টেস্ট সিরিজের পোস্টমর্টেম
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:৩০ এএম
তবুও মিরপুরের মতো অমন উইকেটে টেস্ট খেলাটা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে শান্তরা— প্রবা ফটো
ঢাকা টেস্ট শুরুর আগের দিন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘খুব বেশি তথ্য দিতে চাই না। নিউজিল্যান্ড হয়তো শুনতে বা পড়তে পারে।’ মিরপুরে ‘ব্যাটল অব স্পিন’ শেষে অনেকগুলো প্রশ্নের ভিড়ে বাংলাদেশের কোচের সেই শঙ্কার কথাটিও থাকছে। তবে কি টিম সাউদিরা শুনে ফেলেছেন নাজমুল হোসেন শান্তদের পরিকল্পনা? শুনেছেন হয়তো! সে কারণেই বুঝি কিউইর সব প্রতিনিধি ‘ব্লুপ্রিন্ট’ পেয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন! ‘স্পিনের’ পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার বিষয়টির চেয়েও বড় আলোচনায় আরেকটি শব্দ— ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’।
ঘরের মাঠের সুবিধা নেওয়ার পক্ষে প্রায় সব দলই কথা বলে থাকে। দর্শক, আবহাওয়া আর সঙ্গে নিজেদের মানানসই উইকেট—লড়াইয়ের আগে স্বাগতিকদের খানিকটা এগিয়েও রাখে। বাংলাদেশ সেখানে যেন ব্যতিক্রম। ঢাকা টেস্ট যেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
স্পিনবান্ধব উইকেট, হঠাৎ করেই বলের লাফিয়ে ওঠা এবং পিচের অস্বাভাবিক আচরণ ব্যাটারদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। স্পিনের স্বর্গরাজ্য নাম পেয়ে যাওয়া মিরপুরের উইকেটকে যাচ্ছেতাই বলেছেন কিউই অধিনায়ক। ঢাকা টেস্ট চলাকালে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে আসা মেহেদি হাসান মিরাজ, নাঈম হাসান এবং নাজমুল হোসেন শান্তও দিয়েছেন একই মত, ‘পিচ ব্যাটিংয়ের জন্য সহায়ক নয়।’ কিন্তু তারাই আবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছেন, ‘এমন উইকেটেই লাল বলের খেলাটি হোক।’
মিরপুরের উইকেট যে ব্যাটিংসহায়ক নয়, সেটির প্রমাণ বাংলাদেশের ব্যাটাররা। দুই ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র ফিফটিটি জাকির হাসানের। প্রতিপক্ষের অবস্থাও অনেকটা তেমন। আসা-যাওয়ার মাঝে পড়ে থাকা টেস্টে কিউইদের যেন একাই জিতিয়েছেন গ্লেন ফিলিপস।
বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে ১৭২ রানের জবাবে তার ৮৭ রানের ক্যামিওতে চড়ে লিড নেয় কিউইরা। দ্বিতীয় ইনিংসে শান্তরা দেড়শ রানের আগেই গুটিয়ে যাওয়ার পর ৪ উইকেট হাতে রেখেই পেরিয়ে যায় সফরকারীরা। বৃষ্টি বাগড়া এবং বাজে আবহাওয়ার কারণে খেলা থেমে না থাকলে পাঁচ দিনের টেস্টটি দুদিনে কিংবা বড়জোর তিন দিনে শেষ হতে পারত। দিনের হিসাব আমলে না নিয়ে স্কোরবোর্ডের হিসাবে টানলে ঢাকা টেস্ট হয়েছে মোটে ১৭৮.১ ওভার। সবকিছু বাদ দিয়ে দেখলে ঢাকা টেস্ট তো শেষ দুদিনেই!
বাংলাদেশের সুযোগ ছিল টেস্ট স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রথম এক বছরে কোনো টেস্ট না হারার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার। কিন্তু সেটি হয়নি। ৪ উইকেটে হেরে নিজেদের গর্তে নিজেরাই পড়েছে বাংলাদেশ।
সিলেটে কিউইদের হারানো ২০ উইকেটের ১৮ উইকেটই নিয়েছেন তিন স্পিনার। তাইজুল ইসলাম একাই নেন ১০টি! মিরপুরেও তাইজুল-মিরাজ-নাঈমরা ছিলেন সফল। ১৭৮.১ ওভারের খেলায় ৩৬ উইকেটের ৩১টি স্পিনারদের পকেটে। ব্যাটিং গড় ১৬.৬১, যা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত যেকোনো ম্যাচে সর্বনিম্ন।
তবুও অমন উইকেটের পক্ষে টাইগারদের অধিনায়ক। ঘরের মাঠের সুবিধা নেওয়ার দোহাই দিয়ে শান্ত বলেছেন জিততে চান তারা, ‘টেস্ট ক্রিকেটে তো ইমপ্রুভ করতে আসিনি— জিততে এসেছি। জেতার জন্য আমাদের প্রস্তুতিটা কেমন হওয়া উচিত, তা গুরুত্বপূর্ণ।’ কিন্তু সেই জয়টাই অধরা ছিল। ম্যাচের শেষে কিউই অধিনায়কের কাছেও অমন প্রশ্ন গিয়েছিল, তিনি উইকেটের মূল্যায়নে ‘সবচেয়ে বাজের তকমা’ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের অধিনায়ক মিরপুরের মতো অমন উইকেটে টেস্ট খেলাটা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে থাকলেও টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডেতে দিচ্ছেন না পাস মার্ক, ‘ঘরের মাটিতে যখন সাদা বল মানে ওয়ানডে-টি টোয়েন্টি খেলব, তখন আমাদের সব সময় ভালো উইকেটে খেলা উচিত।’
গত মাসে শেষ হওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা নিয়ে শান্ত বলেছিলেন, আমরা ২৬০ রান করতে পারি। কিন্তু অন্যদের মতো ৩২০-৩৫০ রান করতে পারি না। বাংলাদেশের হোম অব ক্রিকেট মিরপুর। বছরের বেশিরভাগ সময় খেলা হয় এখানেই। মিরপুরের উইকেটে রান তুলতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয় ব্যাটারদের।
এখানে দুশ রানের উইকেটে খেলে আন্তর্জাতিক আসরে তিনশ রানের ইনিংস খেলা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না টাইগার ব্যাটারদের। এ সময়ের ওয়ানডে তো বটেই, এমনকি টেস্ট ক্রিকেটেও টি-টোয়েন্টির প্রভাব ব্যাপক। আর সেখানে প্রস্তর যুগের উইকেট বানাচ্ছে বাংলাদেশ। দ্রুত বড় ইনিংস খেলতে হবে, এই মানসিকতায় গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশের ব্যাটারদের। খারাপ উইকেটে পাল্টা আঘাত হেনে কীভাবে ম্যাচ বের করে আনতে হয়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন গ্লেন ফিলিপস।
বছরব্যাপী দেশের শ্লথ ও মন্থর উইকেটে খেলে আর যাই হোক দলের বিপদের সময় পাল্টা আঘাত হেনে বড় স্কোর গড়া যায় না। আর অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাটারদের এই পার্থক্যটিই বড় হয়ে উঠছে দিনকে দিনই।