বিশ্ব মশা দিবস আজ
ফয়সাল খান
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩ ০৮:৪৪ এএম
প্রতীকী ছবি
ছোট কীট মশার কামড়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় যেন মশার কামড়ের ভয়। জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে ৪৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ১৩ জন মারা গেছে। চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনে মৃত্যু হয়েছে ২১৫ জনের। চলতি মাসে ডেঙ্গুতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১২ জন করে মানুষ মারা যাচ্ছে।
মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতির মধ্যে আজ ২০ আগস্ট পালিত হচ্ছে বিশ্ব মশা দিবস। ১৮৯৭ সালের এই দিনে মশার সঙ্গে ম্যালেরিয়া রোগের সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়। আবিষ্কারক ছিলেন বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস। এরপর ১৯৩০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী মশাবাহিত রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে এ দিনে মশা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
গবেষকরা জানান, মশার কামড়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রতিবছর ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বে প্রতিবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ৩৯০ মিলিয়ন মানুষ। এ ছাড়াও মশার কামড়ে ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৬০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ মারা যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। তবে দেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকাতেই ১৪ প্রজাতির মশা রয়েছে। মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হলোÑ ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস। তবে মশাবাহিত অন্যান্য রোগের তুলনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর হিসাব রাখা হয়।
দেশে বছরের বড় একটি সময় ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ মানুষকে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। ক্ষুদ্র এই পতঙ্গ প্রজাতির মধ্যে এডিস মশার যন্ত্রণা এবার সবচেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ৫ হাজার ৫৫১ জন এবং মারা যায় ৯৩ জন। ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে সে বছর হাসপাতালে ভর্তি হয় ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ এবং ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়। গত বছর ৬২ হাজার ৩৮২ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, মারা যায় ২৮১ জন।
দেশে ২০০৮ সালে প্রথম ডেঙ্গুর মতো একটি রোগ চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। এ রোগটি চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর দেশে চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত হয়। ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয় ২০১৬ ও ২০১৭ সালে।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ছাড়াও ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবও রয়েছে। অ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এর মধ্যে চারটি প্রজাতিকে প্রধান বাহক বলা হয়। পার্বত্য জেলা এবং সীমান্তবর্তী এলাকার মোট ১৩ জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ) ডা. ইকরামুল হক বলেন, দেশে ২০০০ সালের পর সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ২০০৮ সালে। ওই বছর ৮৪ হাজার ৬৯০ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ১৫৪ জন মারা যায়। গত বছর শনাক্ত হয় ১৮ হাজার ১৯৫ জন এবং ১৪ জন মারা যায়। সবশেষ চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৫ হাজার ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তা ছাড়া মশাবাহিত আরেক রোগ ফাইলেরিয়া আক্রান্ত মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। একসময় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল। সরকারের ফাইলেরিয়া এলিমিনেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটিকে নির্মূল ঘোষণা করা হয়েছে। জাপানিজ এনসেফালাইটিস নামক মশাবাহিত একটি রোগ হয়ে থাকে। এ রোগটি কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ছড়ায়; যা দেশে শনাক্ত হয় ১৯৭৭ সালে মধুপুর বন থেকে। এরপর বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে এই রোগ পাওয়া যায়।
এদিকে ডেঙ্গু মহামারি রূপ নিয়েছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সঠিক হিসাব আসছে না। তবে সরকারি হিসাবে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৯৮৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৯৭ হাজার ৮৬০ জনে। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৪৭ হাজার ৬৭১ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছে ৫০ হাজার ১৮৯ জন।
বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মশক নিধনে নীতিনির্ধারকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তারা অবৈজ্ঞানিক পন্থায় হাঁটছেন। এতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন ১০ থেকে ২০টি জীবন ঝরছে।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা কতটা সফল তা বোঝা যায় মশাবাহিত রোগ কতটা হচ্ছে তা দেখে। দেশে এখনও মশাবাহিত রোগীর সংখ্যা বেশি। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতার বিষয়ে কোনো মূল্যায়ন কমিটি নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সব দপ্তর পরিবেশ, প্রাণী, রাসায়নিক ও জনসম্পৃক্ততাÑ এই চার উপাদানকে সঠিকভাবে বছরব্যাপী কাজে লাগাতে পারলে মশা নিধন সম্ভব। কোন উপাদান কোন মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে বিশেষজ্ঞরা সেটি বলে দেবেন।