তানভীর তানিম
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪৮ পিএম
আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:১৬ পিএম
মোটর রেসে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন অভিক আনোয়ার
বাংলাদেশের মোটর রেসিংয়ে অভিক আনোয়ার যেন ওয়ান ম্যান আর্মি। মোটর রেসে বাংলাদেশকে দিচ্ছেন নেতৃত্ব। তার হাত ধরেই আন্তর্জাতিক কার রেসিং প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত হলো ইন্ডিয়ান ট্যুরিং কার চ্যাম্পিয়নশিপ ভক্সওয়াগন পোলো কাপ, সেখানে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন অভিক। লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে গতির ঝড় তোলা এই তরুণকে নিয়ে লিখেছেন তানভীর তানিম
বাবা আনোয়ার হোসেনের ছিল গাড়ির ব্যবসা। এই সুযোগে ছোট থেকেই অসংখ্য ব্র্যান্ডের গাড়ির সঙ্গে পরিচয়। গাড়ির প্রতি তার ভালো লাগাটাও তখন থেকে; প্রায়শ নানা অজুহাতে গাড়ির দোকানে যেতেন, পছন্দের গাড়িগুলোকে ছুঁয়ে দেখতেন। এরপর টেলিভিশনে যখন ফর্মুলা ওয়ান রেসিংয়ে বিশ্ববিখ্যাত রেসার মাইকেল শুমাখার, মিকা হাকিনেনদের ছুটে চলা দেখতেন, তখন অভিকেরও সাধ জাগল, গাড়ি নিয়ে ব্যতিক্রম কিছু করার। সেই থেকে শুরু।
প্লে স্টেশন আর সিমুলেটর ছিল ভরসা
বাংলাদেশে মোটর রেসের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। এখানে এই খেলার জন্য নেই কোনো দক্ষ প্রশিক্ষক, নেই কোনো রেসিং ট্র্যাক। তাই বাংলাদেশের মাটিতে নিজেকে একজন রেসার হিসেবে গড়ে তোলা ছিল খুবই কঠিন। কিন্তু থেমে থাকেননি অভিক। প্লে স্টেশনের গেম আর সিমুলেটর ছিল ভরসা। প্লে স্টেশনে খেলতেন গ্রান ট্যুরিসমো স্পোর্ট। বন্ধুরা প্রায়ই উপহাস করতেন আর বলতেন, ‘এসব অবাস্তব গেম খেলে কী হবে?’ বন্ধুদের বোঝাতেই পারতেন না যে, এই খেলার সঙ্গে বাস্তবে গাড়ি চালানোর কতটা মিল রয়েছে। এরপর ২০০৭ সালে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিক্সে পড়াশোনার জন্য ডাক পান। আর তাতেই তার স্বপ্নপূরণের দরজা খুলে যায়।
পিজ্জা ডেলিভারি বয় থেকে কার রেসার
কার রেসিং ব্যয়বহুল খেলা। অনুশীলনও যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। কিন্তু এ টাকা বাবার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে নিতে নারাজ অভিক। তিনি দেখলেন একটু কষ্ট করলেই রেসিং ট্রেনিং নিতে পারবেন। শুরু হলো পার্টটাইম জবের কাজ। এমনও দিন গেছে, অভিক মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো হাড় কাঁপানো শীতে পিজ্জা ডেলিভারির কাজ করেছেন শুধু টাকা জমিয়ে রেসিং ট্র্যাকে নিজের পদচ্ছাপ আঁকার জন্য। এভাবে অমানবিক পরিশ্রম করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত টাকা জমান। জমানো টাকাকে পুঁজি করে সে বছরই তিনি কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত রেসিং ট্র্যাক টরন্টো মোটর স্পোর্টস পার্কে প্র্যাকটিস শুরু করেন। এই রেসিং ট্র্যাকে প্র্যাকটিস করার জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। অভিকের ভাষ্যমতে, প্রতি দুই ঘণ্টা প্র্যাকটিসের জন্য গুনতে হয় প্রায় ১৪ হাজার টাকা! তাও আবার নিজের গাড়ি নিয়ে যেতে হয়। এভাবে তিন বছর চলার পর ২০১২ সালে পড়াশোনা শেষে ফিরে আসেন ঢাকায়।
র্যালি ক্রস, এরপর আন্তর্জাতিক পর্যায়
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত হওয়া একমাত্র মোটর স্পোর্টস প্রতিযোগিতা র্যালি ক্রস। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেই প্রতিযোগিতায় ২০১৪ সাল থেকে তিনি অংশ নেন। শুধু যে অংশ নিয়েছেন তা নয়, চমকও দেখিয়েছেন। অভিক হয়েছেন হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন। শেষবার যখন অংশ নেন, পেছনের গাড়ি থেকে সময়ের ব্যবধানে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। সেই আত্মবিশ্বাসই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রেস করার সাহস জোগায় অভিককে।
খরচ চলে যেভাবে
অভিক কার রেসার হলেও তার মূল পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন গাড়ি ব্যবসায়ী। তার কোম্পানির নাম কার হাউস লিমিটেড, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গাড়ি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। কাকরাইল রোড, তেজগাঁও লিংক রোড এবং কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে তাদের শোরুম। এ ছাড়া অভিক তার কোম্পানির একজন পরিচালকও। এভাবে গাড়ি ব্যবসা থেকে আয় করা লাভের টাকা জমিয়েই তিনি রেসিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
অভিকের পরামর্শ
সবার তো আর অভিকের মতো সচ্ছলতা নেই। তাই যারা মোটর রেসিং করতে আগ্রহী তাদের জন্য অভিকের পরামর্শ হচ্ছেÑ প্রথম প্রথম সিমুলেটরে রেসিং প্র্যাকটিস করা। তিনি নিজেও এখনও সিমুলেটরে রেসিং প্র্যাকটিস করে থাকেন।
এনজিকে প্রোকার চ্যাম্পিয়নশিপ
আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত এনজিকে প্রোকার চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন অভিক। নিজেরই গড়া বাংলাদেশ মোটর স্পোর্টস দলের হয়ে ‘৮৬ ক্যাটাগরি’তে এমন সাফল্য তার। এ প্রতিযোগিতায় তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, আরব আমিরাতসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের ১৭ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলেন। মোট ছয় রাউন্ডে প্রতিযোগিতাটি সম্পন্ন হয়। প্রথম রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালের ১ নভেম্বর। সেখানে দুই রেসেই প্রথম হন অভিক। এ ছাড়া ইয়াস মেরিনা এফ১ ট্র্যাকে রেস-১-এ প্রথম এবং রেস-২-এ তৃতীয় হন তিনি। অন্যদিকে, সর্বশেষ রাউন্ডের দুটি রেসে দ্বিতীয় হলেও সব মিলিয়ে ৩১০ পয়েন্ট পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি।
মালয়েশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজ-২০২২
মালয়েশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজ ২০২২-এর কার রেসে অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন অভিক। ৩৪ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে প্রথম রাউন্ডের ‘রেস-টু-তে সেরার স্বীকৃতি পান। এ সময় মালয়েশিয়ার রেসিং মঞ্চে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পোডিয়ামে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন বলে জানান অভিক আনোয়ার।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কার রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২৩
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাইতে ৫০ বছর বয়সি মাদ্রাজ মোটর রেস ট্র্যাকে এ টুর্নামেন্টের শেষ দুটি রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আট নম্বর রেসের শেষ ল্যাপে একজনের পরে ফিনিশিং পয়েন্ট ছুঁয়েছে অভিকের গাড়ির চাকা। ফলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন এই বাংলাদেশি মোটর রেসার। এভাবে সব ক’টি রেস মিলিয়ে ভারতের মর্যাদাপূর্ণ ‘এমআরএফ এমএমএসসি এফএমএসসিআই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কার রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩’ টুর্নামেন্টে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। মোট ১৫ জন মোটর রেসার এই টুর্নামেন্টে অংশ নেন। এর মধ্যে অভিকই একমাত্র বাংলাদেশি, বাকিরা ভারতীয়।
পরবর্তী মিশন