× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সংকটে সহায় গীতা

রাজীব নন্দী

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:১৬ পিএম

সংকটে সহায় গীতা
রাজীব নন্দী

প্রাচীনকাল থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মুখ্যত পাঁচটি পথে ঈশ্বরের উপাসনা করে আসছে। বেদপরবর্তী যে দুটি গ্রন্থ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে, তা হলো চণ্ডী ও গীতা। উভয় গ্রন্থই নিত্যপাঠ্য। চণ্ডী ও গীতা উভয় গ্রন্থেরই উৎসস্থল যুদ্ধক্ষেত্র। এক যুদ্ধক্ষেত্রের স্রষ্টা পুরুষরূপে, অন্য যুদ্ধক্ষেত্রের স্রষ্টা নারীরূপে অন্যায়ের দণ্ড বিধান করেছেন। দেবদেবী পৃথক কিছু নন, ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তিরই প্রকাশ। দুর্গা ১০ হাতে শত্রু ধ্বংসে অস্ত্র ধারণ করেছেন, সব দেবতাকে সঙ্গী করে। চণ্ডী ও গীতার অনেক শ্লোক আছে, যেগুলো ব্যাখ্যা করলে উভয়ই এক ব্রহ্মের কথাই বলে। 

সনাতন ধর্ম যতটা না লৌকিক নিয়মের বাক্সে বন্দি, তার চেয়ে বেশি ব্যবহারিক। যতটা না শাস্ত্রাচার, তার চেয়ে বেশি পাঠ ও অনুশীলন। এ ধর্মে মিথলজির এত প্রভাব যে, একজন সংশয়ী বা অবিশ্বাসী ব্যক্তিরও এ ধর্মের ব্যাপারে কৌতূহলী হওয়া স্বাভাবিক। এ ধর্মের সারকথা হলো গীতা। এটি একটি বই, যাকে পবিত্রজ্ঞানে পূজা করা হয়। বলা হয়, জীবনের সব সংকটের কথা গীতার পাতায় বিধৃত। আসলেই কি তাই? দামোদর ধর্মানন্দ কোসম্বীর উপলব্ধি, ‘গীতাকে যত সম্মান করা হয়, লোকেরা বইটি ততখানি পড়ে না, বোঝে না।’ গীতাকে ‘শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী’ হিসেবে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী উভয় পক্ষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

গীতা কী? গীতা একটি ছোট্ট বই। গীতা ‘মহাভারত’-এর একটি অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে মুদ্রিত ও পঠিত হয়ে চলেছে। সে অর্থে সেটি নিশ্চয়ই একটি গ্রন্থ। যে গ্রন্থের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় আছে অর্জুন ও কৃষ্ণের কথোপকথন। হ্যাঁ, যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে মনোবল দেওয়ার বাণীর নামই গীতার বাণী। বিগত ৩ হাজার বছরে ভারতীয় ভাষাগুলোয় যত বই রচিত হয়েছে তাদের মধ্যে সব থেকে বেশি প্রভাবশালী সম্ভবত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, যদিও এটি মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একটি ছোট গ্রন্থাংশ। হিন্দুধর্মের যেসব ‘গ্রন্থ’ পবিত্র বলে মনে করা হয়, যেগুলোকে নিয়মবিধির উৎস বলে মানা হয় (উপনিষদ, গীতা, ব্রহ্মসূত্র, যেটাকেই ধরা যাক না কেন), তার কোনোটিরই এমন কোনো সর্বসম্প্রদায়সম্মত ভাষ্য পাওয়া যায় না। গীতার পাতায় পাতায় আছে কৃষ্ণ-অর্জুনের নানাবিধ বিচিত্র প্রশ্ন ও উত্তর। কৃষ্ণের মুখে শত শত প্রশ্নের উত্তর শুনে অর্জুন পেল মনোবল, পেল শক্তি, পেল ইচ্ছা। অর্জুনকে বলা হলো, এই দেখো আমার বিশ্বরূপ। তুমি এদের কি মারবে? আমি তো আগেই মেরে রেখেছি। তুমি নিমিত্তমাত্র। এ ধর্মযুদ্ধ শেষে একটি নতুন যুগের শুরু হবে। তোমরাই হবে তার কান্ডারি। যুদ্ধ শেষে রাজ্য নিয়ে তোমরাই এগিয়ে যাবে। 

কৃষ্ণের মুখে এসব শুনে সম্বিৎ ফিরে পেলেন অর্জুন। বুঝতে পারলেন যুদ্ধ না করে আর উপায় নেই। যুদ্ধের শঙ্খধ্বনি পাঞ্চজন্য আর সুদর্শনে একবার ফুঁ দিয়ে উঠলে যুদ্ধ হবেই। এ যুদ্ধ অর্জুনের চাওয়া-না চাওয়ার হিসাবের বাইরে। অর্জুন বিরাট দ্বন্দ্বে পড়ে দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া কেউ নেই পাশে। তাই ভয় কাটাতে কৃষ্ণের কাছেই আশ্রয় চাইলেন। কৃষ্ণ প্রথমে দেখলেন অর্জুন সত্যিই আশ্রয় চাইছেন। এটাই ভক্তিমার্গের প্রথম পাঠ। পূর্ণ সমর্পণ। সমর্পণ তো হলো কিন্তু অর্জুনের মনে যে দ্বিধা রয়ে যাচ্ছে, রয়ে যাচ্ছে সমূহ সংশয়; থাকছে হতাশাও! এখন উপায়? অর্জুন বললেন, ‘হৃদয়দৌর্বল্যে আক্রান্ত আমি, ধর্ম-অধর্ম জ্ঞানহারা, বিমূঢ় চিত্ত আমি, তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি— আমার পক্ষে যা কল্যাণকর, তা তুমি নিশ্চিত করে বলো। আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাগত, আমাকে উপদেশ দাও।’ ‘নিঃশর্ত সমর্পণ’। হ্যাঁ, অর্জুন যখন নিঃশর্ত সমর্পণ এবং পূর্ণ সমর্পণ করলেন, তখনই কৃষ্ণ তাঁকে ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করলেন। 

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে প্রচণ্ড ধমক দিলেন, লজ্জা দিলেন, কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলেন। পরে ভালোবেসে বুকে টেনে নিলেন! ধমক খেয়ে, লজ্জা পেয়ে, ভালোবাসা পেয়ে অর্জুনের জ্ঞান হলো। ধর্মবিশ্বাসীরা যাকে বলেছেন, ‘চেতনা ফিরে পেলেন’। কিন্তু আমার মতো সংশয়ীদের মতে, আসলে অর্জুন আরও বড় বিপাকে পড়েছেন। তিনি এখন না পারছেন যুদ্ধের অস্ত্র ছাড়তে, না পারছেন ধরতে। তাই কৃষ্ণের কাঁধে ভর করে পার হতে চাইছেন! অর্জুন নিজের হৃদয়দৌর্বল্য স্বীকার করছেন, আবার নিজেকে ‘অজ্ঞানী’ স্বীকারোক্তি দিয়ে কৃষ্ণের ঘাড়ে চড়েছেন। তার মানে দাঁড়াল, ‘তুমিই বলো বাপু এ অবস্থায় আমি কী করব? যুদ্ধে যদি পাপ হয় তাহলে দায়ী তুমি। যদি হেরে যাই তাহলে দায়ী তুমি। আর যদি জিতি তবে তো কৃতিত্ব আমার!’

ভগবান কৃষ্ণ তো জানেন তাঁর ভক্ত একবার যদি ভয় পান, তবে তাঁকে দিয়ে আর কোনো দুঃসাহসিক কাজ করানো যাবে না। এদিকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ময়দানে অর্জুনকে পেয়ে বসেছে ‘ভয়’। কারণ অর্জুন যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করতে অনীহা দেখাচ্ছেন, তিনি বিষাদে আক্রান্ত, ভয়ে গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে সব কর্তব্য থেকে। পরীক্ষার আগের রাতে প্রস্তুতিহীন শিক্ষার্থীর যা হয়, তেমন আর কি! অথচ আমরা জানি, মানুষ সাহস করে কত কাজ করে ফেলে। নদী পেরিয়ে যেতে পারে সাঁতরে, সামান্য বাঁশের সাঁকোর ওপর দিয়ে হেঁটে আগুন পেরোতে পারে সার্কাসের খেলায়। শূন্যে লাফ দেয় অনেকেই। যারা এসব করে, তারা যদি ভয় পায় তাহলে ঘটে নির্ঘাত দুর্ঘটনা। কিন্তু এসব পেশার লোকেদের ভয় পেতে নেই। বিমূঢ় অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে হতাশ দেখে কৃষ্ণ বলছেন, ‘হে পার্থ! কাতর হোয়ো না। এমন দুর্বলতা তোমার শোভা পায় না। তুমি তোমার তুচ্ছ হৃদয়দৌর্বল্য পরিহার করে সত্বর উত্থিত হও।’ এই বলে শুরু গীতার। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে থাকল ‘সওয়াল জওয়াব’। এরকম সব ক্লাইমেক্স আর মোটিভেশনাল বক্তব্যে ভরা বইয়ের নাম গীতা। গীতার বাণী তাই অমৃতপানের মতো। গীতা আমার পড়া পৃথিবীর অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ মনোবলের বই।

অন্য একটি প্রসঙ্গ টেনে লেখাটি শেষ করি। গত ২১ জুলাই মুক্তি পেয়েছে ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ছবি ‘ওপেনহাইমার’। ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘পিকি ব্লাইন্ডার্স’ খ্যাত অভিনেতা কিলিয়ান মারফি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যালামস ল্যাবরেটরির অধিকর্তা ছিলেন পদার্থবিদ ও ‘পরমাণু বোমার জনক’ জে রবার্ট ওপেনহাইমার। তার জীবন ও ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এ তার ভূমিকা এ ছবি। আগাগোড়া পশ্চিমের সিনেমা হলেও গীতার সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে ওপেনহাইমারের। ছবিতে নিজের চরিত্রের জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ভগবদ্‌গীতা পাঠও করেছেন কিয়িলান মারফি। ছবিতে একটি দৃশ্যে ফ্লোরেন্স পিউয়ের চরিত্র জিন ট্যাটলকের সঙ্গে সঙ্গমের সময় ভগবদ্‌গীতা পাঠ করছিলেন ওপেনহাইমার চরিত্রটি।

একটি বিশেষ অন্তরঙ্গ দৃশ্যে দেখা যায়, আলমারির তাক থেকে গীতা নামিয়ে জিনকে বিশেষ কয়েকটি লাইনও বলেন ওপেনহাইমার। তার পরই ঘনিষ্ঠ হন তারা। ‘পারমাণবিক বোমার জনক’ নামে পরিচিত ওপেনহাইমারের অন্যতম জনপ্রিয় উক্তি ছিল, ‘আমিই মৃত্যু, পৃথিবীর ধ্বংসের কারণ।’ গীতার একাদশ অধ্যায়ের ৩২তম শ্লোকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এ কথা বলেছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে কিলিয়ান জানান, গীতার ওই শ্লোক ওপেনহাইমারকে শুধু সান্ত্বনা দেয়নি, তাকে শান্তিও দিয়েছিল। গীতা পড়ে তিনি নিজেও অনুপ্রাণিত হয়েছেন, জানান অভিনেতা। সাধে কি আর বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধারম্ভসময়ে কৃষ্ণার্জ্জুনে এই কথোপকথন হইয়াছিল, ইহা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু গীতাকার এইরূপ কল্পনা করিয়া কৃষ্ণপ্রচারিত ধর্ম্মের সার মর্ম্ম সঙ্কলিত করিয়া মহাভারতে সন্নিবেশিত করিয়াছেন, ইহা বিশ্বাস করা যাইতে পারে।’

লেখক : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা