× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বনস্পতির নিবিড় পাহারায়

রেজাউল বাহার

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:৫৩ পিএম

আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:০২ পিএম

মাসাইদের গ্রামে                                                                                                                                           ছবি : শারমিন বাহার

মাসাইদের গ্রামে ছবি : শারমিন বাহার

আফ্রিকার দেশ কেনিয়া ও তানজানিয়ায় যাত্রা খুব স্বাভাবিকভাবেই রোমঞ্চ জাগায়                                    ছবি : রেজাউল বাহার

আফ্রিকার দেশ কেনিয়া ও তানজানিয়ায় যাত্রা খুব স্বাভাবিকভাবেই রোমঞ্চ জাগায় ছবি : রেজাউল বাহার

প্রাকৃতিক রহস্যময়তায় ঘেরা দেশ আফ্রিকার কেনিয়া ও তানজানিয়া। বিচিত্র প্রাণপ্রকৃতিতে ভরপুর এই অঞ্চলে ৯ দিনের রোমাঞ্চকর ভ্রমণের গল্প নিয়ে এ আয়োজন। লিখেছেন রেজাউল বাহার

প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদে ঐশ্বর্যমণ্ডিত মহাদেশ আফ্রিকা। কংক্রিট সভ্যতার নাগপাশ কাটিয়ে প্রাচীন বৃক্ষরাজির গভীরে এখনও এখানে বিচরণ করে বৃহদাকার হাতি, জিরাফ, সিংহ, গন্ডার ও চিতার মতো প্রাণিকুল। নিজ সংস্কৃতি ধারণ করে বসবাস করছে আদিবাসী মানবগোষ্ঠী। সেই আফ্রিকার দেশ কেনিয়া ও তানজানিয়ায় যাত্রা খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের রোমঞ্চ জাগায়।

কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। এখান থেকেই কেনিয়ার মাসাই মারা হয়ে তানজানিয়ার সেরেঙ্গেটি আর গরংগোরো যাব আমরা। ফিরে আসব তানজানিয়ার কিলিমাঞ্জারো হয়ে। অনেক দিনের পরিকল্পনায় ৯ দিনের এ ট্রিপটা ঠিক হলো সেন্সটুয়ারি রিট্রাইটসের সঙ্গে। ওদেরই বাংলো আর তাঁবুতে কাটবে আমাদের দিনগুলো।

ছবি : লেখক

নাইরোবি নেমে এক রাত হোটেল, পরদিনই অভ্যন্তরীণ উইলসন এয়ারপোর্ট থেকে খুব ছোট্ট একটা প্লেনে আমাদের যেতে হয় মাসাই মারার কিচওয়া টাম্বো এয়ারস্ট্রিপে। কিচওয়া টাম্বো এয়ারস্ট্রিপে আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে নেলসন। এই ভ্রমণে সে আমাদের ড্রাইভার কাম ট্যুর গাইড। আমরা যে বাংলোয় উঠি তার গা-ঘেঁষে বয়ে গেছে মারা নদী। কুমির আর জলহস্তীর আনাগোনা এখানে। তবে এ এলাকায় জলহস্তীর সংখ্যাটাই বেশি। প্রতিদিন সকালে এখানে ঘুম ভাঙে জলহস্তীর ডাকে। এরা রাতে খাবারের সন্ধানে বের হয়, ফিরে আসে সকাল হওয়ার আগেই। সারা দিন পানিতেই এদের অবস্থান। মারা ন্যাশনাল রিজার্ভ ১ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এখানকার আদিবাসীরা মাসাই নামে পরিচিত। বন্যপ্রাণী রক্ষায় তাদের সরে যেতে হয়েছে মারা রিজার্ভের বাইরে। একসময় তারাও বন্যপ্রাণী শিকার করত। তবে এখন তা বন্ধ।

