হাবিব ওয়াহিদ
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫৯ পিএম
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৩ ১৪:০৫ পিএম
পাহাড়ের গা ঘেঁষে অবিরাম বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বচ্ছ পানি ছবি : শামীম আহমেদ
শহরের যানজট ও গাড়ির হর্নকে পেছনে ফেলে বিরিশিরি দর্শনের স্বপ্নযাত্রা নিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। গোলাপি আভার পাহাড় ও মেঘালয় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলের সোমেশ্বরী নদী দর্শনের ইচ্ছে দীর্ঘদিনের।
ইচ্ছেপূরণের লক্ষ্যে ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখ ঠিক করে রাখলাম। ভ্রমণ একটা ব্যাধি বটে, যারা এ রোগে আক্রান্ত হননি তারা হয়তো বুঝবেন না। সে ব্যাধি আমাকে সংক্রমিত করুক তেমনটাই চাই। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাণী আমার ভ্রমণে সর্বদাই প্রেরণা জোগায়- ‘অনেক ধনী লোক দেখেছি যারা টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে নিজের কোনো শখই পূরণ করতে পারে না।’ ঢাকা থেকে বিরিশিরির দূরত্ব প্রায় ১৭০ কিলোমিটার।
জ্যামে ঠাসা রাজধানী ও গাজীপুর শহর পেরিয়ে ময়মনসিংহের পথে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। পাশের সিটে ভ্রমণসঙ্গী সেলিম ভাই। নানাবিধ নিয়মের ব্যস্ততায় যাদের জীবন আটকে যায়, দম ফুরাবার ফুসরত নেই। যাদের কিনা লং-ট্রিপে যাওয়া অসম্ভব- তাদের জন্য বিরিশিরি হতে পারে আদর্শ ভ্রমণ গন্তব্য। ঢাকা থেকে ৩/৪ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন। দুর্গাপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন হলো ‘বিরিশিরি’। যেখানে রয়েছে অনেকগুলো পর্যটন গন্তব্য। দর্শনার্থীরা বিরিশিরি ভ্রমণে যেসব পর্যটন এলাকা ঘুরে দেখেন তা হলো- বিজয়পুর বর্ডার, কমলা বাগান, গারো পাহাড়, দুর্গাপুরের জমিদারবাড়ি, সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী, হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, সোমেশ্বরী নদী এবং নীলচে-সবুজ জলের হৃদ চিনামাটির পাহাড়।
পড়ুন ষাটগম্বুজে মধ্যদুপুর
বিরিশিরিতে যতগুলো পর্যটন স্পট আছে, সবগুলোই সোমেশ্বরী নদীর ওপারে। নদী পার হয়ে শিবগঞ্জ বাজার থেকে অটোতে চড়ে রওনা দিলাম প্রথম এবং বিরিশিরি ভ্রমণের মূল গন্তব্য চিনামাটির পাহাড়। গ্রামীণ মেঠোপথ পেরিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের বাহন। সড়কের দুই পাশে সবুজ ধানক্ষেতের সমারোহ, স্নিগ্ধ শীতল বাতাস গায়ে এসে শরীরে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। পথিমধ্যে টংক ও কৃষক আন্দোলনের পথিকৃৎ নেত্রী হাজং মাতা শহীদ রাশিমণি স্মৃতিসৌধে খানিক বিরতি নিলাম। এ স্মৃতিসৌধটি দুর্গাপুর উপজেলার বহেড়াতলীতে অবস্থিত। একদিনের বিরিশিরি ভ্রমণে যেসব জায়গা ঘুরে দেখা যায়।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি
দুর্গাপুরের বাসস্ট্যান্ডের পাশেই অবস্থিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি। এখানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে।
সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী ও রানিখং উচ্চ বিদ্যালয়
সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে রিকশায় যেতে হয় রানিখং গ্রামে। এখানে আছে সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী। রানিখং গ্রামের এ ক্যাথলিক গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। গির্জাটা বেশ সাজানো-গোছানো, সুনসান নীরব এবং খুবই সুন্দর। পাশেই অবস্থিত রানিখং উচ্চ বিদ্যালয়।
গারো পাহাড়
গারো পাহাড় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো-খাসিয়া পর্বতমালার একটি অংশ। এর কিছু অংশ ভারতের আসাম রাজ্য এবং বাংলাদেশের নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত। গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার।
হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ
দুর্গাপুর বাজার থেকে বিজয়পুর যাওয়ার পথে কামারখালী বাজারের পাশে বহেড়াতলীতে অবস্থিত রাশমণি স্মৃতিসৌধ। সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ‘বগাঝরা’ নামক গ্রামটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী গ্রামগুলোর মধ্যে একটি। রাশমণি সেই গ্রামেরই একজন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। ব্রিটিশ মহাজন ও জোতদারদের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান এবং হয়ে ওঠেন আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী।
সোমেশ্বরী নদী
সোমেশ্বরী নদী হচ্ছে স্বচ্ছ জল আর ধু ধু বালুচরের জন্য বিখ্যাত। সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় প্রবাহিত একটি নদী। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের থেকে পতিত বিভিন্ন ঝরনা ধারা থেকে এর উৎপত্তি। বর্ষা মৌসুমে এ নদীর পানির গভীরতা বাড়লেও শীত মৌসুমে পানির পরিমাণ খুবই কমে যায় যেন দিগন্ত বিস্তৃত বালুচর।
চীনামাটির পাহাড়
পর্যটকদের কাছে বিরিশিরি ভ্রমণের মূল আকর্ষণ হলো চীনামাটির পাহাড়। দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বহেড়াতলী গ্রামে এর অবস্থান। এখান থেকে চীনামাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধারগুলো দেখতে বেশ চমৎকার। মৌসুমভেদে এখানকার জলের রঙে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। কখনও গাঢ় সবুজ কখনও বা নীল। এ মাটির বেশ কদর রয়েছে। কাপ-পিরিচ, থালা ও বাসনকোসন বানাতে এ মাটি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও বৈদ্যুতিক ইনসুলেটর বানাতেও এ মাটি কাজে আসে।
যেভাবে যাবেন
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দুর্গাপুরের উদ্দেশে কয়েকটি বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৩০০-৩৫০ টাকা। ট্রেনে যাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। ট্রেনে গেলে জারিয়া স্টেশনে নেমে বিরিশিরি যাওয়া যাবে।
লক্ষ রাখুন
ছোট্ট এ ভূখণ্ডে রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। পর্যটন স্থান আমাদের সম্পদ। এসব স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অপচনশীল দ্রব্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন এবং অন্যকে উৎসাহিত করুন।