× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিশ্ব বন দিবস

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষত ফুটে উঠছে সুন্দরবনে

আমিনুল ইসলাম মিঠু, সুন্দরবন থেকে ফিরে

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৩ ০৮:৩০ এএম

কয়েক দশক আগেও এখানে ছিল ঘন বন। সুন্দরী গাছে ছাওয়া ছিল কটকা অভয়ারণ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জলভূমি এখন ভরে গেছে বালুতে, মরে যাচ্ছে গছপালা। প্রবা ফটো

কয়েক দশক আগেও এখানে ছিল ঘন বন। সুন্দরী গাছে ছাওয়া ছিল কটকা অভয়ারণ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জলভূমি এখন ভরে গেছে বালুতে, মরে যাচ্ছে গছপালা। প্রবা ফটো

কটকা অভয়ারণ্য। বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে অবস্থিত এই বনটি বাংলার বাঘদের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র। যার কারণে এখানকার একটি উঁচু টিলার নামকরণ করা হয়েছে টাইগার টিলা।

কথিত আছে, ব্রিটিশরা এই বনসংলগ্ন সৈকত এলাকায় লবণ চাষ করতেন। কিন্তু সে সময় প্রায়ই বাঘের মুখে পড়তেন শ্রমিকরা। তাই পুরস্কার ঘোষণা দিয়ে বাঘ শিকার করা হতো। অনেক সময় শিকারি এনেও হত্যা করা হতো বাঘ। কয়েক দশক আগেও এই বন ছিল জঙ্গলে ঘেরা। সুন্দরী গাছে ভরপুর ছিল কটকা অভয়ারণ্য।

কিন্তু গত ১৪ থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত সুন্দরবনের কটকা, কচিখালী, শরণখোলা, হারবাড়িয়া, করমজল ও ডিমের চরসহ বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ঘুরে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকই বেশি চোখে পড়েছে।

এলাকাগুলোতে দেখা যায়, উপড়ে পড়ে আছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও গাছপালা। বেশকিছু গাছের মূল টিকে থাকলেও নেই পাতা ও জীবন। কিছু গাছ টিকে থাকলেও মৃতপ্রায়। কটকার সমুদ্রতীরের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখা গেল, একটি ইটের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বন বিভাগের একটি সেমিপাকা বাড়ি। তীর রক্ষায় আছে বালুর বস্তা দিয়ে নির্মিত বাঁধ। হাতেগোনা কিছু হরিণ, শূকর ও বানর এদিক-ওদিকে ঘুরে খাবার খাচ্ছে। বাঘের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র টাইগার পয়েন্ট ও টাইগার টিলার আশপাশের এলাকা, জামতলা বিচ এবং কচিখালীতেও দৃশ্যমান জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত।

বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ আন্দারমানিক ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার, হারবাড়িয়া পর্যটন স্পট, শরণখোলার কটকা, করমজলের কুমির প্রজননকেন্দ্রসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকা ঘুরে দেখা গেল, বনের ভেতর কোথাও ইটের রাস্তা, কোথাও পাথরের ঢালাই করা সড়ক, বাড়ি, অফিস, মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছে বন বিভাগ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে বাঘ-হরিণসহ বন্যপ্রাণীদের অবাধ চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের জয়মনিঘোল এলাকায় দেখা গেল, সুউচ্চ সাইলো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এর আশপাশজুড়ে যে বিশাল বন ছিল তা এখন মরুভূমি। জানা গেল, বনের জমিটিতে করা হবে একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্প।

আলি নামের একজন ট্যুরগাইড বলেন, কটকার টাইগার হিলের আশপাশে আগে জোয়ারের পানি আসত না। কিন্তু এখন সমুদ্রের পানি বনের অনেক ভেতর পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। বিশেষ করে পূর্ণিমার সময় ফুলেফেঁপে ওঠা পানির উচ্চতা বেশি থাকে। এতে সাগরের পানির সঙ্গে বালি এসে বনের ভেতর জমে যাচ্ছে। ফলে সুন্দরী, গেওয়াসহ অনেক প্রজাতির গাছ ও উদ্ভিদ শুকিয়ে মারা যাচ্ছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমানে যেকোনো বড় জোয়ারের সময় বনের পুরো এলাকা ডুবে যাচ্ছে। অথচ আজ থেকে সাত বছর আগে জোয়ারের সময় বনের ১০০-২০০ মিটার ডুবত।

জলবায়ু ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলাসহ এক ডজনের বেশি বড় ধরনের দুর্যোগ সামলেছে বাঘের সবচেয়ে বড় আবাস ও বিশ্বের বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামীতেও এই বনের ওপর বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। এতে বনটির জীববৈচিত্র্যে বড় পরিবর্তন আসবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এমএ আজিজ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার কারণে সুন্দরবনের দক্ষিণ এলাকায় একটি বড় অংশে গাছপালা নেই। বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য মিষ্টিপানির প্রয়োজন। কিন্তু লবণাক্ততা বাড়ায় মিষ্টিপানির অভাব বেড়েছে। তাই সুপেয় পানির জন্য বনের ভেতর মিষ্টিপানির জলাধার করা জরুরি। যে হারে পানির তল বাড়ছে, তাতে বাঘের আবাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট এবং ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে ইউনেস্কো। ২০১৯ সালে সুন্দরবনের জন্য ১০টি হুমকি চিহ্নিত করে ইউনেস্কো। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, দূষণ, অবৈধ তৎপরতা ও পশুর নদের খননকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। 

পরিবেশবিদরা বলছেন, ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে উপকূলকে শক্তিশালী ঢাল হিসেবে রক্ষা করে আসছে সুন্দরবন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিকূল ও নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে বনের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য এখন সংকটাপন্ন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান গুলশান আরা লতিফা বলেন, আগে যেসব এলাকায় ৩০-৪০টি হরিণ দেখেছিলেন, সেখানে এখন মাত্র ৩-৪টি দেখেন। এটা খুবই উদ্বেগজনক। পাখির সংখ্যাও কমে গেছে। সুন্দরবনে এখন মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। 

সুন্দরবন বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবন দুভাবে বিভক্ত। দক্ষিণের ৫২ ভাগ এলাকা রক্ষিত বা প্রটেকটেড এরিয়া। এখানে তিনটি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য রয়েছে। বাঘের অন্যতম অবাধ বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র। আর উত্তর দিকে থাকা ৪৮ ভাগ রিজার্ভ ফরেস্ট বা সংরক্ষিত বন। তবে সুন্দরবনের বেশিরভাগ পর্যটক স্পট রয়েছে দক্ষিণ অংশে। তবে বন্যপ্রাণী ও বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ অংশকে পর্যটকমুক্ত রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণীবিদ এমএ আজিজ বলেন, দক্ষিণের অংশ অর্থাৎ কটকা, কচিখালী ও হিরণ পয়েন্ট রক্ষিত এলাকার ভেতরে। এখানে তিনটি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য রয়েছে। বাঘ ও হরিণের অবাধ বিচরণও আছে সেখানে। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘ ও বন্যপ্রাণীর বিষয়টি মাথায় রেখে দক্ষিণ অংশে পর্যটন ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। এতে বাঘের প্রজনন বিঘ্নিত হবে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ক বুয়েটের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বাড়বে বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি অন্যতম। গবেষকরা বলছেন, এখন প্রতিবছর বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসও হচ্ছে। আর স্রোতের পরিমাণ বেশি ও শক্তিশালী হচ্ছে। ফলে উপকূলীয় ভূমি ক্ষয় হয়ে মাটি ধুয়ে যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে গাছ। গত পাঁচ বছরে ২৭টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। 

জানতে চাইলে বুয়েটের জলবায়ুবিদ একেএম সাইফুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, জোয়ারের পানি বনে প্রবেশ করায় মাটি সরে যাচ্ছে। ফলে ঝড়ে যেসব গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেগুলো পুনরুজ্জীবিত হতে পারছে না।

বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে কোনো প্রভাব আছে কি না তা নির্ণয়ে আমরা উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি। এজন্য সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় আলাদা কোনো প্রকল্প নেই। কারণ এটি একটি প্রাকৃতিক বন এবং উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি সেরে ওঠে। এজন্য ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।’

আজ ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস। বন রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘বন ও স্বাস্থ্য’। দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশে বন ভবনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা