× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ইমাম গ্রুপের হাজার কোটির ঋণ, জানে না হেড অফিস

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৫২ পিএম

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লায় ফাহিম ম্যানশনের পাঁচতলায় ইমাম গ্রুপের হেড অফিস। দেখে বোঝার উপায় নেই সেটি আদৌ অফিস কি না। লিফট থেকে নামতেই চোখে পড়ে ছোট্ট একটি অভ্যর্থনা কক্ষ। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে সাত-আটজন কর্মীর দেখা পাওয়া গেল। অল্প জায়গায় কাচ দিয়ে বিভক্ত তিনটি কক্ষ। এত ছোট অফিস আসলেই ইমাম গ্রুপের কি না, জানতে চাইলে কর্মীদের একজন উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, এটাই।’ তবে প্রতিষ্ঠানটির হাজার কোটি টাকার ঋণের বিষয়ে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীই কিছু জানেন না বলে জানান।

কর্মচারীদের একজনের নাম রুহুল আমিন সিদ্দিক। তার দরজার সামনে লেখা পরিচালক (অ্যাডমিন)। তিনি বলেন, ব্যাংকঋণ নিয়ে আমরা কিছু জানি না। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অফিসে কেউ নেই। তাদের এমডি-চেয়ারম্যানের খোঁজও তারা জানেন না। অন্য কোনো অফিস আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাই আমাদের হেড অফিস। এটা ছাড়া অন্য কোনো হেড অফিস নেই।

একসময় ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এনসিসি) পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ আলী। এই পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজেই ঋণ সুবিধা নিতেন তিনি। পরে ব্যাংকে তার শেয়ারের পরিমাণ ২ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়া এবং বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ায় এনসিসির পর্ষদ থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়। নব্বইয়ের দশকে অবৈধ পথে পণ্য আমদানি করে ব্যবসার জন্য চট্টগ্রামে তিনি ‘ব্ল্যাকার’ মোহাম্মদ আলী নামে পরিচিতি পান। এর আগে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ-টেরিবাজার এলাকায় বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন তিনি।

নব্বইয়ের দশকে খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের বাজারের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করত ইমাম ট্রেডার্স। পরে গ্রুপের ব্যবসা সম্প্রসারণ হয় গার্মেন্টস, যন্ত্রপাতি আমদানিসহ নানা খাতে। এসব খাতে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বেশিরভাগ খরচ হয়েছে জমি কেনায়। ২০১০ সালের পর থেকে ভোগ্যপণ্য ও ভূমি ব্যবসায় লোকসান শুরু হলে প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ ঋণ আটকে যায়।

২০১২ সালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে ইমাম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী-সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করে আইএফআইসি ব্যাংক। ব্যাংকটিতে ৬১ কোটি টাকার ঋণখেলাপি তারা। গত বছরের ২৫ জানুয়ারি তাদের পাসপোর্ট জমা দেওয়া ও অনুমতি ছাড়া দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন অর্থঋণ আদালত। এর আগেই মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী বিদেশে পালিয়ে যান। কিন্তু দেশে রয়ে যান তাদের ছেলে আলী ইমাম। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি বিদেশে যেতে পারেননি। ওই বছরের জানুয়ারিতেই অর্থঋণ আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন আলী ইমাম। গত ৪ আগস্ট বিচারপতি জেবিএম হাসান ও রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ রিট বাতিল করে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের রায় বহাল রাখেন।

ইমাম গ্রুপের কাছে সবচেয়ে বড় অঙ্কের টাকা আটকে আছে ন্যাশনাল ব্যাংকের। গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মাস্টার ট্রেডিংয়ের কাছে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখার পাওনা প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা। ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ন্যাশনাল ব্যাংক ২০১২ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। আদালত ব্যাংকের পক্ষে রায় দেওয়ার পর এখন চলছে টাকা উদ্ধারে জারি মামলা (এক্সিকিউশন কেইস)। এই মামলার বিরুদ্ধে উচ্চআদালতে রিট করে স্থিতাবস্থা নিয়ে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গ্রুপটি আস্তে আস্তে টাকা ফেরত দিচ্ছে। তবে সেটা কোর্টের মাধ্যমে।’ তাদের ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামানাত আছে। না থাকলে ব্যাংক ফাইন্যান্স করে নাকি? এসব বিষয়ে বেশি কথা বলা যাবে না। আপনি চাইলে কোর্টে যেতে পারেন।’

ইমাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইমাম ট্রেডার্সের কাছে সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার পাওনা প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। ২০১০ সালে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য নেওয়া ঋণের টাকা উদ্ধার হয়নি এক দশকেও। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার শুনানি এখনও চলছে। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির কোনো জামানত না থাকা এবং দীর্ঘ আট বছরেও মামলায় রায় না হওয়ায় ঋণের টাকা উদ্ধার নিয়ে শঙ্কায় আছে ব্যাংকটি।

গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আনিকা এন্টারপ্রাইজের কাছে ১৩৭ কোটি পাওনা কৃষি ব্যাংকের। কৃষি প্রকল্পে বিনিয়োগের নামে এই ঋণ নেওয়া হয়েছিল। পাওনা আদায়ে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে কৃষি ব্যাংক। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন। ইমাম গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠান মেসার্স রোমানা এন্টারপ্রাইজের কাছে ব্যাংক এশিয়ার পাওনা ৩৪ কোটি টাকা। এই ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেই ব্যাংকের কাছে। ২০০৪-০৫ সালের বিভিন্ন সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য নেওয়া ঋণ ফেরত দেওয়া হয়নি গত দেড় দশকেও।

ব্যাংকের দায়ের করা দুটি চেক ডিজঅনার মামলায় গত বছরের ১ ডিসেম্বর আদালত এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ইমাম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলীকে। তার বিরুদ্ধে ২০১২ সালে অর্থঋণ আদালতে করা মামলাটির বিচারকাজ উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে। ইমাম গ্রুপের কাছে উত্তরা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ৬১ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এই ঋণ নেওয়া হয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যপর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া দুটি চেক ডিজঅনার মামলার রায় ঘোষণার অপেক্ষায় আছে।

এসব ব্যাংক ছাড়াও ইমাম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এক্সিম ব্যাংকের ৬৫ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৬১ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ৪৭ কোটি, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ১৯ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংকের ১০ কোটি টাকা, ন্যাশনাল হাউজিংয়ের ৮ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ৭ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪ কোটি টাকা, ইউসিবিএলের ২ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের দেড় কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। পরিমাণ জানা না গেলেও ইমাম গ্রুপের কাছে বিআইএফসি, ফাস্ট লিজিংয়ের বড় অঙ্কের ঋণ বকেয়া আছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি এক্সিম ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ও ইউসিবিএলের ঋণ পরিশোধের জন্য সোলেনামা (ঋণ পরিশোধে ব্যাপারে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা বা আপসনামা) করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

একসময় ইমাম গ্রুপ ২০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবসা করলেও ২০২০ সাল পর্যন্ত শুধু ইমাম বাটনের কারখানাটি স্বল্প পরিসরে চালু ছিল। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে। এ কারণে ২০১১ সাল থেকে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ২০২০ সালের এপ্রিলে সেই কোম্পানিটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও দাম বাড়ছে শেয়ারের। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১১৫ টাকায় কেনাবেচা হয়েছে ইমামবাটনের একেকটি শেয়ার।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা