রুবেল রেহান
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪ ২১:৩৩ পিএম
আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৪ ২১:৩৪ পিএম
শচীন টেন্ডুলকার। ছবি : সংগৃহীত
১৯৯৪ সালের আজকের এই দিনে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে ভারতের ইনিংস উদ্বোধন করতে নামেন সচিন টেন্ডুলকার। ক্রিকেটের খোঁজ-খবর রাখেন, এমনকি ক্রিকেটের প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও যার জানা তিনিও জানে মাস্টার ব্ল্যাস্টার নামে খ্যাত একজনই, তিনি শচীন টেন্ডুলকার। ফ্রি ফ্লোয়িং ব্যাটিংয়ে অন্য সবার চেয়ে শীর্ষে। ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা ওপেনারদের একজন তো বটেই সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের অন্যতমও এই রান মেশিন। মজার ব্যাপার হলো তিনি কিন্তু তার ক্যারিয়ার ওপেনার হিসেবে শুরু করেননি।
ওয়ানডে অভিষেকের পর সাড়ে চার বছরেও কখনও ইনিংস উদ্বোধন করতে নামেননি শচীন। ক্যারিয়ারে ৬৯টি একদিনের ম্যাচ খেলেছেন মিডল অর্ডারে। ঘটনাক্রমে ১৯৯৪ সালে আজকের এই দিনে এটি তার জীবনে প্রথমবার ঘটে। অকল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। তার একটি সাক্ষাৎকার থেকেই জানা যায়, অনেক অনুনয় বিনয়ের পর টিম ম্যানেজমেন্ট তার ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন দেয়।
ওপেনিংয়ে নেমেই ২১ বছর বয়সী তরুণ আস্থার প্রতিদান দেন। ওই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫০ ওভারের খেলায় ১৪৩ রান লক্ষ্য পায় সফরকারী ভারত। মাত্র ৪৯ বলে ৮২ রানের ইনিংস খেলে দলকে জেতান টেন্ডুলকার। সঙ্গে বিশ্বকে এই বার্তাও দিয়ে রাখেন তিনি আসছেন।
দ্য ব্যাকগ্রাউন্ড হিস্টরি
টেন্ডুলকারের জন্য এটা মোটেও সহজ ছিল না। তিনি ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মিডল অর্ডার ব্যাটার হিসেবে খেলেছেন। ভারতের মতো শক্ত ব্যাটিং লাইনআপের দেশে অনেক সময় তিনি ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগ পেতেন না। ক্যারিয়ার শুরুর অনেক বছর পরও নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করার সুযোগ পাননি। কিউইদের বিপক্ষে ওই ইনিংসটি খেলার আগে ৬৯ ম্যাচে ১৭৫৮ রান করেছিলেন। যেখানে ছিল ১৩টি অর্ধশতকের ইনিংস। ব্যাটিং গড় ৩০ দশমিক ৮৪।
কিন্তু ২৬ বছর আগের এই দিনে সব বদলে গেল এবং সেটিও ভাগ্যের সহায়তায়। নভজিৎ সিং সিধু, যিনি সেই সময়কার ভারতীয় দলের নিয়মিত ওপেনার। খেলার দিন হোটেলরুমে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে অসুস্থাবস্থায় আবিষ্কার করেন। ঘাড়ের ব্যথায় ছিটকে যান ম্যাচ থেকে। নেপিয়ারে প্রথম ওয়ানডে হেরে ব্যাকফুটে থাকা ভারত পড়ে যায় বিপদে। সুযোগ বুঝে তৎকালীন ভারতীয় টিম ম্যানেজার অজিত ওয়াদেকার এবং অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহার উদ্দিনকে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশনের জন্য অনুরোধ করেন সচিন।
নিজের আত্মজীবনীতে টেন্ডুলকার বলেছিলেন যে তিনি ওয়াদেকারকে ‘অনুরোধ’ করেছিলেন। এমনকি এটাও বলেছিলেন যে যদি ওপেনিংয়ে ব্যর্থ হন তবে আর কখনও এমন সুযোগ চাইবেন না। তার অনুরোধ ফলপ্রসূ হয়। শেষ পর্যন্ত জয় পায় ভারত।
দ্য ম্যাচ
চার ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে লিড নেয় নিউজিল্যান্ড। অকল্যান্ডে দ্বিতীয় ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় স্বাগতিকরা। ম্যাচে দারুণ বোলিং করে ভারতীয় বোলাররা। দলের প্রথম সারির তিন পেসার কপিল দেব, জাভাগাল শ্রীনাথ এবং সালিল আনকোলা শুরুতেই কিউই ইনিংসে ভাঙন ধরান। ২৩ রানে ৫ উইকেট হারায় তখনকার কেন রাদারফোর্ডের দল। দুই বল বাকি থাককে অলআউট হওয়া নিউজিল্যান্ড ১৪২ রানের পুঁজি পায় মূলত ক্রিস হ্যারিসের ফিফটিতে। ৭১ বলে ৫০ রানে অপরাজিত থাকেন এই অলরাউন্ডার। যিনি ডানহাতে মিডিয়াম পেসের সঙ্গে বা হাতে ব্যাট করতেন। শেষ দিকে ১১ বলে এক ছক্কা আর দুই বাউন্ডারিতে ১৭ রান করেন ক্রিস প্রিঙ্গেল। কপিল তার অনবদ্য বোলিং ফিগার সিলগালা করেন ১৮ রানে দুই উইকেট শিকার করে। দুটি করে উইকেট নেন শ্রীনাথ ও আনকোলা। আর রাজেশ চৌহান ৪৩ রান খরচায় নেন ৩ উইকেট।
দ্য ইনিংস
বোলারদের ম্যাচে টেন্ডুলকার তার দেশের হয়ে প্রথমবারের মতো ব্যাটিং উদ্বোধনে নামেন। খুব সম্ভবত তার মাথায় এটিও ছিল যে তিনি ওপেনার হিসেবে যোগ্য সেটি প্রমাণের জন্য এই একটি ম্যাচই তার হাতে ছিল। তবে সেই যুবক টেন্ডুলকার দ্বিতীয় সুযোগের অপেক্ষা করেননি। ব্যাট হাতে সেদিন এমন প্রভাব দেখিয়েছিলেন যে প্রিঙ্গল ও ড্যানি মরিসনদের পার্কের সব কোনায় আছড়ে ফেলেছিলেন।
টেন্ডুলকারের এমন ব্যাটিং দেখে বোধকরি ভিন্ন কিছু ভাবলেন গ্যাভিন লারসেন। যিনি সেই সময়ে বোলিংয়ে বেশ নাম করেছিলেন। বোলিংয়ে এসে তিনি উইকেটরক্ষককে স্ট্যাম্পের খুব পেছনে ডেকে আনেন। তবে তার এই সিদ্ধান্তে মোটেও বিচলিত হননি টেন্ডুলকার। বরং দুই ওভার বল করার পর টেন্ডুলকারের সামনে লারসেনকে পাঠানোর সাহসই করেননি অধিনায়ক রাদারফোর্ড। টেন্ডুলকারের সামনে বল করে লারসেন ২ ওভারে দিয়েছিলেন ২৪ রান।
শুরু থেকে কাভার ড্রাইভ, অনসাইড শাফল, সামনে এগিয়ে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা, ব্যাকফুট পাঞ্চ, কী ছিল না সেদিন টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়ে! দ্রুতই ৩৪ বল মোকাবিলা করে ফিফটিতে পৌঁছে যান তখনকার তরুণ টেন্ডুলকার। ১৫০ স্ট্রাইকরেটের ব্যাটিং সেই সময় খুব একটা দেখা যেতো না। সেখানেই থামেননি টেন্ডুলকার। মাত্র ১৩ ওভারে ভারতের রান ১০০ পার করিয়েছেন। টেন্ডুলকার শেষ পর্যন্ত ভারতের লক্ষ্যমাত্রা থেকে মাত্র ২৬ রান দূরে থাকতে আউট হন। বাঁহাতি স্পিনার ম্যাথিউ হার্টের বলে তারই কাছে সহজ ক্যাচে শেষ হয় টেন্ডুলকারের ৪৯ বলে ৮২ রানের ইনিংসটি। শেষ পর্যন্ত ১৬০ বল এবং ৭ উইকেট হাতে রেখে জয়ের বন্দরে পৌছায় আজহার উদ্দিনের দল। ১৬৭ দশমিক ৩৪ স্ট্রাইকরেটের ইনিংসে ১৫ বাউন্ডারির সঙ্গে দুটি ছক্কা হাঁকান টেন্ডুলকার। ম্যাচ সেরার স্বীকৃতি ওঠে তার হাতে।
হোয়াট ফলোওড
অনেকের মতে ওই দিনই ক্রিকেট তার সুপারস্টারকে খুঁজে পেয়েছে। এরপর থেকে ওয়ানডেতে ওপেনার হিসেবে ৩৪৪ ম্যাচ খেলেছেন টেন্ডুলকার। ব্যাটিং গড় ৪৮ দশমিক ২৯, রান ১৫ হাজার ৩১০। অন্য পজিশনে ব্যাট করে ১১৯ ম্যাচে ৩৩ গড়ে করেছেন ৩ হাজার ১১৬ রান। টেন্ডুলকারের ৪৯টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির মধ্যে ৪৫টিই এসেছে ব্যাটিং ওপেন করার সময়।
ক্যারিয়ারে টেন্ডুলকার মোট ৪৬৩ ওয়ানডে ম্যাচে ৪৪ দশমিক ৮৩ গড়ে ১৮ হাজার ৪২৬ রান করেন। ওয়ানডে ইতিহাসে এর চেয়ে বেশি রান ছিল না আর কারও। রেকর্ডটি এখনও অটুট রয়েছে।
সিরিজের শেষ দুটি ওয়ানডে সিধু দলে ফিরলেও ওপেনিং স্পট হারান। ওয়েলিংটন এবং ক্রাইস্টচার্চে তিনি ৩ নম্বরে ব্যাট করেন। সিধু ১৯৯৮ সালে তার ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
কিউইদের বিপক্ষে ওই ম্যাচে অনেকেই আক্ষেপ করে বলেছিলেন যদি টেন্ডুলকার শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকতেন। তবে হয়ত সেঞ্চুরিটাও পেয়ে যেতেন। কিন্তু ক্রিকেট বিধাতা হয়ত ভেবেছিলেন অন্যভাবে। ওয়েলিংটনের ১৮ হাজার দর্শকের হাততালি আর বাহবা মাথায় নিয়ে সেদিন যে একাই প্যাভিলিয়নে ফিরতে পেরেছিলেন টেন্ডুলকার।