রংপুর অফিস
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩ ১২:১১ পিএম
অভাবের তাড়নায় স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে আলু উত্তোলনের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। প্রবা ফটো
‘খ্যায়া না বাঁচবার পাইলে পড়িম কেমন করি। সেজন্তে বাড়ির সবার সাতে আলু বাড়িত কাম করি। আলুর কাম করি যা পাই তা দিয়া বাড়িত খরচ করে। সেজন্তে অ্যালা স্কুলোত যাইতোছি না।’ কথাগুলো বলছিল রংপুর নগরীর বড়দরগা এলাকার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী পারভীন আক্তার। অভাবের তাড়নায় স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে আলু উত্তোলনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে সে।
পারভীনের মতো নগরীর তামপাট এলাকায় আলুক্ষেতে কাজ করছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মুশফিক। বাবা আজাদ হোসেন মুদি দোকানের কর্মচারী। বাবার উপার্জনে চারজনের সংসার না চলায় আলু উত্তোলন মৌসুমে তা তোলার কাজ করে মুশফিক। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্ষেত থেকে আলু তোলা, সারি করে আলু স্তূপ করা ও কৃষকের ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রলিতে তুলে দেওয়ার কাজ করতে হয় তাকে। এরপর সন্ধ্যায় পারিশ্রমিক হিসেবে ২০০ টাকা নিয়ে ঘরে ফিরে মায়ের হাতে তুলে দেয় সে।
মুশফিকের মতো মোর্শেদ, জাহিদুল, রফিকসহ অনেক শিশু-কিশোর এ মৌসুমে আলুক্ষেতে কাজ করে। কম পারিশ্রমিকে দ্রুততার সঙ্গে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া যায় বলে আলু উত্তোলনে তাদের বেশি কাজে নেন কৃষকরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, আলুক্ষেতে মৌসুমি শ্রমিক হয়ে শিশু-কিশোররা কাজ করায় স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রায় এক মাস ধরে স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীরা নিয়মিত যাচ্ছে না। শিক্ষকরাও স্বল্প শিক্ষার্থী নিয়ে কোনোরকম পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন। আলু উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত বেশিরভাগই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। তারা পরিবারকে সহযোগিতার পাশাপাশি আলু তোলার কাজ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে খাতা-কলম, প্রাইভেটের খরচ মেটাচ্ছে।
নগরীর টেপাটারী এলাকায় দেখা যায়, ক্ষেতে চলছে আলু উত্তোলনের কাজ। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র লিমন, মমিনুরসহ সাত স্কুলছাত্র আলুক্ষেতে কাজ করছে। লাঙ্গল দিয়ে আলুর কান্দি দুই ভাগ করে দিচ্ছেন কৃষক আর স্কুলছাত্ররা হাত দিয়ে মাটি সরিয়ে বের করছে আলু। মাটি খুঁড়ে আলু বের করা, একটি জায়গায় স্তূপ করা এবং পরিবহনের ট্রলিতে উঠিয়ে দেওয়ার কাজ করছে তারা।
একই চিত্র দেখা যায় পীরগাছার হাউদারপাড় এলাকায়। আলুক্ষেতে কাজ করা নয়জনই স্কুলের ছাত্র। যে সময় বিদ্যালয়ে পাঠ নেওয়ার কথা ছিল, সে সময় প্রখর রোদে আলু তুলে যাচ্ছে তারা।
অন্যদিকে পীরগাছার রফিকুল ইসলাম বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, এ বিদ্যালয়ের তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত মাত্র ১১ জন। স্কুলে ওই ১১ শিক্ষার্থীকেই পাঠদান করাচ্ছিলেন শিক্ষকরা। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি না থাকায় যেন সুনসান নীরবতা স্কুলে। আলু উত্তোলন মৌসুমে কুটিপাড়া আলিমুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ৪০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রতিদিন উপস্থিত হচ্ছে ২০০ জন, চণ্ডীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ৬০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত হচ্ছে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০। একই অবস্থা জেলার ৮ উপজেলার শহর কিংবা গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর।
আলু উত্তোলনের কাজ করা বড়দরগা এলাকার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সাইফুল ইসলাম বলে, ‘সংসারের অভাব মেটাতে গত বছর ক্ষেত থেকে আলু তোলার কাজ করে মায়ের হাতে এক হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলাম। এ বছর জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এ নিয়ে বাবা-মাকে সহযোগিতা করতে আলু তোলার মৌসুমের শুরু থেকে কাজ করছি যেন কিছু টাকা আয় করে দিলে তাদের সহযোগিতা হয়। প্রায় সব ছাত্র-ছাত্রী আলু তোলার জন্য স্কুলে যাচ্ছে না। তাই স্কুল চালু থাকলেও ঠিকমতো ক্লাস হয় না।’
নগরীর বাহার কাছনার সপ্তম শ্রেণির ছাত্র লিমন মিয়া বলে, ‘মা রোজায় আলু তোলার কাজের টাকা খরচ করতে পারবে। সেজন্য স্কুলে না গিয়ে আলু তুলছি। একেবারে ঈদের পর স্কুল যাব।’
পীরগাছার রফিকুল ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রতন সাহা বলেন, ‘আলু তোলার মৌসুমে কোনোরকম অনুমতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। তাই শিক্ষার্থীর অভাবে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান হচ্ছে না। এতে আমাদের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে পড়ছে।’
চণ্ডীপুর মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পীরগাছা স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সভাপতি সামসুল আলম বলেন, ‘রংপুর অঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা নেই। ফলে বিভিন্ন ফসল রোপণ ও কর্তন মৌসুমে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসা বন্ধ করে ক্ষেতে কাজ করে। ওই কাজের অর্থ দিয়ে তারা খাতা-কলম, প্রাইভেটের বেতনসহ অন্য খাতে খরচ করে এবং পরিবারকে সহযোগিতা করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে আমরা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছি। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এমন পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকে না।’
পীরগাছা উপজেলা মাধ্যমিক সুপারভাইজর শামসুজ্জামান ডাকুয়া বলেন, ‘প্রতি বছর এ সময় বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী সংকট থাকে। এতে তাদের লেখাপড়ার কিছুটা ঘাটতি হয়। আলু উত্তোলন মৌসুম শেষদিকে হওয়ায় আগামী সপ্তাহ থেকে বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার স্বাভাবিক হবে।’