশ্বকে প্রত্যক্ষ করে ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য ‘বেদ’-এ ঈশ্বরের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, গোটা মহাবিশ্বই নয়- ঈশ্বর এর চেয়েও দশ আঙুল পরিমাণ বেশি বা বড়। এবার বোঝা গেল, মহাবিশ্বই ঈশ্বর। তাহলে দেবতা কারা? গ্রন্থগুলো পড়লে এখানেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে মহাবিশ্বের বড় বড় শক্তিগুলো দেবতা। যেমন নক্ষত্র সূর্য অনেক বড় একজন দেবতা। সূর্যকে কেন্দ্র করে সৌরজগৎ। কিন্তু তাঁর চারদিকে ঘূর্ণায়মান গ্রহগুলোও যথেষ্ট বড় শক্তি- ফলে এরাও দেবতা। যেমন শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল প্রভৃতি। 

আমরা পৃথিবীতে বাস করি। কিন্তু পৃথিবীও একটি শক্তি এবং তিনিও দেবতা। পৃথিবীতে আছে জল, স্থল ও প্রাণ। জলের উৎস সমুদ্র আর এই সমুদ্রে যাঁর বাস, তিনি বিষ্ণু। অর্থাৎ সমুদ্র জলের প্রতীক হচ্ছেন বিষ্ণু। স্থলের সবচেয়ে উঁচু জায়গা হিমালয়, আর হিমালয়ের কৈলাসে বাস করেন শিব। অর্থাৎ মাটির প্রতীক শিব। তাহলে প্রাণ? হ্যাঁ, প্রথম প্রাণকে ধর্মে বলা হচ্ছে ব্রহ্মা, তাঁর থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে সব প্রাণ। কাজেই ব্রহ্মা প্রাণের প্রতীক। পৃথিবীর শক্তি নদীকে কিন্তু কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। মানুষের সভ্যতা নদীকে কেন্দ্র করেই যে সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মগ্রন্থ লক্ষ করুন, দেখবেন মোটেই উপেক্ষা করা হয়নি এই নদীকে। গঙ্গা, সরস্বতী প্রমুখ তো নদীই। যে সিন্ধু থেকে হিন্দু, সেই সিন্ধুও আসলে নদী। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, বাঙালির সবচেয়ে বড় দেবী দুর্গা তবে কে? তাঁর রূপক পরিচয় তাহলে কী? 

বেদে দুজন গুরুত্বপূর্ণ দেবীর নাম পাওয়া যায়। একজন উষা, অন্যজন রাত্রি। যেহেতু দুর্গাকে দিনে এবং কালীকে রাতে পূজা করা হয়। এ কারণে অনেকে মনে করেন, এই দিন এবং রাতই তাহলে দেবী দুর্গা এবং দেবী কালী। বিষয়টা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ দিন এবং রাতও শক্তি বৈকি। তবে মার্কণ্ডেয় পুরাণের কথা যদি ধরি, তবে দেখব, কেবল দিন দেবী দুর্গা নয়। সৌরজগতের সব শক্তির সমষ্টিকে বরং মনে হয় দেবী দুর্গা। তাঁদের সম্মিলিত তেজরাশি এবং তাঁদের দেওয়া অস্ত্র হচ্ছে শক্তির প্রতীক। সূর্যের আলো বা সৌরশক্তি হতে পারে এক্ষেত্রে দেবী উষা। অর্থাৎ সৌরজগতের সবচেয়ে বড় শক্তি দেবী দুর্গা, সবচেয়ে বড় দেবী, মা দুর্গা। সৌরজগতের সব শক্তির সম্মিলিত শক্তি বলেই তিনি এই জগতের সর্ববৃহৎ শক্তি। 

পুরাকালে দশ দিক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে মহিষাসুর নামক এক মহাপরাক্রমশালী দৈত্যকে দেবী দুর্গা পরাস্ত করেন। উল্লেখ্য মহিষাসুর ঈশ্বরের একসময়কার পরম ভক্ত। কঠোর তপস্যা দ্বারা তিনি কোনো একসময় স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। তবে আনন্দিত স্রষ্টা যখন তাকে প্রসন্নচিত্তে কিছু বর দিতে আগ্রহী হলেন; তখন মহিষাসুর কেবল অমরত্বের বর চাইলেন। অন্য বর কামনার জন্য বারবার অনুরোধ করার পরও মহিষাসুর যখন তার সিদ্ধান্তে রইলেন অটল; তখন সৃষ্টিকর্তা তাকে সেই বর দিয়ে দিলেন। কিন্তু এই বর প্রাপ্তির পরই মহিষাসুরের চেহারা গেল পাল্টে। তিনি ত্রিভুবনের অধীশ্বর হয়ে সর্বপ্রকার সুখ ও ভোগের মালিক হওয়ার জন্য শুরু করে দিলেন ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। তার এই নিষ্ঠুরতা এমন একটা পর্যায়ে গেল যে দেবতারাও হলেন স্বর্গচ্যুত।

স্বর্গচ্যুত দেবতারা এতে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন এবং তাদের ক্রোধরাশি থেকে তৈরি হতে থাকল তেজোদীপ্ত মহাশক্তি। এ মহাশক্তি আর কিছুই নয়; এই শক্তিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত শক্তি; সব দেবতার সম্মিলিত শক্তি; নারী রূপধারিণী মাতৃস্বরূপা দেবী দুর্গা। জগতের সব শক্তি একত্রভাবে সঞ্চিত হয়েই দেবী দুর্গা রূপে আসে মহিষাসুর দমনে।

কিন্তু মহিষাসুর তো অমর; অজেয়। তাকে কীভাবে সংহার করা যায়? দেবতারা স্রষ্টা (ব্রহ্মা) প্রদত্ত খানিক নিরীক্ষা করলেন এবং এরই ফাঁক নির্ণয় করে দুর্গার হাতে তুলে দিলেন অস্ত্র। দেবী দুর্গা অস্ত্র হাতে পেয়ে হুংকার দিয়ে উঠলেন; ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুর ওপর। কিন্তু অশুভশক্তি বহুরূপী। বারবার সে রূপ পাল্টায়। তাকে চিহ্নিত করাই একসময় দুর্গার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও তিনি মহাশক্তি; বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হলেও একসময় ঠিকই তিনি শত্রুকে চিহ্নিত করতে পারেন এবং পদানত করে তার বক্ষে বসিয়ে দেন শূল। তবে দেবতার বর একেবারে বিফলেও গেল না। আসুরিক শক্তি সব সময়ই রয়ে গেল জগতে।

ভালোর সঙ্গে মন্দ কাজও চলতে থাকল তার নির্দিষ্ট গতিতেই। অবশ্য শূলবিদ্ধ অসুরের পক্ষে যেমন যুদ্ধ জয় করা অসম্ভব; তেমনি শুভশক্তির পদানত অবস্থায় অশুভশক্তির চূড়ান্ত বিজয় লাভ করাও দুষ্কর। আসুরিক তাই শূলবিদ্ধ অবস্থাতেই দুর্গার পদতলে রয়ে গেল চিরকালধর্মীয় কাহিনি পর্যালোচনা করলে স্বর্গকে সৌরজগতের বাইরের কোনো স্থান মনে হতে পারে। অবশ্য সৌরজগতের ভেতরের কোনো অনাবিষ্কৃত স্থানকেও মনে হতে পারে স্বর্গ। কোনো একটি অপশক্তি সেই স্বর্গ ও পৃথিবীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেই হয়তো সৌরজগতে একটি পৃথক শক্তি তৈরি হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বড় বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পৃথিবীর অধিবাসীকেও বেশ আগে থেকেই দুর্গার স্মরণ নিতে দেখা গেছে। 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে কৃষ্ণও পাণ্ডবদেরে দুর্গার আরাধনা করার পরামর্শ প্রদান করেছিলেন। আমাদের কল্পনা ও চিন্তাশক্তি অসীম, তাই আমরা নানা ধরনের নতুন নতুন চিন্তাভাবনা করি। চিন্তা ও সত্যি যা-ই হোক না কেন, শক্তির উপাসনার জন্যই যে আমরা দুর্গাদেবীর আরাধনা করি, এ কথা কিন্তু সত্যি।

সত্য ও ন্যায় শক্তিপ্রাপ্ত হোক, জয়প্রাপ্ত হোক।

লেখক : অধ্যাপক, শাবিপ্রবি, সিলেট


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা