শরীফ স্বাধীন, মাগুরা
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৪ ০৯:৪২ এএম
আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৪ ১০:৩৫ এএম
অর্পিতা বিশ্বাস। ছবি : সংগৃহীত
দরিদ্রতা এগিয়ে যাওয়ার পথে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু অদম্য ইচ্ছা নিয়ে একদিকে খেলেছেন মাঠে অন্যদিকে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। বাধা এলেও এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে হার-না মানা এই অর্পিতার অধিনায়কত্বেই অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল দেশের মানুষের জন্য বয়ে এনেছেন সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম শিরোপা জয়ের আনন্দ। তিনি আরও অনেক দূর নিয়ে যেতে চান তার দলকে, হাসি ফোটাতে চান তার পরিবারের মুখে।
শ্রীপুর উপজেলার দারিয়াপুর ইউনিয়নের গোয়ালদহ গ্রামের ফুটবল খেলোয়াড় অর্পিতা বিশ্বাস। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট। পরিবারের সবাই তাকে আদর করে ডাকে অর্পি নামে। ২০ বছর আগে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গু হয়ে যান তার বাবা সবজি বিক্রেতা মনোরঞ্জন বিশ্বাস। সংসারের হাল ধরতে হয়েছে মা গায়ত্রী বিশ্বাসকে। চাকরি করেন তৈরি পোশাক কারখানায়। পরিবারে খরচের পাল্লা বেড়েই চলেছে, তাই বড় ভাই কিশোর বিশ্বাসকেও লেখাপড়া ছেড়ে অটো চালিয়ে উপার্জনে নামতে হয়েছে। তারপরও অভাব পিছু ছাড়ছে না তাদের। লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে অর্পিতার। যদিও যেমন ফুটবলে, তেমনি লেখাপড়ায়ও বারবার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।
অর্পিতার বিশেষ পরিচিতি ঘটে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশকে প্রথম শিরোপা জিতিয়ে আনার পর। টিমের অধিনায়ক হিসেবে তখন থেকেই তার মুখ এদেশের সব মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। অথচ অর্থাভাবে তার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। বর্তমানে অর্পিতা বিকেএসপিতে পড়ছে দশম শ্রেণিতে।
অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়ক অর্পিতা বিশ্বাস মোবাইলে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার পরিবার আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা প্রয়োজনীয় খরচ জোগাতে সমস্যা হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারলে প্রথমে আমার পরিবারের সদস্যদের পাশে দাঁড়াতে চাই। কারণ তারাই তো খেয়ে-না খেয়ে আমাকে টাকা-পয়সা দিচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে। পাশাপাশি চাই দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেÑ ফুটবল খেলা চালিয়ে যেতে।’
অর্পিতার বাবা মনোরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘আমার মেয়ের নেতৃত্বে অনূর্ধ্ব-১৬ নারীদের দল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতে দেশের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে। ও এখন বিকেএসপিতে দশম শ্রেণিতে। আগে থেকেই আমাদের পরিবারে অর্থসংকট। তারপরও আমরা আমাদের মেয়ের পাশে আছি। তবে দেশে সরকারিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে, যারা হয়তো আমাদের অর্পির পাশে দাঁড়িয়ে তার স্বপ্নপূরণে সাহায্য করতে পারে। তাতে আমাদের কষ্ট কমবে, মেয়েও উৎসাহ-সাহস পাবে।’
গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাস রঞ্জন দেবজ্যোতি বলেন, ‘অর্পিতা ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। আমাদের স্কুলে ও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে বিকেএসপিতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পায় পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে। ও এখন সেখানে অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়ক, যা আমাদের জন্য আনন্দের, গর্বের। তবে আর্থিক দৈন্যতার কারণে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আশা করি, এই অনিশ্চয়তা দূর করতে কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে।’
মাগুরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মো. মকবুল হোসেন বলেন, ‘অর্পিতা খুব উদ্যমী ও একাগ্র মেয়ে। আমি গোয়ালদহ স্কুলমাঠে ক্যাম্প করে ওদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। অর্পিতাসহ অনেকেই এখন ভালো অবস্থানে চলে গেছে। জানি, ওদের পরিবারের অবস্থা ভালো না। ওর বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব। আমরা চাই না, অর্পিতা থেমে পড়ুক।’
জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সহকারী কোচ মো. মাহাবুবুর রহমান লিটু মোবাইলে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অর্পিতা বিশ্বাস শুধু ফুটবল খেলোয়াড়ই নয়। সে সদালাপী, গুণী মেয়ে। শেখার যেমন আগ্রহ আছে তার, তেমনি রয়েছে পরিশ্রম করার অদম্য ইচ্ছা। আছে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। সকলেরই উচিত অর্পিতার পাশে দাঁড়ানো।’