ছবি : লেখক

মারা এলাকা হলো বিস্তীর্ণ খোলা অভয়ারণ্য। মাঝেমধ্যে কিছু পাহাড়ি জায়গা, ছড়ানো-ছিটানো বড় গাছ। বড় গাছ কম থাকার মূল কারণ হাতি। এরা গাছ উপড়ে ফেলে। জিরাফ গাছের নিচ থেকে পাতা খেয়ে খেয়ে গাছের আকৃতি তৈরি করে ফেলে অনেকটা ছাতার মতো। বেশ আগে মানুষ খেলার নামে শিকার করত পাঁচটি প্রাণী- সিংহ, লেপার্ড, হাতি, গন্ডার আর বনমহিষ। অনেকটা ট্রফি জেতার খেলা, নাম বিগ ফাইভ গেম ড্রাইভ। এখনও ট্যুরিজমের জন্য সাফারিতে বের হলে বলা হয় গেম ড্রাইভ, খুঁজে খুঁজে বের করা হয় বিগ ফাইভ অ্যানিমেলস। ভূমিতে বসবাস করা ৯০টির বেশি প্রাণী আছে মাসাই আর সেরেঙ্গেটিতে। মাসাই আর সেরেঙ্গেটি মূলত একই বিস্তীর্ণ ভূমি, দুটি দেশের সীমানার কারণে কেনিয়ার অংশটুকু মাসাই মারা, তানজানিয়ার অংশের নাম সেরেঙ্গেটি।

ছবি : লেখক

সেরেঙ্গেটি শব্দের মূল অর্থ সীমাহীন বিস্তীর্ণ ভূমি। এখানে না এলে বোঝার উপায় নেই সেই বিশালতার মূল অর্থ। যতদূর চোখ যায় শুধু ঘাস আর ঘাস, মাঝেমধ্যে দু-একটি বড় গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। সেরেঙ্গেটি মূলত মাসাই মারার ২০ গুণ বড়। পৃথিবীতে কিছু বন্যপ্রাণী এখন বিলুপ্তির পথে। কিছু প্রাণী যার থাকার জন্য প্রয়োজন সীমাহীন এলাকা। চিতা তেমনই একটি। একেকটি চিতার টেরিটরি হয়ে থাকে প্রায় ১ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে। চিতার জন্য এতটা জায়গা মানুষ কত দিন ছাড়বে তা কেবল ভবিষ্যৎই বলে দেবে। মারা-সেরেঙ্গেটিতে ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটারে এখন চিতা আছে মাত্র ৩০০। এদের দেখতে পাওয়া যেমন বিরল; এদের শিকার করতে বের হওয়া স্বচক্ষে দেখা লটারি জেতার মতো ভাগ্যের ব্যাপার। এমন বিরল ঘটনা ঘটে গেল আমাদের চোখের সামনে।

শারমিন আর আমি স্যাংচুয়ারি ওলনানা লজ থেকে সেদিন খুব সকালে বের হয়েছি। বাংলো থেকে নিয়ে নিয়েছি দুপুরের খাবার। ইচ্ছা আছে, কোনো একটা ফাঁকা জায়গায় খেয়ে নেব। গাড়ির স্টিয়ারিং নেলসনের হাতে। এখানে গাড়িচালকদের পরস্পরের মধ্যে রেডিও কমিউনিকেশনের ব্যবস্থা আছে। হঠাৎ নেলসনের কাছে সংকেত এলো, চিতা বাঘ দেখা গেছে। সাধারণত এই প্রাণীর দেখা পাওয়া মুশকিল। লুকিয়ে থাকে। বের হয় শুধু খাবারের সন্ধানে। মাসাই মারায় ঘাসগুলো ২ থেকে ৪ ফুট উঁচু। গাড়ি দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। অনেকক্ষণ পর চিতার সন্ধান পাওয়া গেল। চিতাটি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে খোলা দিগন্তের দিকে। হঠাৎ দেখলাম চিতাটি অদৃশ্য হয়ে গেছে! আমরাও সরে গেলাম অন্যদিকে। কিছুক্ষণ পর খবর এলো, চিতা আবার বের হয়েছে। আবারও তার পিছু নিলাম। উঁচু ঘাসের সীমানা ছেড়ে এখন সে ধীরে ধীরে খোলা প্রান্তরের দিকে যাচ্ছে।

আফ্রিকার এই তৃণভূমিতে অসংখ্য হরিণ। চিতাটি দূর থেকে হরিণ দেখছে। খোলা দিগন্ত, উঁচু ঘাস, মাঝেমধ্যে উইপোকার ঢিবি। কিছুটা এগিয়ে চিতাটি একটি ঢিবির ওপরে উঠে বসে চারপাশটা দেখল। দুরবিনে দেখলাম, মাইলখানেক দূরে কিছু হরিণ। চিতা এখান থেকে তার লক্ষ্য ঠিক করে নিচ্ছে। বেছে নেয় কোন হরিণটির পেছনে সে ছুটবে। চিতার পেছনে আমরা কাটিয়ে দিই প্রায় দুই ঘণ্টা। সবকিছু ঘটছে ধীরগতিতে। ৫০০ মিলিমিটার ক্যামেরার লেন্স ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা করছিল। দুর্ভাগ্য, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই মুহূর্তে চিতা বুলেটের বেগে দৌড়াতে শুরু করল। ১০ সেকেন্ডের মতো। তারপর থামল। মনে হলো চিতার হিসাবে গড়বড় হয়ে গেছে।

ছবি : লেখক

দূর থেকে চিতাকে দেখতে পেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে হরিণের দল। পুরো দুপুর পার হয়ে গেল। চিতাটি আবার শিকারে যাবে কি না বলা মুশকিল। চারদিক তখন হরিণশূন্য। চিতাটি ধীরে এগোচ্ছে। নেলসনকে বললাম, বাদ দাও। চল ফিরে যাই, খেতে হবে। সে একটু ধৈর্য ধরতে বলল। মনে মনে বিরক্ত হলাম। নেলসন কি বুঝতে পারছে না আমরা ক্লান্ত। বিকাল ৩টা পেরিয়ে যাচ্ছে। ক্যামেরা আবার হাতে নিলাম। চিতা এখন আমাদের মাইলখানেক সামনে। মাসাই মারায় কিছু নিয়ম আছে। প্রাণী শিকারে থাকলে তার পিছু নেওয়া যাবে না। শিকার ধরে ফেললে তার সামনে গাড়ি নিয়ে হাজির হওয়া যাবে। ফলে আমরা একেবারে কাছাকাছি যেতে পারব না।

এবার বহুদূরে কিছু হরিণ দেখা গেল। আমার হাতে ক্যামেরা, নেলসনের হাতে দুরবিন। সে আমাদের অনেকক্ষণ ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে, দূরে হরিণগুলোর মধ্যে একটি অল্পবয়সি হরিণ আছে। চিতাটি ওটাকেই টার্গেট করবে। চিতা আর হরিণের দূরত্ব তখনও মাইলখানেক। হঠাৎ চিতা দৌড় শুরু করল। প্রচণ্ড ভয়ে ছুটছে হরিণগুলো। চিতাটি যেন ছুটছে আরও জোরে। শিকার ধরতেই হবে। সে কী ভয়ংকর গতি। মাত্র ২২ সেকেন্ডে ধরে ফেলে তার শিকার! মুহূর্তের মধ্যে নেলসন গাড়ি স্টার্ট দিল। মনে হলো তৃণভূমির ওপর দিয়ে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে সে। চিতার পাশে এসে গাড়ি থামল। দেখলাম, হরিণটি তখনও জীবিত, কান দুটি নড়ছে। গলার পাশ কামড়ে ধরে আছে চিতা। মাটিতে শুয়ে আছে দুটি প্রাণী। এতক্ষণ শিকার দেখার উত্তেজনায় ছিলাম। এবার হরিণটির জন্য খুব মায়া হলো। পুরো ভ্রমণে অগণিত পশুপাখির সান্নিধ্যে আসার 

ছবি : লেখক

সুযোগ হয়েছে আমাদের। খুব কাছ থেকে হয়তো ১০ ফুটের মধ্যে বসে থেকেই দেখা গেছে সিংহের দল, হাতি, জিরাফ, জেব্রা, জলহস্তী। চিতা আর লেপার্ড- এ দুই প্রাণী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। লুকিয়ে থাকে, বের হয় শুধু খাবারের সন্ধানে। মাসাই মারা থেকে প্লেনে ফিরলাম তানজানিয়ার বর্ডারের কাছাকাছি। বন্যপ্রাণীদের নিজস্ব ভূমিতে কিছুদিন থেকে, খুব কাছ থেকে তাদের দেখা, মাসাইদের গ্রামে মানুষের জীবন ছুঁয়ে আসা, ক্ষুধার্ত চিতার বুলেটের মতো ছুটে বেড়ানো, অসহায় হরিণের প্রাণে বাঁচার শেষ চেষ্টা- এসবই অনেকটা কল্পনার মতো মনে হয়। যেন স্বপ্নে ঘুরে আসা এক জগৎ।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা