× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ডোলমা খাং অভিযান

রিয়াসাদ সানভী

প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:১৫ পিএম

আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:২২ পিএম

হিমালয়ের ৬ হাজার ৩৩২ মিটার উঁচু ডোলমা খাং পর্বতচূড়ায় লাল সবুজ-পতাকা হাতে উচ্ছ্বসিত ৪ অভিযাত্রী

হিমালয়ের ৬ হাজার ৩৩২ মিটার উঁচু ডোলমা খাং পর্বতচূড়ায় লাল সবুজ-পতাকা হাতে উচ্ছ্বসিত ৪ অভিযাত্রী

ডোলমা খাং অভিযান

সকাল ৯টা বেজে ২৫। সরু ছুরির মতো একটা ২০ থেকে ২৫ মিটার লম্বা রিজ পার হয়ে কিলু পেম্বা শেরপা সামনে উঠে গেলেন। তার পেছনে এমএ মুহিত। তারপর সানভী। একে একে এলেন শাকিল, বিপ্লব আর নিমা শেরপা। তারা পেছনে ফেলে এসেছেন ভয়ংকর এক পথ। ক্রেভাসে পরিপূর্ণ আইস ফিল্ড, খাড়া বরফের দেয়াল, রাতভর চলার ক্লান্তি- কিছুই আটকাতে পারেনি। প্রথমবারের মতো কোনো বাংলাদেশি পর্বতারোহী দল আরোহণ করল হিমালয়ের ৬ হাজার ৩৩২ মিটার উচ্চতার মাউন্ট ডোলমা খাংয়ে। তাদের শৃঙ্গ আরোহণের সেই দুঃসাহসিক গল্প লিখেছেন অভিযাত্রী রিয়াসাদ সানভী

২৫ অক্টোবর, ২০২২। কাঠমান্ডু গেস্টহাউস থামেল, কাঠমান্ডু। বাইরে তখন তিহার উৎসবের রোশনাই। থামেলের প্রতিটি অলিগলিতে চলছে রং, আলো, কোলাহলের বর্ণিল উৎসব। কিন্তু কাঠমান্ডু গেস্টহাউসের ১০৪ ও ৪ নম্বর কক্ষে যেন কবরের নিস্তব্ধতা। নিয়ম করে শুধু তিন বেলার খাওয়া ছাড়া আগের তিন দিনের পুরোটা সময় আমরা রুমেই কাটিয়ে দিয়েছি। বাইরে কী আনন্দ, কোলাহল। নেপালিরা তো আছেনই, সারা পৃথিবী থেকে হিমালয় ঘুরতে এবং অভিযানে আসা পর্যটকরা যোগ দিয়েছেন সেই উৎসবে। কিন্তু আমরা চারজন রুম অন্ধকার করে বসেই আছি। মাত্র কয়েকদিন আগেই একটি পর্বত অভিযান শেষে ফিরেছি। খারাপ আবহাওয়ার কারণে শীর্ষে আরোহণ না করেই আসলে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি এক কথায়। ঢাকার ফিরতি ফ্লাইট আগেই বুক করা। এ অভিযানটি ছিল অনেক স্বপ্ন ও প্রত্যাশার।

দোগারি হিমাল নামে সেই পর্বতে কোনো বাংলাদেশি অভিযাত্রী দলের প্রথম আরোহণ ছিল সেটি। স্বভাবতই এটি আরোহণ করতে পারলে ছিল ইতিহাসের হাতছানি। কিন্তু আবহাওয়ার বিরূপ আচরণের কারণে মাঝপথে সেই অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করে মাঠমান্ডু ফিরতে হয়। সেই গল্প না হয় অন্য কোনো দিন বলব। আমাদের দলনেতা এবং দুবারের এভারেস্ট আরোহী প্রথম বাংলাদেশি এমএ মুহিত। সঙ্গে কাজী বিপ্লব, ইকরামুল হাসান শাকিল। দোগারি হিমাল বেসক্যাম্পে বসেই মুহিত ভাই আফসোস করে বলছিলেন, যদি আরেকটি অভিযান করা যেত!

অনেক দিন ধরেই তিনি ৬ হাজার ৩৩২ মিটার উচ্চতার মাউন্ট ডোলমা খাং অভিযানের ব্যাপারে চিন্তা করছিলেন। এটি মধ্য-উত্তর নেপালের রোলওয়ালিং উপত্যকায় একেবারে তিব্বত সীমান্ত ঘেঁষে গৌরীশঙ্কর রেঞ্জের কোলে অবস্থিত। কাঠমান্ডুতে ফিরে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করলেন সেখানে অভিযান আয়োজন নিয়ে। কিন্তু একটি পর্বত অভিযানের অনেক খরচ। তিনি বারবার দেশে ফোন করে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। শেষ পর্যন্ত মুহিত ভাইয়ের অদম্য জেদের কাছে পরাজিত হলো সব বাধা। অভিযানের সবকিছু ঠিক হলো। কিন্তু আমাদের হাতে যে সময়, তা এ ধরনের অভিযানের জন্য পর্যাপ্ত নয়। মুহিত ভাই সেই চ্যালেঞ্জটি নিলেন। আমরা তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হলাম। আমাদের চারজনের সঙ্গে যোগ দিলেন কিলু পেম্বা শেরপা ও নিমা নুরু শেরপা। কিলু আর নিমা আমাদের সঙ্গে দোগারি হিমাল অভিযানেও সহ-অভিযাত্রী ছিলেন। এর মাঝে কিলু পেম্বা শেরপা প্রথমবারের মতো শীতকালে কে টু অভিযানে রেকর্ড সৃষ্টিকারী দলের অন্যতম আরোহী। মাত্র দুই দিনের প্রস্তুতি শেষে আমরা ২৮ অক্টোবর কাঠমান্ডু থেকে বেরিয়ে পড়লাম সিমিগাঁওয়ের উদ্দেশে।

সিমিগাঁওয়ের পথে…

কাঠমান্ডু থেকে সকাল ৬টায় জিপে সবাই রওনা দিলাম। তামাকোশী নদীর পাড়ে ছ্যাতছ্যাত নামে একটি জায়গায় আমরা দুপুর ২টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। তারপর তড়িঘড়ি মালপত্র সব নামিয়ে নদীর সাসপেনশন ব্রিজ পেরিয়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে লাগলাম। অনেকটা ওপরে সিমিগাঁও। সবার ভেতরে লক্ষ্যে পৌঁছানোর তাড়া। একটা ভ্যাপসা গরম ছিল সঙ্গী। প্রথমে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু বিকাল ৫টার আগেই শেরপা গ্রাম সিমিগাঁওয়ে পৌঁছে গেলাম সবাই। সেখানকার গৌরীশঙ্কর লজে জায়গা হলো। রাতে শাকান্ন দিয়েই ডিনার সারলাম। এখন থেকে অভিযান শেষ করে না ফেরা পর্যন্ত আর কোনো মাংস জুটবে না কপালে। কারণ রোলওয়ালিং উপত্যকায় যে-কোনো পশু হত্যা নিষিদ্ধ।পরদিন সকালে সিমিগাঁও থেকে রওনা দিয়ে বিকালের অনেক আগেই পৌঁছে গেলাম ডংগং। এখানকার উচ্চতা ২ হাজার ৮০০ মিটার। রোলওয়ালিং খোলার পাশে ছবির মতো দু-তিনটি ঘর নিয়ে এখানকার বসতি। পরদিন ডংগং থেকে রওনা দিয়ে বিকালেই চলে আসি বেদিং। শেরপাদের এই গ্রামটির উচ্চতা প্রায় ৩ হাজার ৮০০ মিটার। গ্রামে ঢোকার কিছুটা আগেই চকিতে দেখা হয়ে গেল মাউন্ট ডোলমা খাংয়ের সঙ্গে।

বেদিংই ছিল বেসক্যাম্প

আমাদের পরিকল্পনা ছিল পরদিনই হাইক্যাম্পে চলে যাওয়া। কিন্তু কিলু পেম্বা শেরপা বললেন একটা দিন গ্রামে বিশ্রাম নিতে। ঠিক হলো বেদিংই হবে এ অভিযানের বেসক্যাম্প। দিনটা বেদিংয়ে মহা আনন্দেই কাটল। আমরা হাই গেইন করতে কিছুটা ওপরের বেদিংয়ের বৌদ্ধ গুম্ফায় গেলাম। সেখান থেকে পুরো উপত্যকা পাখির চোখে দেখা যায়। সকাল হলো। রওনা হলাম হাইক্যাম্পের পথে। গ্রামের একেবারে কোলঘেঁষেই পথ যেন উঠে গেছে আকাশের পানে। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ছোট গলিরাস্তা পার হতেই সামনে বিশাল প্রান্তর ঢালের মতো নেমে এসেছে গৌরীশঙ্করের একেবারে কোল থেকে। চোখের সামনেই সেই কাঙ্ক্ষিত চূড়া মাউন্ট ডোলমা খাং। মন চাইছিল এক লাফে চলে যেতে। কিন্তু দিল্লি দূর অস্ত!

