বিজয় স্মারক : ঢাকা
গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:০৮ পিএম
আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:২৫ পিএম
জাতীয় স্মৃতিসৌধ
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বিজয়ের এই মাসে থাকছে দেশজুড়ে বিজয়ের স্মারক নিয়ে আয়োজন। যে কেউ ঘুরে আসতে পারেন এসব ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো থেকে। আজ রইল ঢাকা জেলার উল্লেখযোগ্য বিজয়ের স্মারক নিয়ে প্রথম পর্ব।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ
ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের নবীনগরে নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণউৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৮২ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এর স্থপতি সৈয়দ মঈনুল হোসেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধের উচ্চতা ১৫০ ফুট।
সাতজোড়া ত্রিভুজাকার দেয়ালের মাধ্যমে ছোট থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সৌধটি। কংক্রিটের এই সাত জোড়া দেয়ালের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি সময়কালকে নির্দেশ করা হয়েছে। মোট ১০৮ একর উঁচুনিচু টিলা আকৃতির জায়গার ওপর বিস্তৃত সবুজ ঘাসের গালিচায় আবৃত দেশি বিদেশি গাছের বাগান আর লাল ইটের রাস্তা সমৃদ্ধ এই সৌধ ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করে। স্মৃতিসৌধ চত্বরের পাশেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের দশটি গণকবর। আর এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে কৃত্রিম লেক। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
শিখা চিরন্তন
শিখা চিরন্তন রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত একটি স্মরণ স্থাপনা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রদান করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনির আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের স্থান ও দিনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ৭ই মার্চ এর স্মৃতি স্মরণে ১৯৯৭ সালের ২৬শে মার্চ শিখা চিরন্তন উদ্বোধন করা হয়।
রায়ের বাজার বধ্যভূমি
ঢাকা শহরের পশ্চিমে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশেই শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দেশের প্রখ্যাত সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে এই স্থানের পরিত্যক্ত ইটের ভাটার পেছনের জলাশয়ে ফেলে রাখে পাকিস্তানি দোসররা। এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড স্মরণীয় করে রাখার জন্য ইটের ভাটার আদলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় জায়গাটিতে। স্মৃতিসৌধে লাল ইট ও সিমেন্টের গাঁথুনির প্রাধান্যই বেশি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে সৌধের একমাত্র দেয়ালটি নির্ভীক প্রহরীর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এর স্থপতি ফরিদ উদ্দীন আহমেদ। সপ্তাহের সাতদিনই সকাল ৮ থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে।
অপরাজেয় বাংলা
স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সুতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অবস্থিত ভাস্কর্যটির নাম অপরাজেয় বাংলা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে নিবেদিত একটি ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি বিষয়বস্তু তিনজন দণ্ডায়মান মুক্তিযোদ্ধা। এটি নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। অপরাজেয় বাংলা নামকরণটি করেন মুক্তিযাদ্ধা ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের বেদিতে দাঁড়ানো তিন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি যেন অন্যায় ও বৈষম্য দূর করে দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠার গান গাইছে।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সড়কদ্বীপে অবস্থিত এই ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যের এক পাশে একজন কৃষক রয়েছেন, মাঝখানে অস্ত্রধারী নারী ও পুরুষ যোদ্ধা। অন্যপাশে আরও দুই মুক্তিযোদ্ধা। বিজয়ী বেশে তারা ছুটে চলেছেন। ভাস্কর্যের বেদির চারপাশে ৪ ফুট উঁচু দেয়ালচিত্র রয়েছে। দেয়ালচিত্রে স্থান পেয়েছে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বুদ্ধিজীবী নিধন, নারী নির্যাতনের মতো বর্বর দিক ছাড়াও রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের ছবি, রয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের ছবি।
‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন ভাস্কর শামীম শিকদার। তাকে সহযোগিতা করেছেন হিমাংশু রায় ও আনোয়ার চৌধুরী। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ভাস্কর্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
গণহত্যার সাক্ষী জবির গুচ্ছ ভাস্কর্য
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাসে গণহত্যার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য ‘৭১ এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে একটু ভেতরে ঢুকলেই দেখা যায়, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যটি। এটি তৈরি করেছেন খ্যাতনামা শিল্পী ভাস্কর রাসা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষকে ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হতো। এর পর মৃতদেহের স্তূপ সাজিয়ে গণকবর দেওয়া হতো। গুচ্ছ ভাস্কর্যটি দুটি অংশে বিভক্ত। ভাস্কর্যের পূর্ব অংশে রয়েছে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। পশ্চিম অংশে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র। পরে সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মারক হিসেবে গণকবরের ওপরে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৮ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণ শুরু হয়; শেষ হয় ১৯৯১ সালে।
জাবিতে ‘সংশপ্তক’
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাকে স্মরণ রাখতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয় ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যটির নির্মাতা শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। সংশপ্তক দ্বারা বোঝানো হয়েছে-এক পা আর এক হাত হারানোর পরও রাইফেল হাতে লড়ে যাচ্ছেন যোদ্ধা। সংশপ্তক’ হলো ধ্রুপদি যোদ্ধাদের নাম। মরণপণ যুদ্ধে যারা অপরাজিত। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই ভাস্কর্যটি যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।