× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আমলাগিরির প্যাঁচে এত গাড়ি কব্জা!

এম আর মাসফি

প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ ১০:২৩ এএম

আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:১১ এএম

আমলাগিরির প্যাঁচে এত গাড়ি কব্জা!

সরকারের একজন উপসচিব মাস শেষে বেতনভাতা পান নিচে ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা, ওপরে ৯৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে পান একটি গাড়ি ও গাড়িতে চড়ার যাবতীয় খরচ। উপসচিবের এক ধাপ ওপরেই থাকেন যুগ্ম সচিব, তার ওপরে অতিরিক্ত সচিব, তারপর সচিব আর সর্বোচ্চ ধাপে সিনিয়র সচিব। এভাবে ধাপে ধাপে বেতনভাতা বাড়তে বাড়তে একজন সচিবের পকেটে মাস গেলেই সরকারি কোষাগার তথা জনগণের টাকা ঢোকে প্রায় দেড় লাখ। আর সিনিয়র সচিবের আরেকটু বেশি। সরকারের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা আমলারা মোটা অঙ্কের বেতনভাতার সঙ্গে পান দামি একটা গাড়িও। নিচে উপসচিব, ওপরে সিনিয়র সচিব- সবার বেতনভাতার সঙ্গেই যুক্ত করে দেওয়া আছে একটি করে গাড়ি। কিন্তু, জনগণের সেবকদের জনগণের টাকায় দেওয়া এই গাড়ি নিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশের অনুসন্ধানজালে উঠে এসেছে গুরুতর সব অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা। 

আগে নিয়ম ছিল, আমলাদের গাড়ি দেবে সরকার; সঙ্গে চালক, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। পরে ২০১১ সালে এক সার্কুলারের মাধ্যমে যুগ্ম সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত সব আমলার জন্য ‘সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে নিজের পছন্দসই গাড়ি কিনতে পারবেন; সেই সঙ্গে সরকার থেকে গাড়ির খরচ বাবদ পাবেন আরও ৫০ হাজার টাকা। এমনকি ঋণ শোধ হওয়ার পরও বেতনভাতার পাশাপাশি অতিরিক্ত ওই ৫০ হাজার টাকা তিনি পেতেই থাকবেন। পরে এই সুযোগ-সুবিধার উৎসববলয়ে উপসচিবদেরও নিয়ে আসা হয়। (তবে করোনাকালে উপসচিবদের বেলায় তিন বছর চাকরির পর গাড়ি দেওয়ার বিধান করা হয়েছে)।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখন আর কেউ সরকারি গাড়ির আশায় বসে থাকেন না; গাড়ি পাওয়ার যোগ্য প্রায় সব আমলাই সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনে ফেলেন। আর সেই গাড়ি তিনি নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনমতো স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারেন, যেটা সরকার থেকে দেওয়া গাড়ির ক্ষেত্রে পারতেন না। এতে করে একজন উপসচিবের মাসিক বেতনভাতা দাঁড়ায় সর্বনিম্ন ১ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এভাবে একজন সচিবের পিছে সরকারকে প্রতি মাসে গুনতে হয় প্রায় ২ লাখ টাকা; আর সিনিয়র সচিবের পিছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। 

কিন্তু এত সব সুবিধা পাওয়ার পরও ছলে বলে কৌশলে তারা একেকজন দুই, তিন, এমনকি চারটি করে সরকারি গাড়ি ‘বাগিয়ে’ নিয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশিরভাগ আমলাই কেনা গাড়িটা তুলে রাখেন বা মাঝেমধ্যে পরিবারের সদস্যদের চড়তে দেন; আর নিজের জন্য অন্য সরকারি সংস্থার গাড়ি জোগাড় করে চড়তে থাকেন। শুধু গাড়িই না, সেই গাড়িতে চড়ার যত খরচ- ড্রাইভার, জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণ, সেসবের টাকাও হজম করে নেন। মাঝখান থেকে সুদমুক্ত ঋণে কেনা গাড়ি বাবদ সরকার থেকে প্রতি মাসে পাওয়া বাড়তি ৫০ হাজার টাকা তার ‘লাভের ওপর লাভ’। 

এই প্রতিবেদনে শুধু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিষ্ঠান- পরিকল্পনা কমিশনের আমলাদের সরকারি গাড়ি নিয়ে ‘লোভ ও লাভ’-এর অনুসন্ধান তুলে ধরা হলো এবং এটা করতে গিয়ে জানা গেল, প্রায় সবগুলো মন্ত্রণালয়েই একই অবস্থা চলছে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সড়ক পরিবহন উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) নিখিল কুমার দাস সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন এবং সেটা বাবদ মাসে ৫০ হাজার টাকা করেও বাড়তি পাচ্ছেন। তবে সেই গাড়িতে তিনি চড়েন না। সেটা বউ-বাচ্চার জন্য বাসায় রেখে দিয়েছেন আর তিনি চড়ে বেড়াচ্ছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-২৯২৪ নম্বরের মিটসুবিসি ফোরডোর পিকআপ গাড়ি। সেই গাড়ির ড্রাইভার, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও আবার বহন করে সওজ অধিদপ্তর।

গত ৮ ডিসেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে তার ভবনের পাশেই সেই গাড়িতে পাওয়া গেল ড্রাইভার ফিরোজকে। জিজ্ঞেস করলে ফিরোজ বলেন, তিনি চাকরি করেন সওজ অধিদপ্তরে, বেতন পান সেখান থেকেই। তবে গাড়ি চালান পরিকল্পনা কমিশনের যুগ্ম সচিব নিখিল কুমার দাসের। এখানে তিনি চার বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন। চালক ফিরোজ আরও জানান, যে কর্মকর্তাই ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সড়ক পরিবহন উইংয়ের যুগ্ম প্রধান হন, তিনিই এই গাড়ি ব্যবহার করেন।

১৯ ডিসেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে নিখিল কুমার দাসের অফিসে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই গাড়ি আগে থেকেই এই দপ্তরে রয়েছে। আমার আগে যে কর্মকর্তা এখানে ছিলেন তিনিও এই গাড়ি ব্যবহার করতেন।’ তিনি নিজে এই গাড়ি সওজ থেকে চেয়ে নেননি বলে দাবি করেন।

‘সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেও তিনি কেন অন্য প্রতিষ্ঠানের গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহার করছেন’ প্রশ্ন করলে নিখিল কুমার বলেন, ‘কোনো বাবা কি পারে নিজে গাড়ি চড়বেন আর তার ছেলেমেয়ে হেঁটে স্কুলে যাবে? আর যেহেতু আমি এখানে একটা গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছি, তাই কেনা গাড়িটা বাসায় বউ-বাচ্চার জন্য রেখে দিয়েছি।’

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব মো. সাইদুজ্জামানও সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কিনে সেটি পরিবারের সদস্যদের জন্য বাসায় রেখে দিয়েছেন আর অফিসের কাজে ব্যবহার করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের (ঢাকা মেট্রো- ঘ ১৩-৯০০২) নম্বরের মিটসুবিসি ফোরডোর পিকআপ। ৯ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের অফিস চত্বরে ওই গাড়ির ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই গাড়ি কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান সাইদুজ্জামান স্যার ব্যবহার করেন।’ 

অতিরিক্ত সচিব মো. সাইদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ৯ জানুয়ারি তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা অফিস ব্যবহার করে।’ ‘আপনি ব্যবহার করেন কি না,’ প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘মিটিংয়ে গেলে মাঝেমধ্যে ব্যবহার করি। স্থানীয় সরকার বিভাগ এই গাড়ি দিয়ে রেখেছে মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য। আমিও ব্যবহার করি, মাঝেমধ্যে অন্যরাও ব্যবহার করে এই আর কী!’

পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের বিদ্যুৎ উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) মোল্লা মোহাম্মদ আনিসুজ্জামানের ঘটনাও একই। সরকার থেকে বিনা সুদে নেওয়া ঋণে কেনা গাড়ি ও তার জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকতেও তিনি সেই গাড়ি পরিবারের জন্য রেখে নিজে চড়ে বেড়ান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) দেওয়া টয়োটা এসইউভি ঢাকা মেট্রো ঘ- ১৮-৩৪১০ গাড়িটি।

‘কেন?’ প্রশ্ন করা হলে আনিসুজ্জামান অবলীলায় স্বীকার করে বলেন, ‘এই গাড়ি আগে থেকেই এখানে আছে; আমি এসে ব্যবহার করছি। আমার আগে যিনি এখানে ছিলেন, তিনিও এই গাড়ি ব্যবহার করেছেন।’

অথচ সরকারি গাড়ি ব্যবহারবিষয়ক নীতিমালায় বলা আছে, “প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা, ২০২০ (সংশোধিত)’ অনুযায়ী, সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে কমপক্ষে তিন বছর অতিক্রম করেছেন এমন কর্মকর্তা, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব/সিনিয়র সচিবকে নীতিমালার আওতায় গাড়ি কেনার জন্য সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হয়। আর গাড়ির জ্বালানি তেল, ড্রাইভারের বেতনসহ রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ প্রতি মাসে আরও দেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা।” নীতিমালায় আরও বলা আছে, “শতভাগ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অধীন দপ্তর/সংস্থা/উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন ব্যবহার করা যাবে না। প্রেষণ/মাঠ প্রশাসন/প্রকল্পে কর্মরত কোনো কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক সরকারি যানবাহন ব্যবহারের সুবিধা থাকলে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ নির্ধারিত অর্থের ৫০ শতাংশ পাবেন। কর্মস্থলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অধীন দপ্তর/সংস্থা/উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন ব্যবহার করা ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হবে।”

‘কার নীতিমালা কে মানে’- এমন অবস্থা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরেই। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব ইসরাত জাহান তাসলীমও বিধি ভঙ্গ করে ব্যবহার করেন এলজিইডির ঢাকা মেট্রো ঘ ১৫-৬৩৩১ রেক্সটনের জিপ গাড়ি। 

বিনা সুদের ঋণে কেনা গাড়ি থাকলেও প্রাধিকারবহির্ভূত গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসরাত জাহান তাসলীম বলেন, ‘এতে কী বলার আছে! সবই তো জানেন।’ 

একই বিভাগের রেল উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) আবু মো. মহিউদ্দিন কাদেরীও এভাবে অনিয়মের মাধ্যমে ব্যবহার করছেন রেলওয়ের একটি পাজেরো জিপ, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৪০১৪। 

জানতে চাইলে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘ওটা আমি অফিসের কাজে মাঝেমধ্যে ব্যবহার করি। যাদের গাড়ি নাই, তারাই বেশি ব্যবহার করে। তাদের প্রকল্পের কাজের জন্যই গাড়িটি রেলওয়ে দিয়েছে।’

রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহারকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘কোথায় কোন গাড়ি দেওয়া হয়েছে সেটা আমার জানা নাই। তবে গাড়ি দিলে প্রকল্পের কাজের জন্যই দেওয়া হয়েছে।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিকল্পনা কমিশনের সব বিভাগেই ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্প ও সংস্থার গাড়ি। কমিশনের পাঁচ সদস্য অবৈধভাবে ব্যবহার করেন ৬টা গাড়ি। এরা সবাই সচিব। সচিবদের বেলায় আরেকটা বাড়তি সুবিধার কথা জানালেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিবহন পুলের কমিশনার আবুল হাসনাত মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। গতকাল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘সচিবরা প্রকল্প ভিজিট করার জন্য একটা গাড়ি পান। সেটা মন্ত্রণালয়ের অর্গানোগ্রামেই থাকে। আইনেও আছে।’ তার মন্তব্য, ‘ঋণের টাকা দিয়ে গাড়ি কিনে কেউ তো আর প্রকল্প ভিজিট করবে না!’

এই কর্মকর্তার কথার সূত্র ধরে জানা গেল, উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিবদের কব্জায় দুইটি, আর সচিব-সিনিয়র সচিবদের কব্জায় কমপক্ষে তিনটা করে সরকারি গাড়ি থাকে। যেমন, পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান (সচিব) সুদমুক্ত ঋণে কেনা একটি, প্রকল্প ভিজিটের নামে আরেকটি এবং এলজিইডির আরও একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য একেএম ফজলুল হকও (সচিব) ব্যবহার করেন তিনটি গাড়ি এবং তার তৃতীয়টিও এলজিইডির। একইভাবে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সচিব মোছাম্মৎ নাসিমা বেগমের তৃতীয় গাড়িটি শিক্ষা ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের। শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য আবদুল বাকীর (সচিব) তৃতীয়টি বিদ্যুৎ বিভাগের। আর সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ কাওসার আহম্মেদ তৃতীয় ও চতুর্থ গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন ডেল্টা ও ইউএনডিপির দুটি পাজেরো জিপ। জানা গেল, এই দুটির একটিতে সচিব নিজে, অন্যটিতে পরিবারের সদস্যরা চড়েন।

শনিবার (২৯ জানুয়ারি) মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে প্রসঙ্গ তুলে জানতে চাইলে সচিব ড. মোহাম্মদ কাওসার আহম্মেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘না, না। কখনও কখনও ব্যবহার করি। আমি এখন ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমি পরে কথা বলব।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন, শুধু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ই নয়, সব মন্ত্রণালয়েই প্রশাসনের ওপর লেভেলের কর্মকর্তারা অবৈধভাবে গাড়ি-ড্রাইভার-জ্বালানি ব্যবহার করছেন। এতে প্রতিবছর সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা অপচয় হচ্ছে। 

পরিকল্পনা বিভাগের প্রশাসন শাখার একজন কর্মকর্তা জানালেন, পরিকল্পনা কমিশন ও বিভাগে ২৩০ জনের মতো প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা আছেন। এর মধ্যে উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত প্রায় ৮০ জনের মধ্যে ৫৫ জনই সরকারের দেওয়া সুবিধা সুদমুক্ত ঋণের টাকায় গাড়ি কিনেছেন। 

তবে প্রতিদিনের বাংলাদেশের অনুসন্ধান বলছে, শুধু পরিকল্পনা কমিশনেই সরকারের অন্যান্য প্রকল্প ও সংস্থার ৭০ থেকে ৮০টি গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে। এমনকি, মন্ত্রী-সচিবদের পিএস-এপিএসরাও এভাবে অন্য সংস্থার গাড়ি ব্যবহার করছেন। 

পরিকল্পনামন্ত্রীর পিএস মো. হারুন অর রশীদ ব্যবহার করেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি গাড়ি, আর এপিএস মাসুম বিল্লাহ ব্যবহার করেন এলজিইডির একটি গাড়ি। এ ছাড়া কৃষি, পানি ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের পিএস মো. রেদুয়ানুল হালিম ব্যবহার করেন এলজিইডির গাড়ি; ভৌত অবকাঠামো বিভাগের পিএস পদাধিকারী ব্যবহার করেন সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের গাড়ি। আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সচিবের পিএস মো. রাজীব আহসান ব্যবহার করেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের গাড়ি। তবে পিএসদের ব্যক্তিগত কোনো গাড়ি নেই। অফিসের কাজের পাশাপাশি ব্যাক্তিগত কাজেও তারা এই গাড়িগুলো ব্যবহার করেন।

পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন বিভাগের যুগ্ম প্রধানদের মধ্যে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের শিক্ষা উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) রাহনুমা নাহিদ ব্যবহার করেন এলজিইডির গাড়ি; স্বাস্থ্য উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) মাকসুদা হোসেন একটি গাড়ি ব্যবহার করেন, এনইসি ও একনেক সমন্বয় উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) মো. ইউনুস মিয়া একটি প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করেন। কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের পল্লী প্রতিষ্ঠান ও সমন্বয় উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) ড. অঞ্জন কুমার দেব রায় ব্যবহার করেন এলজিইডির একটি গাড়ি। পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের কৃষি, শিল্প ও সমন্বয় উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) নুসরাত নোমান, আর্থসামাজিক উইংয়ের ড. নুরুন নাহার, পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট রিফর্ম উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ আনোয়ার উদ্দিন ও ভৌত উইংয়ের উপপ্রধান (উপসচিব) রুহুল আযম একটি করে প্রাধিকারবহির্ভূত গাড়ি ব্যবহার করেন।

এ ছাড়া ভৌত অবকাঠামো বিভাগের পরিবহন ও সমন্বয় উইংয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) ইয়াসমিন পারভিন, সড়ক পরিবহন উইংয়ের উপপ্রধান আ. ন. ম ফয়জুল হক, ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ উইং-১-এর যুগ্ম প্রধান মো. রফিকুল আলম, ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ উইং-২-এর যুগ্ম প্রধান মো. উবায়দুল হক, যোগাযোগ উইংয়ের যুগ্ম প্রধান কবির আহামদ অন্যান্য সংস্থার একটি করে গাড়ি ব্যবহার করেন, যদিও তাদের একটি করে সরকারের ঋণে কেনা গাড়ি আছে এবং সেটার পরিচালনা বাবদ ৫০ হাজার টাকা করে পান। এ ছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগেও (আইএমইডি) এ রকম ২০টির বেশি অবৈধ গাড়ি ব্যবহার হয় বলে জানা গেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের গাড়ি দেওয়ার বিষয়ে জানতে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মোহসিনের সঙ্গে ১৯ জানুয়ারি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অফিসে গিয়ে দেখা করার কথা বলে লাইন কেটে দেন।

এ বিষয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিবভগের প্রধান প্রকোশলী মো. ইসহাকের সঙ্গে ১৯ জানুয়ারি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। সব বিষয় মাথায় নেই। আপনি অফিসে এলে দেখে বলতে পারব। যদি এমন হয়ে থাকে, তবে বিষয়টি দেখব।’

আবার অনুসন্ধানে এমন কিছু ভালো কর্মকর্তাও পাওয়া গেছে, যারা শুদ্ধাচার মেনে চলেন; প্রাধিকারবহির্ভূত গাড়ি পাওয়ার পরও ব্যবহার করেন না; অনেকে ফেরতও দিয়েছেন। নিজের গাড়ি পরিবারের কোনো জরুরি প্রয়োজন হলে তারা অফিসের কাজে রিকশা বা ভাড়া করা গাড়িতে যাতায়াত করেন।

এ রকম একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্ত প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রকল্প বা সংস্থার গাড়ি ব্যবহার করলে সেই সংস্থার প্রকল্পে প্রশ্ন তোলা যায় না। তাদের যেকোনো অবৈধ বা অপ্রয়োজনীয় আবদার মেনে নিতে হয়। প্রকল্পের ভুল ধরা যায় না। শুদ্ধাচার মেনে প্রাধিকারবহির্ভূত কিছু ব্যবহার না করলে প্রকল্পের অনিয়ম ধরা যায়; সরকারের শতশত কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়।

যানবাহন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের জন্য গাড়ির জ্বালানির পেছনে বরাদ্দ রয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রাধিকার পাওয়া প্রায় তিন হাজার উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সিনিয়র সচিবের গাড়ির পেছনে মেরামত, চালক ও জ্বালানি বাবদ বছরে খরচ হয় প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। তবে অকটেন ও ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে এই ব্যয় আরও বেড়ে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

গত ২৬ ডিসেম্বর পরিকল্পনা বিভাগের প্রটোকল শাখা থেকে উপসচিব ও এর ওপরের কর্মকর্তাদের প্রাধিকারপ্রাপ্ত গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি ব্যবহার না করা মর্মে প্রত্যয়নপত্র মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিতে বলা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, এ চিঠি দিতে গেলে অনেকেই নিতে চাচ্ছেন না বা ফেলে রাখছেন। মনে হয় না, এই নির্দেশনা কোনো কর্মকর্তা মানবেন।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা বিভাগের প্রশাসন শাখার কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব শেফালি বেগমকে জিজ্ঞেস করলে ৯ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাক্রমে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের ‘প্রাধিকারবহির্ভূত গাড়ি ব্যবহার করেন না’ মর্মে আগামী এপ্রিলের ২ তারিখের মধ্যে প্রত্যয়নপত্র দিতে বলা হয়েছে। কেউ যদি প্রত্যয়নপত্র না দেন এবং প্রাধিকারবহির্ভূত গাড়ি ব্যবহার করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

‘কিন্তু অনেকেই সেটা করছে’ জানালে শেফালী বেগম বলেন, কেউ চাইলে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে অতিরিক্ত গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। কয়েকজন কর্মকর্তা সেটা করেন বলেও তিনি জানান। তবে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের বাইরের গাড়ি ব্যবহারের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

তবে, সুদমুক্তি ঋণের টাকায় গাড়ি কেনার পরও বিভিন্ন প্রকল্প বা সংস্থা থেকে গাড়ি নিয়ে আমলাদের ব্যবহারের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ১২ ডিসেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রকল্প বা সংস্থা থেকে কর্মকর্তাদের গাড়ি নিয়ে ব্যবহারের বিষয়টি অনেক পুরোনো। এটা তাদের জন্য একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। সহজেই এ নিয়ম ভাঙা কঠিন হবে। তবে এগুলো কমছে। আশা করি, একটা সময় এগুলো আর থাকবে না।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা