এম আর মাসফি
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৩ ১২:১৩ পিএম
আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:৫৫ পিএম
কোথাও ১০০ কোটি, কোথাও ২০০ কোটি, এমনকি ৫০০ কোটি টাকাও ছাড়িয়ে গেছে প্রতি কিলোমিটার সড়কের নির্মাণ ব্যয়! এমন অস্বাভাবিক দামি সড়ক নির্মাণের ‘প্রতিযোগিতায়’ নেমেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। সম্প্রতি তারা পরিকল্পনা কমিশনের কাছে সড়ক নির্মাণের বেশ কয়েকটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে, যেগুলোতে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে যে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে তা আঁতকে ওঠার মতো। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারাও প্রস্তাব দেখে অবাক বনে গেছেন।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ফোর লেন
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ২৩ দশমিক ৫২ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার জন্য ১২ হাজার ১৩৬ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে সওজ। এতে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের সার্বিক খরচ ধরা হয়েছে ৫২৬
কোটি টাকা। প্রস্তাব অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণ, সড়কে সেতু নির্মাণ ও অন্যান্য কাজের খরচ বাদ দিয়ে শুধু সড়ক নির্মাণের ব্যয় দাঁড়ায় ২৫৬ কোটি টাকা- যা এই ধরনের চলমান অন্যান্য প্রকল্পের বরাদ্দের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। উল্লিখিত প্রস্তাবে ব্যয়ের বহর দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। তারা এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পটিতে ৮ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেবে জাপান। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, জাইকা তাদের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সড়ক বানাবে, সে কারণেই খরচ এত বেশি; যাতে কেউ তাদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে।
পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এ প্রকল্পের বিষয়ে এরই মধ্যে জাপানের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়ে গেছে। যেখানে আমরা সব খরচসহ ১০০ কোটি বা তারও কমে চার লেনের সড়ক বানাচ্ছি, সেখানে কেন প্রতি কিলোমিটারে ৫২৬ কোটি টাকা খরচ করব? যেই মানেরই হোক- এত ব্যয়ের সড়ক তো আমাদের মতো দেশের জন্য নয়। আগে জানা গেলে এই প্রকল্পের খরচ ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা কমানো যেত। তবুও সর্বশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় বিভিন্ন খাতে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে। দেখা যাক জাইকা এই রেটে কাজ করে কি না।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের (সদস্য) সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ান এ বিষয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সম্প্রতি প্রকল্পটির পিইসি সভা হয়েছে। আমরা সেখানে বেশকিছু খাতে বেশি ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। কয়েকটি খাতে ব্যয় কমাতে বলেছি।
চট্টগ্রাম পোর্ট সড়কে কিলোমিটারে ব্যয় ২৯৫ কোটি টাকা
চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে দ্রুত ও নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সাসেক চট্টগ্রাম পোর্ট অ্যাকসেস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে মাত্র ১১ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটার সড়কের জন্য ধরা হয়েছে ২৯৫ কোটি টাকা। সওজ অধিদপ্তরের এই প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। সংস্থাটি বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় যৌক্তিকভাবে ব্যয় নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছে।
সওজের প্রস্তাব সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দেবে ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৩২ কোটি টাকা দেবে সরকার। জানা গেছে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অর্থ বিভাগের জনবল কমিটির সভায়ও প্রকল্পটির মোট ব্যয় দেখানো হয়েছিল ২ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর আগে হঠাৎই ১ হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের যে ব্যয় ধরা হয়েছে তার অর্ধেক হওয়া উচিত। অযথা প্রকল্পটির ব্যয় এত বাড়ানো হয়েছে। এমন কিছু খাতে বড় অঙ্কের ব্যয় ধরা হয়েছে, যেগুলো একেবারেই প্রয়োজন নেই।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, প্রকল্পটি কয়েক দিন আগেই এখানে এসেছে। প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই চলছে। এই সড়কটি নির্মাণে এত ব্যয় কেন প্রয়োজন সে বিষয়ে পিইসির সভায় জানতে চাওয়া হবে।
বনপাড়া-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ চার লেন সড়কে ১০৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে প্রতি কিমিতে
দেশের পশ্চিম এবং পূর্ব-উত্তর অংশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে ১০ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নাটোরের বনপাড়া থেকে কুষ্টিয়া হয়ে ঝিনাইদহ পর্যন্ত ৯৯ দশমিক ৪২ কিলোমিটার সড়ক চার লেন করার প্রস্তাব দিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। প্রকল্পটির প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে সব খরচসহ ব্যয় পড়ছে ১০৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে ৬ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেবে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। এ প্রকল্পেও বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। এ বিষয়ে সওজের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইসহাক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রকল্পটি ২০২৩ সালের নতুন রেট শিডিউল অনুযায়ী করার কারণে এর ব্যয় বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার ভূমির ওপরও নির্ভর করে সড়কের ব্যয়।
চলমান চার লেনের প্রকল্পগুলো ১০০ কোটির মধ্যে
সড়ক ও জনপথের চলমান চার লেনের প্রকল্পগুলোতে প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ ব্যয় ১০০ কোটির মধ্যে থাকলেও এই প্রকল্পগুলোতে এমন অস্বাভাবিক ব্যয় কেন প্রস্তাব করা হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। দেখা গেছে, মাওয়া একপ্রেসওয়ে নির্মাণেও এত টাকা লাগেনি। সেখানে শেষ পর্যন্ত প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছিল ১৮৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া চার লেন করার জন্য ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ৮৫ দশমিক ৭৯ কোটি টাকা, ঢাকা-সিলেট প্রকল্পে ৮২ কোটি টাকা ও এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর প্রকল্পে ৯৪ দশমিক ৩১ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তাই একই সংস্থার অধীনে নতুন প্রকল্পগুলোর ব্যয় এত বেশি হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতে প্রতি কিলোমিটার সড়কে ব্যয় হয় ১১ থেকে ১৩ লাখ ডলার বা ১২ কোটি থেকে ১৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে চীনে এ খাতে ব্যয় হয় ১৩ থেকে ১৬ লাখ ডলার বা ১৪ থেকে সাড়ে ১৭ কোটি টাকা। সেখানে সড়কের প্রকল্পগুলোতে এত বেশি ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। সংক্ষেপে শুধু বলেন, প্রকল্পগুলো এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে ফাইনাল হলে একনেকে অনুমোদন হবে। তখন পরিকল্পনামন্ত্রী বিস্তারিত জানাবেন।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সড়ক নির্মাণে এত ব্যয় প্রস্তাব কেন করা হলো সেটা পরিকল্পনা কমিশনকে যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আছে তাদেরও এ নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকারি কেনাকাটায় যেন কোনো অনিয়ম না হয় সে জন্য আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ‘সরকারি কেনাকাটা কর্তৃপক্ষ’ গঠন করতে হবে। যে যার অবস্থান থেকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলেই অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হবে।