হাইক্যাম্প থেকে শুরু আসল অভিযান

দুপুরের মাঝে আমরা ৪ হাজার ৯০০ মিটার উচ্চতার হাইক্যাম্পে চলে আসি। বিশাল পাথুরে উদ্যানের মতো। চারপাশে তখন গৌরীশঙ্করের বিখ্যাত সব শৃঙ্গ। তিনটি তাঁবু করা হলো। আগেই ঠিক ছিল রাতে সামিট পুশ হবে। বিকালে শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। জুমার, হার্নেস, ক্র্যাম্পন, ক্যারাবিনার সব পরীক্ষা করে দেখা হলো। শেষ বিকালে আলো যখন গৌরীশঙ্করের মাথায়, আমরা সামিটের সব প্রয়োজনীয় কাপড় পরিধান করে রাতের আহার সেরে নিলাম। এরপর তাঁবুর চেন বন্ধ করে শুয়ে ঘুমের চেষ্টা করা।

শুরু হলো সামিট পুশ

রাত ১২টায় কিলু পেম্বা শেরপা আমাদের ডেকে ওঠালেন। হালকা খাবার আর চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম হেডটর্চের আলোয়। তখন ঘড়িতে রাত সোয়া ১টা। প্রথমে পথ গেছে বড় বড় সব বোল্ডারের ফাঁক গলিয়ে। কষ্টকর সেই চলা। কখনও কখনও তো বোল্ডারিংও করতে হচ্ছিল। ঘণ্টা দেড়েক এভাবে চলার পর বরফের দেখা পাওয়া গেল। এবার কিছুটা স্বস্তি। রাতের ঠান্ডায় বরফ সব শক্ত হয়ে আছে। ফলে অসাবধানে পা দেবে যাওয়ার ভয় কম। এভাবে আরও কিছুটা চলার পর এলো ক্র্যাম্পন পয়েন্ট। সবাই আইসবুটের নিচে কাঁটার মতো কাঠামোটি আটকিয়ে নিলাম। মেইন রোপে সবাইকে বেঁধে নেওয়া হলো। এরপর শুরু একটানা চলা। কখনও বিশাল চড়াই, কখনও ঢালু ময়দান; তারপর ভোররাতের দিকে একটানা চড়াই পার হয়ে যখন আকাশচুম্বী বরফের এক দেয়ালের নিচে চলে এলাম, তখন পুবদিগন্ত সবে লাল হতে শুরু করেছে। আর হাঁটার সুযোগ নেই। সামনের দেয়াল প্রায় ৯০ ডিগ্রি সটান উঠে গেছে আকাশপানে। এখানে ফিক্সড রোপ করতে হবে।

কিলু পেম্বা আর নিমা নুরু শেরপা আগে রোপ ফিক্সড করছিলেন। আমরা পেছন পেছন ক্লাইম্ব করছিলাম। কিছু জায়গায় বরফ আর পাথরের মিক্সড ক্লাইম্বিং। ঘণ্টা তিনেকের বেশি মোটামুটি আমরা দড়িতে জুমারের সাহায্যে রীতিমতো ঝুলছিলাম। তো একটা ভুল ডেকে আনতে পারত নিশ্চিত মৃত্যু। এভাবে ক্লাইম্ব করে আমরা সেই দেয়ালের মাথায় উঠে এলাম। নিচ থেকে মনে হচ্ছিল চূড়া বুঝি এখানেই। কিন্তু ডান দিকে তাকিয়ে শরীর হিম হয়ে গেল। সরু ২৫ থেকে ৩০ মিটারের এক রিজ লাইন উঠে গেছে উঁচু ঢিবির মতো এক জায়গায়। কিলু পেম্বা শেরপা জানালেন, সেটিই সামিট। কিন্তু তার আগে এই ভয়াবহ রিজ লাইনের পরীক্ষা দিতে হবে।

বাঁয়ে তিব্বত, ডানে নেপাল

এতদূর যখন এসেছি, তখন আর এমনি এমনি ফেরার সব পথ বন্ধ! তার ওপর এমন সুন্দর আবহাওয়া আর নীল আকাশের হাতছানি। সামিট না করে ফেরাটা হবে অপরাধ। কিলু পেম্বা আগে গিয়ে একটি ফিক্সড করলেন বটে, কিন্তু তার অবস্থাও তথৈবচ। একদিকে তিব্বত, আরেকদিকে নেপাল। নিচের দিকে গড়াতে শুরু করলে হয়তো হাজার হাজার ফিট অতলে গিয়ে পড়ব না; কিন্তু দড়িতে আটকে পড়তে পড়তেই অনেক নিচে চলে যেতে হবেÑ দড়িটি এমন আলগা করেই বাঁধা। কোনোমতো রিজ লাইনটি পার হয়ে এসে চূড়ার নিচের ঢালু অংশটিতে এসে দাঁড়ালাম। ওপরে ততক্ষণে মুহিত ভাই পৌঁছে গেছেন। এরপর দমবন্ধ করা কয়েক মুহূর্ত। নিজেকে আবিষ্কার করলাম ডোলমা খাংয়ের চূড়ায়। একটু পরই বাকি সবাই এসে পড়লেন। ২ নভেম্বর ২০২২, প্রথমবারের মতো কোনো বাংলাদেশি অভিযাত্রী দল আরোহণ করল মাউন্ট ডোলমা খাংয়ে।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা