× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মাতৃমহিমা ও কুমারীপূজার তাৎপর্য

স্বামী দেবধ্যানানন্দ

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৪৭ পিএম

আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৪৮ পিএম

মাতৃমহিমা ও কুমারীপূজার তাৎপর্য



স্বামী দেবধ্যানানন্দ

সাধারণ্যে কলাবউ নামে সুপরিচিত যে মাতৃপ্রতিমা হলুদ শাড়িতে শোভিতা হয়ে দেবী দুর্গার কাঠামোর ডান পাশে আলাদা আসনে অবস্থান করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তিনি শাস্ত্রীয় ভাষায় নবপত্রিকাদুর্গা নামে অভিহিতা। নবপত্রিকাদুর্গা রচনায় প্রয়োজন হয় নয়টি গাছের শাখা, জোড়া বেল ও অপরাজিতা লতা। নয়টি গাছের মধ্যে রয়েছে— কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধান গাছ। ষষ্ঠীর দিন বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের সময় বেলতলায় বেলগাছের পাশে এবং সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিমাস্থ মা দুর্গার পাশে অবস্থান করেন নবপত্রিকাদুর্গা।

নয়টি গাছের শাখাসমন্বিত নবপত্রিকা শাস্ত্রজ্ঞদের দৃষ্টিতে সমস্ত প্রকৃতির প্রতিভূ। মা যেমন স্তন দিয়ে সন্তানের পুষ্টি বিধান করেন, সন্তানকে লালনপালন করেন; তেমন জগন্মাতাও প্রকৃতিরূপে সব প্রাণীর পুষ্টি বিধান করেন, সবাইকে লালনপালন করেন। 

শাস্ত্রীয় দৃষ্টিতে নবপত্রিকার প্রতিটি গাছে এক একজন দেবী অবস্থান করেন। কলাগাছে ব্রহ্মাণী, কচুগাছে কালিকা, হলুদ গাছে দুর্গা, জয়ন্তী গাছে কার্তিকী, বেলগাছে শিবা, ডালিম গাছে রক্তদন্তিকা, অশোক গাছে শোকরহিতা, মানগাছে চামুণ্ডা এবং ধানগাছে রয়েছেন মহালক্ষ্মী। প্রত্যেক দেবীরই পৃথক শক্তি রয়েছে। ব্রহ্মাণী পালনকারী শক্তি, কালিকা সর্বপ্রকার সিদ্ধি প্রদান করেন, দুর্গা বিঘ্ননাশকারী ও শান্তিদায়িনী, কার্তিকী জয় প্রদান করেন, শিবা বিজয় বর্ধন করেন, রক্তদন্তিকা জীবের পাপ নাশ করেন ও ক্ষুধা মিটিয়ে দেন, শোকরহিতা জীবের শোক দূর করেন, চামুণ্ডা মান দান ও মহালক্ষ্মী জীবের প্রাণ দান এবং জীবন রক্ষা করেন। নবপত্রিকাদুর্গার স্নান ও পূজা শ্রীশ্রীদুর্গাপূজার অন্যতম অঙ্গানুষ্ঠান। ওই অঙ্গানুষ্ঠানদ্বয়ে নবপত্রিকায় অধিষ্ঠিত প্রত্যেক দেবীর রূপ ও শক্তি পৃথকভাবে চিন্তা করে প্রত্যেক দেবীকে আলাদাভাবে স্নান করানো ও তাঁদের পূজা সম্পাদন করা হয়। নয়টি গাছে অধিষ্ঠিত দেবীদের প্রত্যেকে মা দুর্গারই ভিন্ন রূপ এবং প্রত্যেকে তাঁরই শক্তিতে শক্তিসম্পন্না।

আগুন ছাড়া দাহিকা শক্তি, দাহিকা শক্তি ছাড়া যেমন আগুন কল্পনা করা যায় না তেমন শক্তিমান ছাড়া শক্তি, শক্তি ছাড়া শক্তিমান কল্পনা করা যায় না। যত প্রকার শক্তির প্রকাশ রয়েছে জগতে, তা ভক্তের দৃষ্টিতে মা দুর্গারই শক্তির প্রকাশ। মা-ই জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-পালন ও সংহার করেন; সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি; অর্থাৎ হে দেবী আপনি সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের শক্তিরূপিণী। (শ্রীশ্রীচণ্ডী ১১/১১)। শ্রীশ্রীদুর্গাপূজা মাতৃরূপা সেই মহাশক্তিরই নানা রূপে ও ভাবে পূজা। যথার্থ ভক্ত মনে করেন, মায়ের শক্তিতেই আমরা সব কাজ সম্পাদন করছি, মা-ই সকল শক্তির উৎস। ভক্তের এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শান্তি, কল্যাণ ও উন্নতির পথে নিয়ে যায়। শ্রীশ্রীদুর্গাপূজা মাতৃমহিমা উপলব্ধি করার প্রয়াস।

শরণাগত ভক্তের তাই মহাশক্তিরূপিণী মাকে প্রণাম— যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা/নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ/যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা/নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।

দুই.

প্রেমাস্পদ জগজ্জননীর প্রকাশ বেশি যে সত্তায়, সেটি ভক্তের পূজা ও উপাসনার শ্রেষ্ঠ প্রতিমা। কুমারীপূজার বিশেষত্ব হলো প্রচলিত অর্থে কাঠ, মাটি বা পাথরের প্রতিমা, অথবা কোনো প্রতীকের সাহায্যে এ উপাসনা করা হয় না। চেতন কুমারীতে চৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বরের উপাসনা। অবশ্য যথার্থ ভক্ত চাইলে মৃন্ময় প্রতিমায়ও ঈশ্বরের চিন্ময়স্বরূপ প্রত্যক্ষ করতে পারেন। ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তিকে মাতৃরূপে উপাসনা করা সনাতন অধ্যাত্ম সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য। কুমারীপূজার উৎস ও ক্রমবিকাশ বিষয়ে জানার আগ্রহ আছে যাদের, তাদের জন্য বেদ-পুরাণ-তন্ত্রের কিছু তথ্য-ব্যঞ্জন না হয় পরিবেশন করা যাক। বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দেবীকে কুমারী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, ‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারী ধীমহি তন্নো দুর্গি : প্রচোদয়াৎ।’ বৃহদ্ধর্ম পুরাণ আমাদের জানাচ্ছেন, দেবী অম্বিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে আবির্ভূতা হয়ে বেলগাছে দেবীর বোধন করার নির্দেশ দেন।

কুমারীপূজার মাহাত্ম্য কীর্তন করে তন্ত্র বলছেন, কুমারীপূজা ছাড়া হোম প্রভৃতি কর্মে পরিপূর্ণ ফল পাওয়া যায় না। কুমারীপূজা দ্বারা হোমাদি কর্মের কোটি গুণ ফল লাভ হয়। কুমারীকে একটি ফুল দান করলে সুমেরু পরিমাণ ফল প্রাপ্তি হয়। কুমারীকে ভোজন করালে ত্রিলোকবাসী সবাইকে ভোজন করানো হয়।’ যেকোনো প্রসিদ্ধ শক্তিপীঠে দেবীকে কুমারীরূপে পূজা করা ওইসব পীঠস্থানের একটি বৈশিষ্ট্য। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজায় অষ্টমী তিথিতে কুমারীপূজা প্রবর্তন করেন। অনেকের মতে, দুই থেকে ১০ বছরের মেয়েদের পূজা করা যায়। শাস্ত্রমতে দুর্গাপূজার অঙ্গানুষ্ঠান হিসেবে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী বা এর যেকোনো দিন কুমারীপূজা করা যেতে পারে। এক থেকে ১৬ বছরের বালিকারা ঋতুবতী না হওয়া পর্যন্ত কুমারীপূজার যোগ্যা। বয়সভেদে কুমারীর বিভিন্ন নাম যেমন- সন্ধ্যা (এক বছর), সরস্বতী (দুই বছর), অম্বা (১৬ বছর)। কুমারীকে বস্ত্রালংকারে সুসজ্জিত করে, বিধিমতো নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে পাদ্য, অর্ঘ্য, ধূপ, দীপ, গন্ধ, পুষ্প, নৈবেদ্য ইত্যাদি ষোড়শোপচারে বাহ্যপূজা করা হয়। আবার হৃদয়ে ধ্যানের মাধ্যমে মানসপূজাও করা হয়।

কুমারীপূজা তথা ঈশ্বরীয় মাতৃপূজার তন্ত্রোল্লিখিত ফল কেউ লাভ করেছেন কি না, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান আমাদের নেই। কিন্তু ঈশ্বরের মাতৃরূপের পূজার মাধ্যমে রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, শ্রীরামকৃষ্ণের মতো মহৎ ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিহাসে অনেক মহৎ ব্যক্তি কুমারী গুণকীর্তন করেছেন। তাদের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অমিত আধ্যাত্মিক সম্পদের কাছে শাস্ত্রোল্লিখিত ফল নিতান্তই তুচ্ছ বলে মনে হয় যথার্থ ভক্তদের কাছে। পূজা মানে দেনা-পাওনা নয়। পূজার মূল উদ্দেশ্য আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে।

পূজা মানে ভালোবাসা। একটু ভেবে দেখলে আমরা বুঝতে পারি, ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে আমরা আসলে আমাদের অন্তরের আদর্শকেই সম্মান জানাই। তা অর্জন করার জন্য নিরন্তর প্রয়াস চালাই। কুমারীপূজায় আদর্শ ও মূল্যবোধের বিষয়টি আছে কি? ‘কুমারী’ সমগ্র নারীজাতির ও মাতৃভাবের প্রতিভূ। মাতৃভাব মানে কোনো কোমলতা, দুর্বলতা নয়; অন্যের কষ্টকে অনুভব করার শক্তি ও তদনুরূপ ব্যবহার। অর্থাৎ যিনি মাতৃভাবরূপ আদর্শ অনুশীলন বা লালন করবেন তিনি সমাজে অন্যের বেদনায় পীড়িত হবেন। কুমারীপূজা বা কুমারীকে সম্মান জানানো মানে সমগ্র নারীজাতিকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান। শুধু তাই নয়, এ পূজার মাধ্যমে উল্লিখিত মাতৃভাবের বিকাশও সম্ভব।

লেখক : মহারাজ, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা