প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৩ ০৯:৫৮ এএম
আপডেট : ১৬ মে ২০২৩ ১০:০৫ এএম
এখন তো খানিকটা আফসোসই হচ্ছে! শুরুর ওয়ানডেটা বৃষ্টিতে ভেসে না গেলে হয়তো সেটাও জিতত বাংলাদেশ! যা হয়নি তা নিয়ে আলোচনা থাক, বরং যা হয়েছে তা নিয়েই কথা বলা যাক। পুরো সিরিজটায় বাংলাদেশ একচেটিয়া দাপট হয়তো দেখাতে পারেনি, তবে সফলতা বের করে এনেছে ঠিকই। সাফল্যটা বেরিয়ে এলো যে রহস্যে, সেগুলো দেখে নেওয়া যাক এক নজরে…
উদ্দীপ্ত অধিনায়কত্ব
সিরিজের শেষ ম্যাচে রবিবার আয়ারল্যান্ড রীতিমতো হুমকিই হয়ে বসেছিল। বাংলাদেশ নেমেছিল ২৭৪ রানের পুঁজি নিয়ে। চেমসফোর্ডের রোদ ঝলমলে দিনে ব্যাটিং উইকেটে সেটা আইরিশরা তাড়া করেই ফেলেছিল। ইনিংসের ৪০ ওভার পর্যন্ত মনেই হয়নি ম্যাচটা স্বাগতিকরা হারতে পারে। ৭ উইকেট হাতে, ৫৪ বলে চাই ৫১ রান; এ অবস্থা থেকে কেনইবা মনে হবে তা?
আরও পড়ুন : ইংল্যান্ডে তামিমের ‘শেষ’
আয়ারল্যান্ড সে জায়গা থেকেও ম্যাচটা হারল। কারণ বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তামিম ইকবালের জিয়নকাঠিতে। ৪২ আর ৪৩তম ওভারে বোলিংয়ে দুটো পরিবর্তন আনলেন। সফলতা পেলেন দুটোতেই। প্রথমটায় যে পেলেন, সেটা তামিম ছাড়া আর কে ভেবেছিলেন? নাজমুল হোসেন শান্ত, যিনি ওয়ানডে ক্যারিয়ারে উইকেট পাননি কখনই, এর আগে দুই ম্যাচ মিলিয়ে বলই করেছেন ১৬টা; সেই শান্তকে আনবেন আক্রমণে, আর তিনিই সাফল্য এনে দেবেন; সেটা তো পাঁড় শান্তভক্তও ভাবেননি! তামিম সেই তার ওপরই ভরসা রেখেছিলেন, যার ফল এলো ব্রেক থ্রুতে।
পরের ওভারে মুস্তাফিজের ক্ষেত্রেও ঘটল তেমন কিছুই। শেষ কিছু দিনে নিজেকে হারিয়ে খোঁজা মুস্তাফিজই এনে দিলেন সাফল্য, তাও টানা তিন ওভারে। আইরিশদের আশা গুঁড়িয়ে তাতে বাংলাদেশই হাসে শেষ হাসিটা। জেতে সিরিজটাও।
শান্ত ফ্যাক্টর
নাজমুল হোসেন শান্তর কথা একটু আগেই হয়ে গেল এক দফা। দারুণ বোলিংয়ে শেষ ম্যাচে গড়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের জয়ের পথ। প্রথম ওভারে উইকেট, পরের দুই ওভারে কিপটে বোলিং, তাতেই অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন তিনি।
তবে শেষ ম্যাচে যে কারণে আলো কেড়ে নিলেন- সেটা তো তার আসল কাজ নয়! কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের অধীনে খেলছেন ব্যাটিং অর্ডারের তিন নম্বরে। ওয়ানডে ম্যাচে তিন নম্বরে ব্যাটারের ভূমিকাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ওপেনাররা ভালো করলে সেটা ধরে রাখতে হয়, খারাপ করলে গড়তে হয় ইনিংস। সদ্যসমাপ্ত সিরিজে তিন ম্যাচেই তাকে ক্রিজে আসতে হয়েছে ৫ ওভারের আগেই। দায়িত্বটা তিনি ভালোভাবেই পালন করেছেন। প্রথম ম্যাচে ৪৪, আর শেষ ম্যাচে করেছেন ৩৫। দ্বিতীয় ম্যাচে তার সেঞ্চুরিতে ভর করেই তো ৪৫ ওভারে ৩২০ রানের পাহাড় ডিঙাল বাংলাদেশ!
শান্ত ছন্দে আছেন বেশকিছু দিন ধরেই। তবে বিরুদ্ধ কন্ডিশনে তার বদলে যাওয়ার ছাপ রাখতে পারার একটা দায় থেকেই যাচ্ছিল। শান্ত আয়ারল্যান্ড সিরিজে করে দেখালেন সেটাও, হয়েছেন সিরিজ-সেরাও। তাতে ব্যাটিং অর্ডারে তিন নম্বরে দুশ্চিন্তা থেকে আপাতত মুক্তিও মিলেছে দলের। সঙ্গে গ্রাউন্ড ফিল্ডিং আর খণ্ডকালীন অফ স্পিন দিয়েও জোগাচ্ছেন দলের ভরসা।
তারুণ্যের সাহস
সিরিজ-সেরা শান্তকেও চাইলে এই ক্যাটাগরিতে ফেলে দেওয়া যায় অনায়াসেই। তবে দলে তার চেয়েও তরুণ খেলোয়াড়ের উপস্থিতি আছে এখন। সেই তরুণরাও এই সিরিজ জয়ে অবদান রেখেছেন। সেটাও আবার কম কিছু নয় মোটেও।
দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ যে কঠিন ৩২০ রান তাড়া করে জিতেছে, সেটাতে শান্তর সঙ্গে তরুণ তাওহিদ হৃদয়ের অবদানটাও বেশ। ১০০ রানের আশপাশে তিনটি উইকেট খোয়ানোর পর চাপ খানিকটা বাংলাদেশের ওপর চলে এসেছিল সেদিন, ওপাশে থাকা নাজমুল হোসেন শান্তর ওপরও! তবে সে চাপটা সরিয়ে দেয় তাওহিদের সাবলীল ব্যাটিং। সে ম্যাচে তিনি খেলেন ৫৮ বলে ৬৮ রানের ইনিংস। তার সঙ্গে শান্তর জুটি থেকে আসে ১০২ বলে ১৩১ রান। তিনি যখন বিদায় নিচ্ছেন, বাংলাদেশ তখন জয়ের খুবই কাছে। আগের ম্যাচেও তিনি এমন সাবলীলই খেলেছেন।
‘সাহস’ নিয়ে কথা হচ্ছে, আর সেখানে যদি হাসান মাহমুদকে না আনা হয়, তাহলে বোধ হয় অন্যায়ই হয়ে যায়। শেষ ম্যাচের শেষ ওভারে চাপের মুহূর্তে ব্যাক অব দ্য হ্যান্ড স্লোয়ার করলেন যেভাবে, তা তো সাহসেরই চূড়ান্ত। সঙ্গে মাথা ঠান্ডা রেখে ৯ রান ডিফেন্ড করতে পারলেন বলেই না সিরিজটা জিতেছে বাংলাদেশ!
অভিজ্ঞতার অর্জন
শুধু তারুণ্যই নয়। এই সিরিজ বাংলাদেশকে জিতিয়েছে তারুণ্যের সঙ্গে অভিজ্ঞতার মিশেলও। একবার ভাবুন, দ্বিতীয় ম্যাচে শান্ত-তাওহিদের অমন ব্যাটিংয়ের পর মুশফিক ব্যর্থ হয়েছেন, তাহলে কি জয়টা পেত বাংলাদেশ? কিংবা কল্পনা করুন শেষ ম্যাচের কথা, ওপাশে যখন সঙ্গীরা আসছেন, থিতু হচ্ছেন, ফিরে যাচ্ছেন প্যাভিলিয়নে, তখন স্রোতের বিপরীতে তামিম যদি দাঁড়িয়ে না যেতেন, ৮২ বলে ৬৯ রানের ওই ইনিংসটা না খেলতেন, তাহলে কি পুঁজিটা ২০০ও পার হতো? এসবও বাদ দিন না হয়, তামিম যে বুদ্ধির ঝিলিকে শেষে ম্যাচটা বের করে আনলেন আইরিশদের কবজা থেকে, সেটাও কি অভিজ্ঞতার গুণে নয়? কিংবা মুস্তাফিজ? ছন্দহীনতাকে তুড়িতে উড়িয়ে যেভাবে মগজাস্ত্রের ভেলকিতে বিদায় করলেন থিতু লরকান টাকার, বিপজ্জনক কারটিস ক্যামফার আর জর্জ ডকরেলকে, তাও তো এই অভিজ্ঞতার গুণেই!
এই অভিজ্ঞতা নিয়ে শেষ কিছু দিনে কথা হচ্ছে অনেক। সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তো কোনো রকম লুকোছাপা না করে বলেই দিয়েছেন বিশ্বকাপ জেতার আশার কথা, সেটা এই অভিজ্ঞতার জোরেই। কেন বলেছেন, তার একটা প্রমাণই সদ্যসমাপ্ত সিরিজে দিলেন অভিজ্ঞ সিনিয়ররা।
মুস্তাফিজের ফেরা
মুস্তাফিজ আর ফিরছেন না। নিজেকে হারিয়ে খোঁজার দিনে তাকে নিয়ে এমন কথা বাংলাদেশের আন্তর্জালে ঘোরে বেশ। মুস্তাফিজ যেন সে কথাটাকে নিয়ে ফেলেছেন টেমসের জলে, অন্তত এই সিরিজে তো বটেই।
শেষ কিছু দিন ধরেই ফর্মটা পক্ষে কথা বলছিল না। ঘরের মাঠে আয়ারল্যান্ড সিরিজে ওয়ানডেতে একটা উইকেটও তুলতে পারেননি। এরপর আইপিএল খেলতে গেছেন, সেখানে দুই ম্যাচে ৭ ওভারে হজম করেছেন ৭৯ রান। দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে সে সফর শেষ করে ৬৬৪৮ কিলোমিটার দূরে ছুটে গিয়ে সিরিজ শুরুর আগেই যোগ দিলেন বাংলাদেশ ক্যাম্পে। আইপিএলে শেষ কিছু ম্যাচে বেঞ্চেই বসে থাকতে হয়েছিল। এরপর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচেও জায়গা হয়নি একাদশে। শেষ ম্যাচে ফিরলেন একাদশে, ফিরেই নিজের সবচেয়ে ভালো রূপটা জাহির করলেন। পুরোনো দিনের মতো মাগজের ব্যবহার করলেন, ব্যাটারকে পড়ে বল ফেললেন ঠিক জায়গায়। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতল তার গুণেই তো!
ম্যাচের আগেই নাকি ভেবে রেখেছিলেন ৫ উইকেট নেবেন। এমন আত্মবিশ্বাসের ছটা তো কেবল পুরোনো মুস্তাফিজের মাঝে দেখা যেত! সেই তিনি এই সিরিজে দেখালেন সে ঝলকই!