নাজমুল হক তপন
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:১২ এএম
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:১৮ পিএম
সিলেট স্ট্রাইকার্স অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা
হিরোরা কতদিন পর্যন্ত হিরো থাকেন? এ এক অনন্তের জিজ্ঞাসা। প্রিয় নায়ককে সবসময়ই অ্যাকশনে দেখতে চায় সাধারণ মানুষ। আর সমস্যাটা এখানেই। সাধারণের চাওয়ার কাছে অনেক সময়ই বাস্তবতা ভুলে যান হিরোরা। অনেক সময়ই লাখো মন্ত্রমুগ্ধ ভক্তদের চাওয়াটাকেই একমাত্র সত্যি বলে মনে করেন মহানায়করা।
আর এটা করতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনেন নিজেই। মানুষের সামর্থ্যের একটা সর্ব্বোচ্চ সীমা আছে। এরপর পতন হয়ে ওঠে অনিবার্য। এটা অনুধাবন করে হিরো ভাবমূর্তি থাকতে থাকতেই নিজেকে সরিয়ে নেন বুদ্ধিমানরা। তোয়াক্কা করেন না জনতুষ্টির।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, হিরোর পতনের বেদনা খুব দ্রুতই মুছে যায় সাধারণের মন থেকে। নব কিশলয়ের আগমনে, বনানী যেমনভাবে ভুলে যায় ঝরা পাতার কড়া শোক, এ যেন তেমনই। আর তাই হিরোর মর্যাদা রক্ষার একক দায়িত্ব এসে বর্তায় তারই কাঁধে। মন্ত্রমুগ্ধ লাখো ভক্তদের উপেক্ষা করার কঠিন সিদ্ধান্তটা আগেভাগে নেওয়াটা কঠিনই বটে। বিশেষ করে ক্রীড়াঙ্গনে। প্রায়শই দেখা যায় অবসর ভেঙে তারকারা ফিরে আসেন মাঠে। এর ফল বেশিরভাগ সময়ই সুখকর হয় না। হিরো থেকে হয়ে ওঠেন জিরো। আর সর্বশেষ অবস্থানটাই হয়ে ওঠে তাঁর বড় পরিচয়।
মাঠে মাশরাফি, বাংলাদেশ ক্রিকেটে এরচেয়ে আবেগের আর কিছু হয় না। দেশের ক্রিকেটে নেতৃত্ব আর মাশরাফি যেন এক বিনি সুঁতোর মালা। মাশরাফি মানেই সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া। তার ছোঁয়ায় উজ্জীবিত দল। কিন্তু সেই মাশরাফিকে চলতি বিপিএলে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার দল সিলেট স্টা্ইকার্স হেরেছে তিন ম্যাচেই। আসরের একমাত্র দল হিসাবে সিলেট এখন পর্যন্ত পয়েন্ট শূন্য। মাশরাফির পারফরম্যাান্সের অবস্থাও তথৈবচ। প্রথম ম্যাচে ব্যাট করেননি। বল হাতে ২.৩ ওভার ২৫ রান দিয়ে পেয়েছেন ১ উইকেট। দ্বিতীয় ম্যাচে ৭ বলে করেন ৬ রান, বল করেননি। তৃতীয় ম্যাচে ৪ ওভারে ১৯ রান দিয়ে থেকেছেন উইকেট শূন্য। ব্যাট হাতেও মেরেছেন গোল্ডেন ডাক।
সবথেকে বড় কথা সেই শরীরী ভাষাও দেখা যাচ্ছে না মাশরাফির মধ্যে। ফিটনেস ঘাটতি হয়ে উঠেছে দৃশ্যমান। বোলিং করছেন অনেক কম রান আপ নিয়ে।
আনফিট মাশরাফিকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। বিপিএলে বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়ার সময় আশরাফুল বলেছেন, ‘এই টুর্নামেন্টে আসলে...সে (মাশরাফি) কিন্তু খেলতে চাচ্ছিল না, মালিকেরা চাচ্ছে সে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকুক। এটা আমার মনে হয়, এই টুর্নামেন্টকে ছোট করা হচ্ছে। কারণ এ ধরনের টুর্নামেন্ট বিশ্বজুড়ে দেখছে। এখানে আমাদের আগামীর খেলোয়াড় আসবে। এই যে ছয় মাস পর আমাদের বিশ্বকাপ। তাদের (সিলেট) দলে কিন্তু রেজাউর রহমান রাজা বসে আছে। যার একটা সুযোগ ছিল, এই টুর্নামেন্টে ভালো করলে বিশ্বকাপে সম্ভাবনা থাকত। এ জায়গায় একটা মিসিং।’ ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে আশরাফুলের মন্তব্য নিয়ে মাশরাফি বলেন, ‘সব জিনিস সব জায়গায় ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে আমি যেটা মনে করেছি, ফিট না হয়ে বিপিএলের মতো আসরে ম্যাচ খেলাটা আদর্শ না। আর কে খেললে ভালো হতো সেটা পরের বিষয়, টিম ম্যানেজমেন্টের বিষয়।’
মাশরাফির সমালোচনা করায় আশরাফুলকে কড়া ভাষায় জবাব দিয়েছেন জাতীয় দলের তারই এক সময়ের সতীর্থ বাঁহাতি পেসার সৈয়দ রাসেল। , ‘কোটি টাকা খরচ করে মালিকই চেয়েছেন মাশরাফি খেলুক’। আরে ভাই তোর তো বুঝা উচিত… টিমের মালিক, যারা কিনা কোটি টাকা খরচ করছে বিপিএলে তারাই চাইছে মাশরাফি খেলুক। তাতে তোর সমস্যা কী?’
মাশরাফির বিপিএলে খেলার বিষয়ে আশরাফুলের কথার প্রতিধ্বনিত হয়েছে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিসিবি পরিচালক আকরাম খানের কন্ঠেও। দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাশরাফির নাম সরাসরি ইঙ্গিত না করে আকরাম খান বলেন, ‘অনেক খেলোয়াড় আছে আমরা দেখছি ফিট না, তারপরও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো ওদেরকে খেলাচ্ছে। বিপিএল কিন্তু শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য না, এটা কিন্তু পুরো বিশ্ব দেখছে। এগুলো কিন্তু তাদের চোখে পড়বে। তাতে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সব কথার এক কথা, মাশরাফি ইস্যুতে দেশের ক্রিকটোর ও ক্রিকেটপ্রেমীরা দ্বিধাবিভক্ত। ’ এত আলোচনা – সমালোচনার মধ্যেও মাশরাফির ওপর আস্থা রেখেছে সিলেট স্ট্রাইকার্সের ম্যানেজমেন্ট। দলটির টিম ম্যানেজার নাফিস ইকবালের ভাষায়, ‘আমরা জানি মাশরাফি কতটা শক্তিশালী। শুধু মাঠে খেলোয়াড় হিসেবে না, তার মধ্যে অসাধারণ নেতৃত্বগুণ রয়েছে। দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যও কিন্তু দেখতে হয়। আমাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক যারা রয়েছেন তারা চান ওই নেতৃত্বের জায়গা থেকেই মাশরাফি যেন একাদশে থাকে।’
সাধারণ মানুষের আবেগকে পাশ কাটানোর শিক্ষাটাও মহানায়কদের জন্য ভীষণভাবে জরুরি। একটা সময় মানুষকে থামতে হয়। ভারত পুরাণ সাক্ষ্য দেয়, শততম যুদ্ধে মহাবীর অর্জুনের দুরাবস্থার কথা। নিজের শততম যুদ্ধে নিজের সব চেনা অস্ত্রের কথা ভুলে গিয়েছিলেন অর্জুন। তার হাত থেকে খসে পড়ে গিয়েছিল, গান্ডিব ( যুদ্ধে অর্জুনের ব্যবহৃত ধনুক)। হিরোর মর্য্যাদা ধরে রাখতে পারাটাও আরেকটা লড়াই। মাশরাফি নিজের হিরো মর্যাদা ধরে রাখতে হবে আপনাকেই। আপনার সর্বশেষ পরিচয় হিরো থেকে যেন জিরো না হয়ে যায়, সেই লড়াইটাও যে আপনারই!